
আপনার তুরস্ক ভ্রমণের সময় যেসব জায়গা দেখার জন্য সবাই পরামর্শ দেবেন সেগুলো হলো- ইস্তাম্বুল, ক্যাপাডোসিয়া ও ইজমির। যদিও শুধু ইস্তাম্বুল এক সপ্তাহ দেখেও আপনি শেষ করতে পারবেন না। এতো ঐতিহাসিক ও আধুনিক স্থ্যাপত্যের নিদর্শন ইস্তামবুলে আছে যা আপনাকে বিস্মিত করবে প্রতি পদে পদে। সর্বোপরি এটা একটা টুরিস্ট শহর। সব সময় সারা বছর পৃথিবীর মানুষ এখানে ভীড় করে। একারণে আমার মনে হয়েছিল যদি কোনো শান্ত নিরিবিলি জায়গা যেখানে কম মানুষ যায়, এমন একটা জায়গায় এবার যাব। পরিকল্পনা ছিল ইস্তাম্বুল থেকে যাবো রাজধানী আঙ্কারা, তারপর কোনিয়া, তারপর আন্তালিয়া। ওখান থেকে ক্যাপাডোসিয়া তারপর আবার ইস্তাম্বুল।
পরিকল্পনা মতোই তুর্কি ভ্রমণপর্ব শুরু হয়। তবে আমি বিশেষভাবে আজ উল্লেখ করতে চাই, কোনিয়া ভ্রমণের কথা। কারণ এই শহর শান্ত, প্রশান্তিময়, নিরিবিলি কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ। কোনিয়া তুরস্কের এক ঐতিহাসিক শহর, যার বাতাসে মিশে আছে দার্শনিকতা, সুফিবাদ আর কবিতা। এই শহরের পথে পথে হাঁটলে মনে হয়, যেন নিঃশব্দ এক শান্ত সুর বয়ে যায় হৃদয়ের গহীন থেকে। ‘এসো, যেই হও না কেন, এসো’ রুমির এটা আহ্বান। যা আপনাকে উৎসাহিত করবে কোনিয়া শহরের দিকে- যেখানে আজও প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায়। মওলানা জালালউদ্দিন রুমি- যিনি কেবল কবি নন, বরং প্রেম ও সৃষ্টির এক গভীর অনুসন্ধানকারী। কোনিয়া এমন এক শহর, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মদর্শন মিশে একাকার হয়েছে।
রাজধানী আঙ্কারা থেকে বিকেলে বাসে রওয়ানা দিয়ে আমি যখন কোনিয়া শহরে নেমেছিলাম তখন রাত ৮টা বেজে গেছে। উবার ট্যাক্সি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম পূর্ব নির্ধারিত হোটেল ‘বেরা কোনিয়া’তে। বড়সড় সুন্দর একটা হোটেল। যথেষ্ট পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। কর্মীদের ব্যবহারও খুব ভালো। ব্রেকফাস্টসহ এই হোটেলের ভাড়া ৫০ ডলার প্রতিরাতের জন্য। বলে রাখা ভালো এই হোটেলের রেস্টুরেন্টে শতাধিক আইটেম সার্ভ করা হয় ব্রেকফাস্টএ যা অত্যন্ত উপাদেয় ও সুস্বাদু। এখানে নাশতা করার সময় এক ওয়েটারকে বলেছিলাম, আমি দুইদিন এখানে আছি। কোথায় কোথায় যাওয়া যায় বলতে পারো? সে আমাকে একটা ভ্রমণ বা পরিদর্শনের তালিকা দিয়েছিল, যা এই লেখার সাথে যুক্ত করেছি শেষের দিকে। আপনি যদি আসেন কোনিয়াতে তাহলে হাতে অন্তত ৪-৫ দিন সময় নিয়ে আসবেন।
ডিনারের জন্য হোটেলের কাছেই তানতুনি নামের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। মেন্যু দেখে একটা ডোনার আর কোপ্তা অর্ডার করছিলাম, সাথে সালাদ এবং চা। এখানকার রেস্টুরেন্ট কর্মীরা বার বার জিজ্ঞেস করছিলো চা লাগবে কিনা। কারণ কোনিয়াতে খাবার অর্ডার করলে সাথে পাউরুটি আর চা রিফিল পাওয়া যায়। খাওয়ার পর আশপাশটা ঘুরে দেখেছিলাম। আধুনিক সব অট্টালিকা আর দুর্দান্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধ এক শহর। ট্রেন, বাস, ট্রাম, মিনিবাস কী নেই এই শহরে! কোনিয়া খুবই ছিমছাম, ঝকঝকে সুন্দর এক শহর।

কোনিয়া ছিল সেলজুক যুগের রাজধানী
কোনিয়ার ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ বছরের পুরাতন। এটি প্রাচীনকালে ইকোনিয়াম (Iconium) নামে পরিচিত ছিলো এবং হিট্টাইট, ফ্রাইজিয়ান, পার্সিয়ান এবং গ্রিকদেরর শাসনাধীন ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে এটি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনে আসে এবং পরবর্তীতে রোমান সম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে। খ্রিস্টান যুগে এটি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিতি পায়।
কোনিয়া এক সময় সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল (১১শ-১৩শ শতাব্দী)। এই সময় কোনিয়ার সর্বোচ্চ সমৃদ্ধি ঘটে। এ শহরেই গড়ে উঠেছিল এক প্রভাবশালী মুসলিম সভ্যতা যার পরিচয় মেলে এর অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও দারভিশ লজে। এসময়েই কোনিয়ায় আগমন ঘটে পারস্য কবি মওলানা জালালউদ্দিন রুমির। মওলানা রুমি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মসনভি’ এখানেই রচনা করেন। তাঁর অনুসারীরা এখানে মেভলানা তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। মওলানা রুমি এখানেই জীবন কাটান, শিক্ষাদান করেন, প্রেম ও আত্মার অনুসন্ধানে কবিতা লেখেন এবং মৃত্যুর পর সমাধিস্থ হন। আজও রুমির সমাধি কোনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান।
১৪শ শতকের শেষে কোনিয়া অটোমান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অটোমান যুগে শহরটি আঞ্চলিক প্রশাসসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠনের পর কোনিয়া আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যায়। বর্তমানে এটি কৃষি, শিক্ষা, শিল্প ও ধর্মীয় পর্যটনের জন্য পরিচিত। আজকের কোনিয়া একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ছোঁয়ায় গর্বিত এক শহর। এটি তুরস্কের অন্যতম বৃহৎ শহর যেখানে প্রতিবছর লাখো পর্যটক পরিদর্শনে আসেন।

মওলানা জালালউদ্দিন রুমির সমাধির প্রবেশদ্বার
কোনিয়াতে পরিদর্শনের জন্য অনেক ঐতিহ্য, স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। কিন্তু আমি শুধু দুয়েকটা জায়গার কথা এখানে তুলে ধরলাম। কারণ ভ্রমণের পরিপূর্ণ বিবরণ এক লেখায় সংকুলান যোগ্য নয়।
কোনিয়াতে বেড়াতে এলে আপনি কোথায় কোথায় যেতে পারেন তার একটা তালিকাও এখানে দিয়ে দিলাম।
মওলানা জালালউদ্দিন রুমির সমাধি
রুমির সমাধি কোনিয়া শহরের ভেতরেই। আমাদের হোটেল থেকে মাত্র সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূরে ছিল। এক সকালে প্রেম ও মানবতার সুফি কবি মওলানা জালালউদ্দিন রুমির সমাধি ও জাদুঘর দেখার জন্য চলে যাই। সেদিন কিছুটা বৃষ্টি ছিলো কিন্তু তা আমার জাদুঘর ও সমাধি দর্শনে তেমন ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি।
তাঁর সমাধির বাইরের এক অংশ যেখান দিয়ে প্রবেশ করতে হয়, সেখানে আছে একটা ছোট্ট বাগান। এই বাগানের কিছু গাছ ঘূর্ণায়মান নৃত্যের গড়নে ছাটকাট করে বড় করা হয়েছে। আর বাইরের অন্য অংশে বিশাল মেভলানা (মওলানা) ময়দান। এই ময়দানে রাতে লাইট শো হয়, যা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। রুমির সমাধি বা জাদুঘর দেখার জন্য এখনো কোনো ফি দিতে হয় না। যা তুরস্কের অনেক ঐতিহাসিক স্থানে প্রবেশের জন্য আগের চাইতে দ্বিগুণ হারে দিতে হয়।

ঘুর্ণিয়মান পরিবেশনার আদলে গাছ
রুমি জন্মগ্রহণ করেন ১২০৭ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ শহরে। তাঁর বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন একজন বিখ্যাত ধর্মীয় পণ্ডিত ও সুফি সাধক। এই সময় রুমির পরিবার মঙ্গলদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পশ্চিমে পাড়ি জমান। রুমির শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাগদাদ, দামেস্কে ও মক্কায়। এরপর তাঁর পরিবার কোনিয়াতে এসে থিতু হন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁক আসে ১২৪৪ সালে, যখন তিনি মিলিত হন শামস-ই-তাবরিজি নামে এক আধ্যাত্মিক দরভিশের সাথে। তাদের সম্পর্ক তাঁকে আত্মিক প্রেমের পথে নিয়ে যায় এবং তিনি এই সময় লেখেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মসনভি’।

মওলানা জালালউদ্দিন রুমির সমাধি
রুমি বিশ্বাস করতেন সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছাতে হলে প্রেম ও মানবিকতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তিনি লিখেছেন, ‘তুমি যদি সূর্যের মতো আলো দিতে চাও, তবে প্রথমে নিজের ভিতরে আগুন ধরাও।’ তাঁর আর একটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে, ‘ভালোবাসা আমাদের সেই জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে ভাষা থেমে যায়, আর হৃদয় কথা বলে’।
রুমির সমাধি দেখা শেষ হলে, একই চত্ত্বরে অবস্থিত জাদুঘর দেখার জন্য যাই। জাদুঘরের প্রতিটি স্থানে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পোশাক, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, দারভিশদের পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, সুফিবাদ নিয়ে আলোচনা ও শিষ্যদের মডেল, সব যেন মেলে ধরে ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে, জাদুঘর দেখা শেষ করতে ২ থেকে ৩ ঘন্টা লেগে যাবে।

মওলানা জালালউদ্দিন রুমির সমাধী ও জাদুঘর চত্ত্বর
প্রতি শনিবারে কোনিয়া কালচারাল সেন্টারে বসে দারভিস ঘুর্ণায়মান পরিবেশনা। এটা সুফি ও রুমির অনুসারীদের কাছে জীবন ও আত্মার এক মেলবন্ধন। কোনিয়া যাওয়ার আগে শনিবার যেন আপনার ভ্রমণ তালিকায় পড়ে সেটা দেখে প্লান করবেন।
দরবেশদের ঘূর্ণায়মান পরিবেশনা যাকে তুর্কি ভাষায় বল হয় সেমা, এটি একটি আধ্যাত্মিক উপস্থাপনা যা ইসলামী সুফিবাদের অর্ন্তগত। এই উপস্থাপনা প্রধানত মওলানা জালালউদ্দিন রুমির দর্শনের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছে এবং তুরস্কের কোনিয়া শহর যার মূল কেন্দ্রবিন্দু। এটি সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক সাধানার মাধ্যম, যার মাধ্যমে সুফি দরবেশরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা, আত্মসমর্পন ও আত্মা-মিলনের প্রকাশ ঘটান। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো এই নৃত্যকে তালিকাভুক্ত করে।

সুফি দরবেশদের ঘূর্ণিয়মান উপস্থাপনা। ছবি গুগলের সৌজন্যে
সিলে (Sille) ভিলেজ
পরদিন সকালে সিলে (ঝরষষব) ভিলেজ দেখার জন্য যাই। একটা ট্যাক্সি নিয়েছিলাম সেখানে যাওয়ার জন্য। কোনিয়া শহর থেকে এর দূরত্ব ছিল ৮ কিলোমিটার, ড্রাইভারকে মিটার দেখে ১০০ লিরার মতো দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ছে আর আসার সময় মিনি বাসে ১৩ লিরা।
সিলে এক অদ্ভুত সুন্দর গ্রাম যা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো- যেখানে প্রাচীন গ্রিক ও তুর্কি মুসলিমদের সহাবস্থান ও মেলবন্ধন পাওয়া যায়। এখানে আছে সেন্ট হেলেনা চার্চ, যা ৩২৭ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাজ্ঞী হেলেনা নির্মাণ করেছিলেন। আছে সরু গলি, ছোট্ট গির্জা, প্রাচীন তুর্কি বাথহাউজ, সব মিলিয়ে এক অন্য রকম সুন্দর গ্রাম। রাস্তার দুপাশে কৃত্রিম ফোয়ারা, যা অনেক লম্বা আর বড় বড় ক্যানেলের সাথে যুক্ত, আছে পাহাড় আর পাহাড়ের পাদদেশে পুরাতন আর পাথরের তৈরি বাড়িঘর।
শোনা যায়, মওলানা রুমি নিজে এই গ্রামে আসতেন এবং মুসলিম-খ্রিস্টান বন্ধুত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। গ্রামের পাশে পাহাড় আর ক্ষীণ নদীর স্রোত যেন সময়কে পিছনে নিয়ে যায়। শুনেছি, কোনিয়া শহরের লোকেরা ছুটির দিনে এই গ্রামে আসে কেনাকাটা করা ও সকালের নাশতা করার জন্য। নিদিষ্ট পার্কিং জোনে দেখেছি শত শত গাড়ি দাঁড় করানো। এ থেকে বোঝা যায় শহরের প্রচুর মানুষ এখানে আসে প্রতিনিয়ত। আরও দেখেছি সরু পাথুরে রাস্তার দুপাশে ছাতা এবং তাবুর নিচে সারি সারি সোফা সেট আর টেবিল দিয়ে সাজানো সব রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট ছাড়াও মানুষ বসেছে রাস্তার দুপাশে পশরা নিয়ে। যেখানে স্থানীয় খাবার দাবার, তাজা ফল, শাকসবজি, শুকনা ফল, ফুল সবই ছিলো। আর ছিলো শত শত দোকান যেখানে মাটির তৈজশপত্র, হস্তশিল্প আর অর্নামেন্টে পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় হাতে তৈরি সিরামিকস ও কারুপন্য।

কোনিয়া শহর থেকে যারা এসেছে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। কী শান্ত আর আনন্দদায়ক পরিবেশ, দেখতে খুব সুন্দর লাগছিলো। কারণ নির্মল, বায়ুদূষণহীন পরিবেশ, ঝকঝকে আকাশ, শীতের আমেজ আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য। পাশের কৃত্রিম ক্যানেল ও ঝরনা থেকে মিষ্টি শব্দ ভেসে আসছে। টুরিস্টদের দেখে দোকানিরা কেনার জন্য আমন্ত্রণ জানচ্ছে। তবে কোনো টানাটানি নেই, অসভ্যতা নেই। খুবই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
মনে পড়ছে, আমি যেদিন এই গ্রামে যাই, সেদিন ছিল তুরষ্কের ইলেকশন। এই গ্রামের একটা স্কুলে ভোট নেওয়া হচ্ছিল সেদিন। কিছু না বুঝেই আমি স্কুলের ভোট কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছিলাম। তাতে অবশ্য কেউ আমাকে কিছু বলেনি। ভোটকেন্দ্রে না দেখেছি ভোটারের লাইন না উত্তেজনা, না মারামরি। জনগণ কি ভোট বিমুখ ছিলো? নাকি তারা ভোট দিয়ে নিজ নিজ কাজে চলে যাওয়ায় অভ্যস্ত? সারাদিন কেন্দ্রে বসে তারা কি ভাবচক্কর দেখে না, কে জানে!
সেদিন সন্ধ্যায় অবশ্য দেখেছি সাপোর্টারদের বিশাল বিজয় মিছিল। বিজয় মিছিলের কারণে শহরের রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সি নিয়েছিলাম, মাঝ রাস্তায় এসে ট্যাক্সি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমি ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। তারপর এক কিলোমিটার হাঁটি। লোকজনের কাছে জানতে চাই, আমার হোটেলের লোকেশন। কারণ আমার ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সারাদিন অন থাকার কারণে। তাই নেট কানেকশনহীন রাস্তায় আমাকে যারপরনাই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল হোটেল খুঁজে বের করতে। সারাদিন ক্লান্ত ছিলাম আর হাতে ছিলো ভারি শপিং ব্যাগ। তাই মন খারাপ হয়েছিলো যারা রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনভোগান্তি তৈরি করে তাদের প্রতি।
কুলটুর পার্ক (Kültürpark)
একদিন সন্ধ্যায় আমি কালচার পার্কে বেড়ানোর জন্য যাই। এটা শহরের মধ্যে আমার হোটেল থেকে আধ কিলোমিটার দূরত্বে সবুজ প্রশান্ত একটা এলাকা। নানারকম গাছপালা আর ফুলের সমাহার এই পার্কে। আমি জীবনে প্রথাম মেপল গাছ এই পর্কেই দেখি। খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, প্রশস্ত রাস্তা, বসার জন্য শত শত পরিচ্ছন্ন বেঞ্চ, কৃত্রিম হ্রদ, বাগান, শিশুদের খেলার মাঠ, সুন্দর সুন্দর রেস্টুরেন্ট, রেস্টুরেন্টের বাইরেও খোলামেলা বসার বিশাল জায়গা, টেলিফোনের বুথ, পড়ার জন্য বিশাল লাইব্রেরি, সব মিলিয়ে অসাধারণ এক জায়গা সময় কাটানোর জন্য। মানুষজনের মধ্যে যেন এক ধরনের সৌহার্দ্য, এক ধরনের আত্মিক বন্ধন আমি দেখেছি। যা আর অন্য কোথাও দেখিনি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও এক টুকরা শান্তির জায়গা।
সন্ধ্যায় এখানে লাইট এবং মিউজিক শো হয়। এছাড়াও রয়েছে অ্যাম্পিথিয়েটার, যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। আছে বেশ কয়েকটা আধুনিক ক্যাফেও।
আপনি যদি এই পর্কে যান তাহলে একটা বই আর এক কাপ টার্কিস চা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসে যাবেন। এখানে নির্বিগ্নে কাটিয়ে দিতে পারবেন একবেলা শান্তির সাথে। মনে হবে কী হবে এতো ব্যস্ততা দিয়ে! কয়েকদিনের এই ছোট্ট দুনিয়ায়, এতো হৈ চৈ, হট্টোগোল, লালসা, রিরিংসার বাইরেই না হয় কাটলো জীবনের একটা অংশ সহজ সরলতা নিয়ে।

কোনিয়া কালচার, কুলটুর পার্ক
কোনিয়াতে আপনি যেখানে যেখানে যাবেন
১. চাতালহোয়ুক (Catalhoyuk কোনিয়া থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে ৯০০০ বছরের পুরাতন ঐতিহ্য যা ২০১২ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
২. কারাতাই সিরামিক মিউজিয়াম।
৩. ইন্সে মিনারেসিমেদ্রেসে, ১৩ শতকের একটি মাদ্রাসা যেখানে বর্তমানে পাথর ও কাঠের শিল্প জাদুঘর অবস্থিত।
৪. ১৩ শতাব্দীতে তৈরি আলাউদ্দিন মসজিদ ও পার্ক যা সেলজুক শাসনামলে নির্মিত। কোনিয়াতে টিকে থাকা কয়েকটি সেলজুক সমজিদের মধ্যে এটি বৃহত্তম।
৫. সেলিমিয়ে মসজিদ যা ১৬ শতকে নির্মিত আটোমান সাম্রাজ্যের নিদর্শন।
৬. আজিজিয়া মসজিদ, যা মুস্তাফা পাশা তৈরি করেছিলেন। এটা মেভলানা ময়দানের সাথেই অবস্থিত।
৭. ট্রপিক্যাল বাটারফ্লাই গার্ডেন। একটি প্রজাপতির ঘর যা কোনিয়া প্রদেশের সেলকুকলু জেলায় অবস্থিত।
৮. কোনিয়ার সমৃদ্ধ আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রাচীন শহর চতালহোয়ুকের সারকোফাগি ও অন্যান্য পুরার্কীতি। মেভলানা ময়দান যা অটোমান সুলাতন সেলিম (২য়) তৈরি করেছিলেন ১৫৬৬-১৫৭৪ সালে, সন্ধ্যায় এই ময়দান আলোকসজ্জায় মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।
৯. কোনিয়া বাজার এবং ইয়ার্ন-মার্কেস মসজিদ (Iplikçi Cami) যা তৈরি হয়েছিলো ১২০১ সালে।
কোনিয়া আমার কাছে শুধু একটা শহর নয়, বরং একটা অনুভূতি। এখানে প্রতিটি ধুলো ইতিহাস, প্রতিটি বাতাসের কণায় মিশে আছে মওলানা জালালউদ্দিন রুমির ভালবাসা এবং মানুষের আন্তরিকতা।
রকিব রেজা: উন্নয়ন কর্মী।




























