
তিব্বত ভ্রমণের আগে ও পরে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, এত দেশে যাওয়ার সুযোগ থাকতে, এত আধুনিক শহর আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর অঞ্চল থাকতে কেন আমি তিব্বতকেই বেছে নিলাম!
আমার উত্তর ছিল সহজ- কারণ তিব্বত অন্যরকম। এক ভিন্ন পৃথিবী, এক নিষিদ্ধ স্বপ্নলোক। একসময় এই ভূখণ্ড ছিল পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ, আর আজও সেখানে যেতে গেলে অতিক্রম করতে হয় নানা জটিলতা, যা একে করে তোলে রহস্যময় ও অভিজ্ঞান-সমৃদ্ধ এক গন্তব্য।
তিব্বত একটি ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বিস্ময়
তিব্বত পৃথিবীর ছাদ। হিমালয়ের বিশাল মালভূমিতে অবস্থিত একটি অঞ্চল, যার গড় উচ্চতা ১২ থেকে ২০ হাজার ফুট। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮.৩ গুণ বড় এই এলাকায় ঘোরাঘুরি মানেই নিজেকে নিজের সীমার বাইরে নিয়ে যাওয়া। যেখানে বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি, সেখানে চলাফেরার প্রতিটি মুহূর্ত রীতিমতো শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা। উচ্চতাজনিত অসুস্থতা যেমন- মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা বমিভাব সেখানে সাধারণ ঘটনা।

তবু তিব্বতের আকর্ষণ এতটাই তীব্র যে এসব শারীরিক কষ্টকেও যেন ছাড়িয়ে যায় তার সৌন্দর্য্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিস্ময়কর মায়া।
নিয়ন্ত্রিত কিন্তু সুশৃঙ্খল এক সমাজ
তিব্বতে পর্যটনের জন্য চাইলেই ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হওয়া যায় না। এর জন্য দরকার বিশেষ অনুমতি, নিবন্ধিত ট্যুর গাইড, নির্দিষ্ট রুট ও অনুমোদিত হোটেলে অবস্থান। আর প্রতিটি ভ্রমণেই প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ থাকে নীরব ছায়ার মতো।

তবে এসব জটিলতা নিরসনে যারা ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম “বেঙ্গল ভিস্তা”র সালাহউদ্দিন সুমন। তার সহানুভূতিশীল দিক-নির্দেশনা ও সহযোগিতায় আমি ও আমার সহযাত্রীরা সফলভাবে তিব্বত ভ্রমণ সম্পন্ন করি।
যাত্রা হলো শুরু
২০২৫ সালের ৩ জুন, আমাদের যাত্রা শুরু। পরদিন ৪ জুন পৌঁছাই তিব্বতের রাজধানী লাসায়। এ শহর একসময় পরিচিত ছিল ‘নিষিদ্ধ নগরী’ হিসেবে। বহু বছর ধরে এটি ছিল বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখনো এখানে যেতে হলে তিব্বতের প্রশাসনিক অনুমোদন প্রয়োজন হয়।

লাসা গংগার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি হলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যেটির অবস্থান ৩,৬০০ মিটার বা ১১,৮০০ ফুট উচ্চতায়। এই বিমানবন্দরে অবতরণ করাই যেন এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। হিমালয়ের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে এখানে অবতরণ এক বিরল অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। তবে অক্সিজেনের স্বল্পতায় শরীর হালকা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, মন হয়ে ওঠে টালমাটাল। লাসা বিমানবন্দরের রানওয়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। যা বিশ্বের যে কোনও বিমানবন্দরের তুলনায় বেশ বড়। অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে বিমানের ওঠানামার জন্য এই দীর্ঘ রানওয়ের প্রয়োজন হয়।
অতীশ দীপঙ্কর: বঙ্গ থেকে তিব্বত
লাসায় অবতরণ করেই মন ছুটে যায় ইতিহাসের এক মহান নামের টানে; অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ৪ জুন ২০২৫ আমরা যাই লাসার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মন্দির ও সমাধি চত্বরে। বাংলাদেশের বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া এই মহান বৌদ্ধ ভিক্ষু নেপাল ও তিব্বতে ধর্ম প্রচারে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১১শ শতকে বঙ্গদেশ থেকে তিব্বতে আসেন। এখানেই ১০৫৪ সালে মহাপ্রয়াণ লাভ করেন। মন্দিরে তাঁর সমাধি ও ভিক্ষু জীবনের নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এলাকাটি তিব্বতের মানুষদের জন্য একটি পবিত্র তীর্থস্থান এবং বাংলাদেশ-তিব্বতের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক সংযোগের এক অনন্য নিদর্শন। তিব্বতের মানুষ আজও তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করে। সেই পবিত্র স্থানটিতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, বাংলার ইতিহাস তিব্বতের বুকে গাঁথা এক গৌরবময় অধ্যায়।

পোটালা প্রাসাদ: বৌদ্ধ সভ্যতার এক মহাসমারোহ
৫ জুন ২০২৫, আমাদের যাত্রা শুরু হয় পোটালা প্যালেসে। এর মাঝে আমাদের প্রায় সকলেই পর্বতের উচ্চতা জনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত। সে অসুস্থতাকে পাত্তা না দিয়েই আমরা চলেছি তিব্বতের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখতে। পোটালা প্রাসাদ শুধু তিব্বতের প্রধান দর্শনীয় স্থানই নয়, বরং এটি এক ঐতিহাসিক প্রতীক। ১৯০৪ সালের আগে বাইরের পৃথিবী এই স্থাপনার নামই জানতো না। একজন আমেরিকান পর্যটক বহু চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে গোপনে লাসা এসে এই শতাব্দীপ্রাচীন প্রাসাদটি দেখতে পান এবং এই প্রাসাদের তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচন করে দেন। প্রাসাদটি আজও সমান জৌলুসে দাঁড়িয়ে আছে — যেন ইতিহাসের অনন্ত নিরবতা। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সময় থেমে গেছে, চারপাশে শুধু অতীতের গর্জন।
আধুনিকতার ছোঁয়া, ঐতিহ্যের সৌন্দর্য্য

লাসা শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ হাজার ৯৭৫ ফুট উচ্চতায়। এই উচ্চতায় সাধারণত গাছ জন্মে না, তবে চীন সরকার প্রযুক্তির সহায়তায় শহরকে সবুজে পরিণত করছে। প্রতিটি গাছের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করা হয় মাইক্রোচিপ দিয়ে। শহরের প্রতিটি স্থাপনা ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীতে গড়া — যেন পুরো শহরটাই এক চলমান জাদুঘর।
ভাষা ও মানুষ
তিব্বতিরা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। যদিও তাদের সঙ্গে পর্যটকদের সরাসরি যোগাযোগ কিছুটা কঠিন। তবে এক্ষেত্রে ভ্রমণ গাইডরা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। আর স্থানীয় মানুষদের ব্যবহার ও আতিথেয়তা সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়।

লাসা: হৃদয়ের উচ্চতায় অবস্থিত এক শহর
তিব্বত শুধু একটি অঞ্চল নয়, এটি এক অনুভব। এটি এমন এক স্থান, যেখানে গিয়ে আপনি বুঝবেন, ভ্রমণ মানে শুধু দর্শন নয়; আত্মার উপলব্ধি।

লাসা এক শহর যেখানে ইতিহাস নিঃশব্দে হাঁটে, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে হিমালয়ের ছায়ায়। তাই বলতেই হয়— পৃথিবীর অনেক শহর দেখা হয়েছে, কিন্তু লাসা না দেখলে সেই অভিজ্ঞতা থেকে যেত অসম্পূর্ণ।
খ ম হারূন: মিডিয়া ব্যক্তিত্ব । অধ্যক্ষ, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট।