
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামি ছাত্র শিবিরের আপাত অবিশ্বাস্য জয় প্রচলিত রাজনীতিকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন সবার জন্য চিন্তার কারণও হওয়া উচিত। এটি কেবল একটি ক্যাম্পাসের ভোট নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে স্পষ্টতই। ভোটের যে বিশাল ব্যবধানে শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রধান তিন প্রার্থী (ভিপি, জিএস এবং এজিএস) জিতেছেন, তা কেবল ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) শিক্ষার্থী-অবান্ধব ভুল রাজনীতি আর বাম সংগঠনগুলোর প্রায় অকার্যকর হয়ে যাওয়া আইডিওলজির প্রতি অনাস্থাই নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীত মেরুতে স্থানান্তরের ইঙ্গিতও।
আন্দোলনের নেপথ্যে ক্ষমতার ‘শূন্যতা’ পূরণ
শিবিরের এই জয়কে হঠাৎ কোনো মতাদর্শগত পরিবর্তনের ফল হিসেবে পুরোপুরি ভেবে নেয়াটা খানিকটা বোকামিই হবে। সেক্যুলার রাজনীতির কথা বলেন, এমন অনেকেরই মতে, ডাকসুতে ছাত্র শিবিরের এই জয় বাংলাদেশে মৌলবাদি শক্তির উত্থানের সবথেকে বড় ‘আনুষ্ঠানিকতা’। কিন্তু তাদের অনেকেই এটা ভাবছেন না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মৌলবাদকে আলিঙ্গন করে ভোট দেয়নি। তারা ভোট দিয়েছে সেই একমাত্র সংগঠনকে, যাদেরকে তারা বিগত কয়েক দশকের বিশৃঙ্খলার সময়টিতে সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সক্ষম বলে মনে করেছে।
একবার ভালো করে স্মরণ করে দেখুন, আমরা আজকের এই অবস্থানে কীভাবে পৌঁছালাম। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীরা এমন একটি আন্দোলন শুরু করেছিল, যা ১৫ বছরের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ডেকে আনে। চাকরির কোটার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদ দ্রুতই জবাবদিহি ও সংস্কারের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক মূলধন অর্জন করে। কিন্তু যখন সেই শক্তিকে স্থায়ী সংগঠনে রূপ দেওয়ার সময় আসে, তখন ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারপন্থীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি জাতীয় নাগরিক পার্টির মতো নতুন দলগুলো নির্বাচনে জেতার মতো সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রমাণ মেলে ডাকসু নির্বাচনে এনসিপি’র ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ফলাফল দেখলে। যারা মূলত ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুথানের নেতৃত্ব দিয়েছিল। অথচ বছর না ঘুরতে তাদের পেছন থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল কমতে থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে। এর প্রধান কারণ সম্ভবত বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজি আর মব তৈরির অভিযোগ। আরেকটি কারণ, ওই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কৌশল নির্ধারণ ও লজিস্টিক-সহায়তাদিয়েছিলো ছাত্র শিবির। আন্দোলন সফল হওয়ার পর তারাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম থেকে সরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
অন্যদিকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুথানের পর থেকেই মূলত সরকারগুলো পরিবর্তনের সাথে সাথে ক্যাম্পাসগুলোতেও আধিপত্যের ব্যাটন হাতবদল হয়েছে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মাঝে। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে এই ছাত্র সংগঠন দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে গণরুম আর গেস্টরুম-নির্যাতনের এক ভয়াবহ অপরাজনৈতিক সংস্কৃতি। ফলে এই দুইটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিই এক ধরনের অনাস্থা জানানোর সুযোগ খুঁজছিলো শিক্ষার্থীরা। নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাত্রলীগ সব কার্যক্রমের বাইরে। আর ছাত্রদল আসলে নতুন রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসার বার্তাটা সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য আকারে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিশ্বাসযোগ্য একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নেতৃত্বের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিলো, সেটাকে খুব ভালোভাবেই লুফে নিতে পেরেছে ছাত্র শিবির, তাদের ওয়েলফেয়ারভিত্তিক রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ক্যাম্পাসের চিত্রটা ছিলো স্পষ্ট। হেলমেট বাহিনী হিসেবে খ্যাত ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে যৌক্তিকভাবেই। আর আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রদল ছিলো কার্যত অকার্যকর। অন্যদিকে, হাসিনা সরকারের পতনের পর সংস্কারপন্থীরা নিজেদের ভোট বিভিন্ন প্রার্থী ও জোটে ভাগ করে ফেলে। এই শূন্যতায় শিবির—শৃঙ্খলাবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ এবং কমিউনিটি নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে—সুযোগটি দখল করে নেয়। তাদের বার্তা ছিল সহজ: সহিংসতা ও যৌন সহিংসতার হুমকিতে ক্ষতবিক্ষত ক্যাম্পাসে তারা স্থিতি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনবে।
এই বার্তা বিশৃঙ্খলায় ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া ফেলে। এটি আদর্শের প্রতি ভালোবাসা নয়; এটি ছিল কার্যকর পদক্ষেপের জন্য মরিয়া হওয়া। ফলাফল: এমন এক ভূমিধস বিজয়, যা ছাত্র শিবির এবং জামায়াতের অভিজ্ঞ নেতারাও হয়তো কল্পনা করেননি।
এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত
ঝুঁকিটা এখানে পরিষ্কার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রতীকী বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি র্যাডিক্যাল সংগঠনকে বৈধতা ও গতি দিয়েছে। অথচ ছাত্ররাজনীতি সবসময় জাতীয় রাজনীতির পূর্বাভাস দিয়েছে: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। মূলত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতি গঠন আর সাংস্কৃতিক গতিপথ কেমন হবে তা নির্ধারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদারিত্বই ছিলো মূখ্য। এবারের ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবির শিক্ষার্থীদের মনন আর সাংস্কৃতিক চিন্তায় বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তবে আগামী প্রজন্মের নেতৃত্ব গঠনে তাদের প্রভাব পড়বে বৈকি।
ভবিষ্যৎ ফেরানোর শেষ সুযোগ
তবে আশঙ্কাকে অবশ্যম্ভাবী মনে করবার কোনো কারণ নেই। আমি ভীষণভাবেই বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশটিই আদতে ধর্মনিরপেক্ষ। একইসাথে আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, এই শক্তির হাতে এখনো সময় আছে। কিন্তু দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ছাত্র শিবিরের দিকে ঠেলে দেওয়া মূল সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। চাকরির অভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা। সংস্কারপন্থীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর ছাত্ররাজনীতিকে দমন করার বিষয় নয়, বরং বৈধ শক্তি হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে। সেইসাথে প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ছাত্র শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। কারণ এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, প্রকাশ্য ছাত্র শিবিরের চাইতে ‘গুপ্ত’ ছাত্র শিবির অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মাত্র এক বছর আগে একটি সরকারকে পতন ঘটিয়েছে। আজ তারা র্যাডিক্যালদের উত্থান ঘটাচ্ছে। আগামীকাল তারা আবারও পাল্টাতে পারে—পুনর্নবীকরণের দিকে কিংবা আরও গভীর মেরূকরণের দিকে। সিদ্ধান্ত শুধু শিক্ষার্থীদের হাতে নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল নেতাদের উপরও নির্ভর করছে। তারা যদি সময়মতো একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প দিতে না পারেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে র্যাডিক্যাল রাজনৈতিক দলগুলোর এই উত্থান ঠেকানো অনেকটাই অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।
শাহরিয়ার বিপ্লব: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক।



























