রবিবার । ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় বিনোদন ১৬ অগাস্ট ২০২৫, ১০:৫০ অপরাহ্ন
শেয়ার

৬৩তম জন্মদিন

আইয়ুব বাচ্চু: এক যুগের কন্ঠস্বর


Ayub Bacchu

আইয়ুব বাচ্চু (১৬ আগস্ট ১৯৬২- ১৮ অক্টোবর ২০১৮) ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে যদি এক অনন্য নাম খুঁজতে হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে আইয়ুব বাচ্চু। তিনি কেবল একজন গায়ক বা গিটারিস্ট নন; ছিলেন সুরের এক জাদুকর, যিনি বাংলা গানকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নের পেছনে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর কণ্ঠ, গিটার বাজানো আর গান রচনার ধারা বাংলা সংগীতে এক বিপ্লব এনেছিল।

শৈশব ও সংগীতের প্রতি টান
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। ১৯৭০-এর দশকে যখন পশ্চিমা রক মিউজিক তরুণ সমাজকে নাড়া দিতে শুরু করে, তখন কিশোর বাচ্চুও মুগ্ধ হয়ে যান সেই সুরে। এলভিস প্রিসলি, এরিক ক্ল্যাপটন, পিংক ফ্লয়েড কিংবা লেড জেপেলিনের গান শুনতে শুনতে তাঁর মনের ভেতর জন্ম নেয় গিটার হাতে নিয়ে কিছু করার স্বপ্ন। এর আগেই ষাটের দশকে ঢাকায় আইওলাইটস ব্যান্ড দিয়ে এদেশে ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়। এছাড়া, চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠী পপ গান করতে শুরু করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে সুব্রত বড়ুয়া রনি গড়ে তোলেন ব্যান্ড ‘সুরেলা।’ এটিই পরে নাম পরিবর্তন করে হয় সোলস।

প্রথম দিকে স্থানীয় অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ও গিটার বাজিয়ে নিজের প্রতিভা প্রকাশ করতে থাকেন বাচ্চু। অল্প বয়সেই বুঝতে পারেন, সঙ্গীতই তাঁর জীবনের আসল পথ।

Ayub Bacchu 1

সোলস ব্যান্ডে যাত্রা
আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের বড় মোড় আসে ১৯৭৮ সালে, যখন তিনি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস-এ যোগ দেন। সোলস তখনকার সময়ে ছিল তরুণদের প্রিয় ব্যান্ড, আর সেখানে যোগ দিয়ে বাচ্চু দ্রুতই সবার নজর কাড়েন।

সোলস-এর সঙ্গে প্রায় এক দশক কাজ করার সময় তিনি যে গানগুলো সুর করেছেন, তার অনেকগুলোই আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে বাজে। ‘নদী এসে পথ’, ‘ফরেস্ট হিলের এক দুপুরে’, ‘সাগরের ওই প্রান্তরে’, ‘এ এমন পরিচয়’—এসব গান বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে ‘রক্তগোলাপ’ ও ‘ময়না’ নামে দুটো একক অ্যালবাম করেন তিনি। বিশেষ করে সে সময়ে ‘ও বন্ধু তোমায় যখনি মনে পড়ে যায়’ গানে তাঁর কণ্ঠে আসা আবেগময় প্রকাশ ভক্তদের মনে আলাদা ছাপ ফেলেছিল।

এলআরবি প্রতিষ্ঠা ও নতুন দিগন্ত
১৯৯১ সালে আইয়ুব বাচ্চু নিজস্ব ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন এলআরবি (Love Runs Blind)। প্রথমে এর নাম ছিল “লিটল রিভার ব্যান্ড”, কিন্তু কপিরাইট সমস্যার কারণে পরে “লাভ রান্স ব্লাইন্ড” রাখা হয়।

Ayub Bacchu 2

এলআরবি-র শুরুর দিকের লাইনআপ (বাম থেকে) বাচ্চু, টুটূল, মিল্টন আকবর ও স্বপন; ছবি: ফেসবুক থেকে

এলআরবি’র আত্মপ্রকাশ হয় বাংলাদেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম দিয়ে, যা তখনকার সময়ে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। “ঘুম ভাঙা শহরে”, “হকার”, “মাধবী”, “ঢাকার সন্ধ্যা” গানগুলো অ্যালবামের প্রকাশের পরপরই তরুণ সমাজে তুমুল সাড়া ফেলে। এলআরবি দ্রুত দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ডে পরিণত হয়।

গানের ধাঁচ ও কম্পোজিশন
আইয়ুব বাচ্চুর সংগীতে ছিল নানা ধরনের প্রভাব—রক, ব্লুজ, ফোক এমনকি জ্যাজেরও ছোঁয়া। তবে তিনি সবসময় গানকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে, যা হয়ে উঠেছে আলাদা এক ধারা। তাঁর গানগুলোতে পাওয়া যায়- গভীর আবেগ ও দুঃখের রঙ, প্রেম ও ভালোবাসার মায়া, প্রতিবাদ ও পরিবর্তনের আহ্বান।
তিনি ছিলেন অসাধারণ গীতিকারও। জীবনের সাধারণ গল্পগুলোকে সহজ অথচ কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপন করতে পারতেন। আর গিটার সোলোতে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন তাঁর জাদুকরী দক্ষতা। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় গিটার শুধু বাজত না, যেন কথা বলত।

উল্লেখযোগ্য গান
আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ও সুর করা অসংখ্য গান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছুঁয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে- ঘুম ভাঙা শহরে, সেই তুমি (চলো বদলে যাই), হাসতে দেখো গাইতে দেখো, বাংলাদেশ, এখন অনেক রাত, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, রূপালি গিটার, পালাতে চাই, গতকাল রাতে, বন্দী জেগে আছে, কষ্ট কাকে বলে, নীল বেদনা, কিছু চাইবো না, নিরবে, মেয়ে, সাড়ে তিন হাত মাটি, উড়াল দেবো আকাশে, তাজমহল, মন চাইলে মন পাবে, আপন কেহ নাই, চলে যেতে যেতে, সাবিত্রী রায় ইত্যাদি।

মিক্সড অ্যালবামেও জনপ্রিয় অনেক গান গেয়েছেন তিনি। এর বাইরে রয়েছে আন্ডাররেটেড অনেক গান, যেগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়নি কিন্তু অসম্ভব ভালো মাপের গান, যেমন- সুখ, বড়বাবু মাস্টার, খুব সাধারণ জীবন আমার, যে মানুষটি, খুব সহজেই, প্রতিটি ভোর প্রতিটি ক্ষণ, প্রেম তুমি কি?, কিছু নেই আমার, বদলে গিয়েছে সময়, অনিমেষ-সহ আরো অনেক গান।

Ayub Bacchu 3

কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু, ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিতি
আইয়ুব বাচ্চু কেবল দেশে নয়, দেশের বাইরেও বাংলা ব্যান্ড সংগীতের পবিচিতি ছড়িয়ে দেন। ১৯৯৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসার্ট করে কোলকাতায় ব্যাপক পরিচিতি পান। তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে কনসার্ট করেছেন। প্রবাসী বাঙালিদের কাছে তিনি ছিলেন আবেগের নাম। বিদেশি দর্শকদের কাছেও তাঁর গিটার বাজানো প্রশংসিত হয়েছে।

নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করা
আইয়ুব বাচ্চু শুধু নিজে গান করেননি, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার পথও দেখিয়েছেন। অনেক তরুণ শিল্পী তাঁর হাত ধরে ব্যান্ড মিউজিকে সুযোগ পেয়েছেন। গান মানে যে শুধু বাণিজ্য নয়, গান মানে আত্মা থেকে বের হওয়া অনুভূতি- তা আইয়ুব বাচ্চুর বহু গানেই পরিষ্কার। এই দর্শন আজও অনেক তরুণকে অনুপ্রাণিত করে।

শেষ দিন ও উত্তরাধিকার
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চু চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুতে দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামের অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত ভক্তরা কেঁদেছে তাঁদের প্রিয় শিল্পীকে হারানোর বেদনায়।

তবে তাঁর রেখে যাওয়া গান ও সুর আজও বেঁচে আছে। রেডিও, টেলিভিশন, কনসার্ট কিংবা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—সব জায়গায় তাঁর গান শোনা যায়। নতুন প্রজন্মও তাঁর সৃষ্টিকে আবিষ্কার করছে বারবার।

আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন সংগীতশিল্পী নন, ছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গিটার, তাঁর সৃষ্টিই প্রমাণ করে যে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত বিশ্বমানের হতে পারে। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন আমাদের হৃদয়ে একজন সত্যিকারের গিটার জাদুকর হয়ে , যিনি সুরের মাধ্যমে কোটি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছেন।