এক. কৌতুক অভিনেতা- The Comedian!
এক সময় চলচ্চিত্রে হাসি ঠাট্টার ব্যাপারটা নিশ্চিত ছিল। নিশ্চিত এই অর্থে যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রথম পয়ত্রিশ চল্লিশ বছরের ধারাবাহিকতা ঘাটলে দেখা যাবে যে কোনো ছবিতেই কৌতুক অভিনেতা বা কমেডিয়ানদের উপস্থিতি আছে। কিন্তু বিবিধ কারণে বাংলাদেশে কৌতুক অভিনেতারা টিকতে পারেননি, হাসির ছবি মুক্তি পেয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি।
অভিনেতা দিলদার ‘আবদুল্লাহ’ ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করলেও নাকি পারিশ্রমিক পাননি। টেলিসামাদকে নায়ক বানিয়ে এদেশে দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল যার নাম ছিল ‘দিলদার আলী’ এবং ‘মনা পাগলা। পরে দেখা গেল টেলিসামাদ টেলিভিশনে গান গেয়ে বেড়াচ্ছন।
কারণ কী? বাংলাদেশের বিখ্যাত এক পরিচালক বলেছিলেন-বাঙালি আড়ালে আবডালে কবিতা লেখে, প্রকাশ্যে হাসাহাসি পছন্দ করে না। যত ছবি হিট হয়েছে তার একটাও হাসির ছবি না। এমন কী স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরাও উপস্থাপক হিসেবে দঁড়াতে পারেন নি। বাঙালি নাকি হাসির চেয়ে কান্নার গান বা ছবি বেশি পছন্দ করে!
সম্ভবত এসব কারণে কাবিলা বা আফজাল শরীফদের ইদানিং ছবিতে দেখা যায় না। সাদা কালো যুগের খান জয়নুল,রবিউল,হাসমত কিংবা ফরিদ আলীরা কী এখন বিস্মৃত?
হিন্দি ছবির বাস্তবতা খানিক ভিন্ন। ‘শোলে’ ছবিতে সৈয়দ ইশতিয়াক জাফরি ওরফে জগদ্বীপ ‘সুরমা ভ‚পালি’ চরিত্রে অভিনয় করে দারুন জনপ্রিয় হন, জনপ্রিয় হন ‘জেলার’ চরিত্রে অভিনয় করা গোবর্ধন আসরানি। জনি লিভার বা কাদের খানরাও জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা ছিলেন হিন্দী ফিল্মের। এখনও আছেন অনেকে। আমরা সিরিয়াস আলোচনায় না যেয়ে একটা ফিল্মি কৌতুক শুনে বিদায় নেই।
রাতে বাসায় ফিরে দরোজা ধাক্কাচ্ছে এক লোক। বউ দরোজা না খুলে বললো-যে নায়িকার সাথে নাচানাচি করে আসছো তার কাছে যাও। লোকটা বললো-নায়ক নায়িকারা পর্দায় থাকে। আমি তোমার স্বামী যে বাস্তবে থাকে। দরোজা খোলো প্লিজ।
পর্দায় সিনেমার নায়িকারা হয়তো প্রেম করে নায়কের সাথে। বাস্তবে বিয়ে করে সিনেমার প্রডিউসারকে!
দুই. আমরা এখনও বন্ধুর মতো- The Divorce
কথায় আছে ভালো ছবি বা গান কখনো পুরোনো হয় না। বলা হয়ে থাকে ওল্ড ইজ গোল্ড। তাই পুরোনো একটা কৌতুক দিয়ে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে।
দুই নায়ক নায়িকার চার চারটা ছবি হিট হবার কারণে তাদের ভেতর প্রেম হয়ে গেল। নায়ক নায়িকা গেল বিদেশ সফরে। নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়লে নায়ক তাকে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। নায়িকা ডাক্তারের রুমে ঢুকলো একা। নায়ক নার্সের সাথে ওয়েটিং রুমে বসে থাকলো। ডাক্তার পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বললেন-অভিনন্দন। আপনি মা হতে চলেছেন! নায়িকা চীৎকার করে নায়কের নাম ধরে ডাকতে থাকলো। ডাক্তার তাকে আস্তে কথা বলার অনুরোধ করে বললেন-আপনি কী সব সময় এত চড়া অভিনয় করেন? নায়িকা রেগে মেগে বললো-নায়ককে এক্ষুনি ডেকে আনুন। না হলে বাইরে বসা আপনার নার্সটাও একদিন মা হয়ে যাবে! তাকে তখন সন্তানের স্বীকৃতির জন্য টেলিভিশনে লাইভ করতে হবে!
সিনেমার প্রেমগুলো যেন কেমন। নায়িকাকে পাবার জন্য নায়ক ভিলেন সহ অগনিত মানুষকে মেরে ফেলে। প্রেমের নামে সন্ত্রাসকে গø্যামারাইজ করা হয়।তারপরও সিনেমার প্রেম যদি বিয়েতে রূপ নেয় তাহলে সেটা নদীর পাড় ভাঙ্গার মতো ভাঙ্গন কবলিত হতে পারে। এজন্য বলা হয়ে থাকে-বিয়ে হয় স্বর্গে কিন্ত ভাঙ্গে হলিউড,বলিউড বা ঢালিউডে। জোয়ান কলিন্স,এলিজাবেথ টেলর,লানা টার্নার,জেএস গ্যাবর কিংবা জেনিফারের মতো অভিনেত্রীদের বিয়ে নিয়ে অনেক গালগপ্প প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন নায়ক নায়িকাদের বিয়ে বা প্রেম নাকি হাতে গোনা যায় না,গণনার জন্য ক্যালকুলেটর লাগে। আরও একটি কথা প্রচলিত আছে ফিল্ম জগতে। বিবাহিত নায়ক বা নায়িকারা থাকেন সিঙ্গেলদের পছন্দের তালিকায়!
প্রেমের মতো ফিল্মি দুনিয়ায় ডিভোর্সটাও খুব আলোচিত ব্যাপার। ডিভোর্স নাকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাভজনক ব্যবসা। ডিভোর্সে মেয়েদের বেশি লাভ হয়। একারণে বলা হয় বিয়ে হলে ভালো ডিভোর্স হলে আরও ভালো। ডিভোর্সের পর সবচেয়ে প্রচলিত কথা হচ্ছে-আমরা এখনও বন্ধুর মতো!
কী আর করা? কৌতুক শুনে বিদায় নেই।
ঊঠতি নায়ক নায়িকা শুটিং শেষে জোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে মারা গেল। তারা স্বর্গের দোরগোড়ায় হাজির হলে প্রহরীর দেখা মিললো। নায়ক প্রহরীকে বললো আমরা কী এখানে বিয়ে করতে পারবো? প্রহরী স্বর্গের ভেতরে গেল। পাঁচ মাস পর ফিরে বললো-তোমাদের বিয়ে পড়ানোর জন্য কাজী নিয়ে এসেছি। এবার নায়িকা বললো-চাইলে আমি কী ডিভোর্স নিতে পারবো? স্বর্গের প্রহরী বললো কাজী খুঁজতেই পাঁচ মাস গেল। উকিল খুঁজতে জানি না কয় বছর লাগবে ।
তিন). সংলাপ – The Dialouge
চলচ্চিত্রের একটা প্রচলিত প্রবাদ এমন-ছবি যায় গান থাকে! ছবি যায় ডায়ালগ মানৃুষ মনে রাখে! কোন ছবি ভালো লেগে গেলে তার গল্প,গান এবং সংলাপ বহুদিন মনে থাকে। কিন্তু ফর্মূলা,মারদাঙ্গা বা প্রচলিত সিনেমার কাহিনীর কিছু কমন ডায়ালগ থাকে। মানুষ মজা করার জন্য আগে এমন ডায়ালগ বলতো। এখন এসব নিয়ে ট্রল হয়। যেমন-
এক. পুলিশের ডায়ালগ-হ্যান্ডস আপ! আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না! অথবা পুলিশ চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। পালানোর চেষ্টা করবেন না।
দুই. নায়িকার ডায়ালগ- ছেড়ে দে শয়তান। তুই আমার দেহ পাবি তো মন পাবি ন্
াতিন. মা এর ডায়ালগ-আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতো! অথবা-বাবা এই শয়তান পচিশ বছর আগে তোর বাবাকে খুন করেছে।
চার. নায়কের ডায়ালগ-চৌধুরী সাহেব আমি গরীব হতে পারি কিন্তু আমার মন ছোট না!
পাঁচ. নায়কের আরও ডায়ালগ-মা মা আমি বিএ পাশ করেছি। অথবা মা আমার চাকরি হয়েছে! অথবা মা মা আমি তোমার দোয়ায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।
ছয়. নায়িকার আরও ডায়ালগ-আপনারা বড় লোক। আপনার টাকা দিয়ে ভালোবাসা কিনতে চান।
সাত. মা এর কমন ডায়ালগ-এ কথা শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন?
আট. ভিলেনের ডায়ালগ-সানডে মানডে ক্লোজ কইরা দিমু!
আয় আইজকা। দিমু হালকার উপর ঝাপসা! আহ ভাতিজা আহ!
নয়. ভিলেনের আরও ডায়ালগ-জয়কালে ক্ষয় নাই। মরনকালে ওষুধ নাই।
দশ. আরও কিছু কমন ডায়ালগ-ক্যারাব্যারা লাগাইয়া দে!
আমার প্রেম তুমি এভাবে নষ্ট করতে পারো না!
মাথা আছে মগজ নাই।
তোর এত বড় সাহস তুই আমার বোনের দিকে নজর দিস।
এগার. ডাক্তারের ডায়ালগ-অপারেশন করতে পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।
ধন্যবাদ আমারে না। ওনারে দেন। উনি সময় মতো রক্ত না দিলে আপনাকে বাঁচানো যেত না।
ছবির সংলাপ আরো আছে। আপনারাও মনে করার চেষ্টা করুন….
চার). যোগাযোগ- The line of the heroine
আমরা সবকিছুতে ‘লাইন’ খুঁজি। কথায় কথায় বলি মন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কোনো লাইন আছে কি না! সিনেমাতেও নাকি লাইনটা আসল। লাইন থাকলে পরিচালক বা প্রযোজকের কাছে নাকি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি ফিল্মে এলেন কী ভাবে? ফরিদী সাহেবের রসবোধ ছিল অসাধারণ। তিনি ঝটপট উত্তর দিয়েছিলেন-বেবিটেক্সিতে চড়ে! (তখন ঢাকার রাস্তায় সিএনজি ছিল না) বাংলা ছবিতে যাত্রা ঢঙ্গের কিংবা উচ্চস্বরে অভিনয়ের ব্যাপারে হুমায়ুন ফরিদী বলেছিলেন-সিনেমা হলের ডায়নামো বা সাউন্ডের যে অবস্থা তাতে ডায়ালগ এমনভাবে দিতে হয় যেন এফডিসির ডায়ালগ সিনেমা হল থেকে শোনা যায়। দেশে অবশ্য তখন সিনেপ্লেক্স আসে নি।
যাই হোক সিনেমার লাইন নিয়ে কথা হচ্ছিল। নায়ক নায়িকাদের ফিল্মে কীভাবে ডেব্যু হয়েছিল মানে তারা কোন লাইন ধরে ফিল্মে এসেছিলেন তা নিয়ে বিস্তর গালগপ্পো আছে। আজ সেদিকে না যাই। ফিল্ম শব্দটা উচ্চারণের মধ্যেও নাকি কার কোন লাইন সেটা বোঝা যায়। একপক্ষ উচ্চারণ করেন ‘ফিল্ম’। আরেকপক্ষ বলেন ‘ফিলিম’। সর্বশেষ এফডিসির নির্বাচনে নাকি ‘ফিলিম’ আলারা জিতেছিলেন। আপনি কোন লাইনে যাবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার।
তবে কেউ কেউ রসিকতা করে বলেন ফিল্মের সবচেয়ে বড় লাইন হচ্ছে নাকি নায়িকা ধরার লাইন! এই লাইন যার আছে তার নাকি কোনো কিছুর অভাব হয় না! তবে ফিল্মে আরও দুটো লাইনের কথা জানা যায়। প্রথমটা কাটা লাইন। নায়িকা যখন শীর্ষ সন্ত্রীসীদের কাউকে বিয়ে করে বা তাদের গার্লফ্রেন্ড হয় তখন সেটা কাটা লাইনের পরিনতি বলে ধরে নেয়া হয়। হিন্দী ফিল্মের নায়িকা মন্দাকিনী সহ একাধিক জনের নাম আসতে পারে এই লাইনে। বাংলাদেশে মডেলের খুন হওয়া সহ আরও অনেক ঘটনা আছে। আরেকটা আছে ‘পাওয়ার’ লাইন। যারা রাষ্ট্রের পাওয়ারে থাকে তাদের কারো সাথে নায়িকার হটলাইন। আমরা বরং কৌতুক লাইনে যাই!
নতুন ছবির মহরত হচ্ছে। নায়ক,সহ নায়ক, নায়িকা, সাংবাদিকরা এসেছেন মহরতে। পরিচালক বা প্রযোজককে দেখা গেল না কোথাও। নায়ক ভয়ে ভয়ে নায়িকাকে বললো-প্রযোজক আর পরিচালক এলো না যে? নায়িকা উত্তর দিলো-কাল যখন অনেকগুলো পত্রিকায় খবর আসবে তখন প্রযোজক পরিচালকদের লাইন জমে যাবে বাসার সামনে! লাইনটাই আসল।
আহসান কবির: সাংবাদিক ও রম্যলেখক।