
বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গুলশান থানায় দায়ের করা অর্থপাচার মামলায় ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান লায়ন এমকে বাশারকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. ছানাউল্ল্যাহ রিমান্ড শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এর আগে সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি বাসা থেকে বাশারকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম টিম।
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারক এমকে বাশারের উদ্দেশে বলেন, আপনার বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, মোকাবিলা করতে গেলে তো সারা জীবন কারাগারে কেটে যাবে।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বাশারকে আদালতে হাজির করা হলে উত্তেজিত জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশি প্রহরায় কাঠগড়ায় নেওয়ার সময় তার মাথায় হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছিল, হাতে হাতকড়া। আদালতের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বাশারের দিকে জুতা, পচা ডিম ও ঘুষি নিক্ষেপ করেন। কাঠগড়ায় ওঠার পর তার হেলমেট খুলে দেওয়া হয়, এরপর কালো মাস্ক সরিয়ে হাসেন বাশার।
বিচারক তখন প্রশ্ন করেন, “এই প্রতারণা কেন করলেন? কেন টাকা ফেরত দেননি?” কিন্তু বাশার নীরব থাকেন। বিচারক বলেন, “আপনার বিরুদ্ধে কতগুলো মামলা চলছে জানেন?” জবাবে বাশার বলেন, “আনুমানিক ৭০টা।” তখন বিচারক বলেন, “এই মামলা মোকাবিলায় তো সারাজীবন কারাগারেই কেটে যাবে। একবারও ভাবলেন না এই শিক্ষার্থীরা কারো সন্তান?”
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন। তিনি বলেন, “বাশার শিক্ষাকে ব্যবসার পণ্য বানিয়েছেন। রাষ্ট্রের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করেছেন। আমাদের কাছে তথ্য আছে, তিনি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।”
বাদীপক্ষের আইনজীবী জামাল উদ্দিন বলেন, “লন্ডন, কানাডা, আমেরিকার নাম করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করেছেন তিনি।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল ও জামিন চাইলেও আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, বাশার, তার স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশার বিদেশে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে ১৪১ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তদন্তে উঠে এসেছে, এ সংখ্যা ৪৪৮ জন এবং অর্থের পরিমাণ ৫৩ কোটি টাকারও বেশি, যা চূড়ান্ত তদন্তে আরও বাড়তে পারে।
সিআইডির সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে ভুয়া ভিসা, ভুয়া অফার লেটার দেখানো হতো। অনেকের নামে কোনো আবেদনই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়নি। আবার কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে বিশাল প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
তারা আরও জানায়, আদায়কৃত অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করে বাশার ও তার সহযোগীরা সম্পদ কিনেছেন, ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন।
আদালতের সামনে দিনভর ছিল ভুক্তভোগীদের উপস্থিতি। ‘ভুক্তভোগী সহস্রাধিক ছাত্রসমাজ’-এর ব্যানারে বাশারের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন তারা। শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল ভুয়া চেক, প্রতারণার প্রমাণ এবং প্ল্যাকার্ড। অনেকে অভিযোগ করেন, টাকা ফেরত না দিয়ে বাশারের লোকজন তাদের হুমকি দিয়েছে, এমনকি হামলা চালিয়েছে।
এক অভিভাবক সাখাওয়াত বলেন, “চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি ছাত্রদের কানাডা, ইউরোপ, আমেরিকায় পাঠানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।”
তাহমিনা আক্তার মুন্নী বলেন, “এখন পর্যন্ত প্রতারণার বহু মামলা হয়েছে। অথচ কোনো অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি, উল্টো হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”
গোলশানসহ দেশের বিভিন্ন থানায় বাশারের বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ের মামলা চলমান রয়েছে। সিআইডির তদন্ত বলছে, বাশার একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের অংশ, যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারে জড়িত।


























