
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমদের গুলশানের আলিশান ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটিতে থাকা তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো নিলামে তোলা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত নিলাম কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। খবর বাসস-এর।
বেনজীর গুলশানে র্যাংকন টাওয়ারে যে চারটি আধুনিক ফ্ল্যাটের সমন্বয়ে একটি আলিশান ডুপ্লেক্স ইউনিট করেছেন। কী নেই সেই আলিশান ফ্ল্যাটে! জব্দ সম্পদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে নিলাম কমিটির সদস্যরা হতবাক।
বেনজীরের এই আলিশান ফ্ল্যাটে জব্দ তালিকার ২৪৬টি উপকরনের মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করলেই পুরো চিত্র পাওয়া যাবে। শুধু একটি ভবনের ফ্ল্যাটেই পাওয়া তাদের ব্যবহৃত সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- শার্ট ১২২টি, প্যান্ট ২৬৬টি, ৩০ ব্লেজার, আটটি স্যুট, টি-শার্ট ৭২২টি, পাঞ্জাবী ২২৪টি, পায়জামা ৪৭টি, স্যান্ডেল ৮৮ জোড়া, কেডস ৩৫ জোড়া, জুতা ৩৮ জোড়া, শাড়ি ৪৯৪টি, থ্রিপিস ২৫০ সেট, সালোয়ার-কামিজ ৪৯৬টি, ব্লাউজ ৬৫টি, জামা ২১২টি, জ্যাকেট ৫৬টি, বেডশিট ১০৯টি, লেডিস ভ্যানিটি ব্যাগ ৭৫টি, লেডিস টপস ৬২২টি, সোয়েটার পুরুষ-১১টি, লেডিস-৩৪টি, লেডিস প্যান্ট ৩৫৫টি, লেডিস টি-শার্ট ২৮টি, নাইট ড্রেস ৫৮টি, ওড়না ৩৪৭টি, শাল-চাদর ৮৯টি, শীতের জামা ১৩২টি, লেহেঙ্গা ১৬টি, সানগ্লাস ৩৪টি, ট্রাউজার ৬৭টি।
ইনভেন্ট্রি কমিটির একজন সদস্য বাসস-কে জানান, ফ্ল্যাটের ব্যবহৃত জিনিসপত্র তালিকা করার সময় মনে হয়েছে আমরা মার্কোস ও ইমেলদা মার্কোসের সম্পদের তালিকা তৈরি করছি। আশির দশকে দুনিয়া কাঁপানো মার্কোস দম্পতির কথা মনে পড়ে গেল। ইমেলদা মার্কোসের জুতা, ব্যবহৃত পোশাক, অন্যান্য সামগ্রী ও প্রসাধনের মুখরোচক সংবাদ ওই সময় আলোচিত ছিল। এ যেন বেনজীর দম্পতির সঙ্গে ফিলিপাইনের মার্কোস দম্পতির রাশি জাতকের মিল।
সেন্ট-পারফিউম ছাড়াও ড্রয়িং রুম, বৈঠকখানা, থিয়েটার রুম, করিডোর বৈঠকখানা, কিচেন রুম, মাস্টার বেডসহ অন্যান্য বেডরুমের ব্যবহৃত জিনিসপত্র তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।
গুলশানের র্যান্কন টাওয়ারে ফ্ল্যাট নং ১২/এ, ১২/বি, ১৩/এ, ১৩/বি এই চারটি আলিশান ফ্ল্যাটকে একত্রিত করে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট তৈরি করেন বেনজীর দম্পতি। যেখানে সুইমিং পুল, মিনি থিয়েটার রুম, অতিথি বিনোদন বৈঠকখানাসহ আধুনিক আভিজাত্য সুযোগ-সুবিধাগুলো বিদ্যমান।
অনুসন্ধান টিম জানিয়েছে, পুরো ফ্ল্যাটে ১৯টি ফ্রিজ রয়েছে। এসি রয়েছে সব মিলিয়ে ১০০টন, সুইমিং পুলে ব্যবহৃত আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী। ফ্ল্যাটের খাট, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল সোফা, চেয়ার, আলমিরা, ওয়্যারড্রোবসহ মূল্যবান সামগ্রী নিলাম বহির্ভূত রাখা হয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পালিয়ে যাবার আগেই ২০২৪ সালের ৪ মে মিথ্যা ঘোষণায় নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে বেনজীর আহমদ তার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে গোপনে দেশ ছাড়েন। দুদকের তদন্ত টিম ও নিলাম কমিটির সদস্যদের মতে বেনজীর দম্পতি গোপনে পালিয়ে যাবার সময় ব্যাগ ভর্তি স্বর্ণালংকার, টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে গেছেন। ইতোমধ্যে দুদক ১১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাচারের অভিযোগে বেনজীরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।
বেনজীরের গুলশানের ফ্ল্যাটের জিনিসপত্র নিলামে তোলার জন্য আদালত যে কমিটি করে দিয়েছে। কমিটিতে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালককে সভাপতি এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিনিধি, বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের একজন প্রতিনিধি, ইস্পাত প্রকৌশল অধিদপ্তরের চেয়ারম্যানের একজন প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। দুদকের উপ পরিচালক (সম্পদ ব্যবস্থাপনা) সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। আদালত এই কমিটি গঠন করার পর উক্ত ফ্ল্যাটে ব্যবহৃত সম্পদের তালিকা (ইনভেনট্রি) প্রস্তুত করেছে।
বেনজীর আহমেদ পলাতক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাপুটে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ছিলেন। গোপালগঞ্জের অধিবাসী বেনজীর আহমদ গণরোষে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, এলিট ফোর্স র্যাবের মহাপরিচালকসহ প্রাইজ পোস্টিংগুলো উপভোগ করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি তৎকালীন সরকারের আনুগত্য লাভের জন্য বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের দমন-পীড়ন, মামলা, গুম, খুন, রাতের ভোটের নির্বাচনের কারিগরদের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। শেখ হাসিনা পরিবার পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার আগেই দেশের রাজনৈতিক বৈরী আবহাওয়া বুঝতে পেরে বেনজীর আহমেদ গোপনে জাল পাসপোর্ট করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট করার অভিযোগে দুদক তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে।
দুদক জানিয়েছে, বেনজীরের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা ছাড়াও তার স্ত্রী জিশান মীর্জা, বড় কন্যা ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে ৭৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন পৃথক চারটি মামলা করেছে ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এর মধ্যে বেনজীর আহমদ ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ২ কোটি ৬২ লাখ টাকার তথ্য গোপন, স্ত্রী জীশান মির্জা ৩১ কোটি ৬৯ লাখ সম্পদ অর্জন, ১৬ কোটি ১ লাখ টাকার তথ্য গোপন, বড় মেয়ে ফারহীন ৮ কোটি ৭৫ লাখ এবং ছোট মেয়ে তাসীন ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপন করেছেন।


























