
জুলাই পুনর্জাগরণ নাট্য উৎসব ২০২৫-এর আয়োজনে ৪ আগস্ট ২০২৫, সোমবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রযোজনা ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে উৎসারিত এক গভীর রাজনৈতিক ভাষ্য মঞ্চভাষায় প্রকাশ করেছেন নাট্যনির্দেশক ও শিক্ষক ড. সাইদুর রহমান লিপন । শোষণ, নিপীড়ন ও ক্ষমতার পালাবদলের রাজনীতির বিরুদ্ধে এই প্রতীকী স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন নজরুল সৈয়দ।
জর্জ অরওয়েলের কালজয়ী উপন্যাস ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’। অ্যানিম্যাল ফার্ম যদিও রুশ বিপ্লবের ওপর একটি ব্যাঙ্গাত্মক রচনা, কিন্তু এর আবেদন ব্যাপক ও বিশ্বজনীন। এটি কেবলমাত্র একটি উপন্যাস নয়, এটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে উৎসারিত এক বিশেষ রাজনৈতিক সাহসিকতার দলিল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষলগ্নে। টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে গত ১০০ বছরের গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি উপন্যাসের একটি হলো ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রাথমিক আদর্শ ছিল সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত, সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। লেনিনের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র উৎখাত করে শ্রমিক ও কৃষকদের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়। কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জোসেফ স্ট্যালিন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সেই প্রক্রিয়ায় লিওন ট্রটস্কির মতো বিপ্লবী নেতাদের বিতাড়িত করা হয়। এই সময়েই শুরু হয় গণগ্রেফতার, গোপন পুলিশি তৎপরতা, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, ও ইতিহাস বিকৃতি। যেখানে বিপ্লবের নামে একটি নিষ্ঠুর একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ঔপন্যাসিক এই বাস্তবতাকেই রূপকভাবে চিত্রিত করেছেন অ্যানিম্যাল ফার্মের খামারজীবনের মাধ্যমে। নাট্যনির্দেশক, নাট্যগবেষক ও শিক্ষক সাইদুর রহমান লিপন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জর্জ অরওয়েলের বিশ্বব্যাপী আলোচিত ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ উপন্যাসকে মঞ্চের আলোয় জীবন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

নাটকের শুরুতে দেখা যায়— ম্যানোর ফার্মের ক্রীতদাসতুল্য পশুরা অত্যাচারিত হয়ে দিন-রাত কাজ করছে। মানুষের নিয়মে চালিত খামারের চাপিয়ে দেয়া নিয়মের বাইরে বুনো প্রকৃতির মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে বাঁচার বাসনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় পশুরা। একদিন এই পশুরা তাদের খামার মালিক বদমেজাজি মদ্যপ মি. জোন্সের অত্যাচারের প্রতিবাদে বিদ্রোহ করে তাকে খামার থেকে বিতাড়িত করে। ঐক্যবদ্ধ পশুরা এরপর নিজেরা নিজেদের জন্য একটি নতুন শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। তারা খামারটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করে ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’। খামারে সকল পশু ও পাখিদের ‘সমান অধিকার’ ও ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পশুতন্ত্রের সাতটি মূলনীতি গ্রহণ করে। কিন্তু এই বিপ্লব ধীরে ধীরে বিভ্রান্তি আর হতাশায় রূপান্তরিত হয়। কেননা, জ্ঞানে বুদ্ধিতে উন্নত শুয়োরের দলের নেতা নেপোলিয়ন তার সতীর্থ সহযোদ্ধা স্লোবলকে অন্যায়ভাবে তাড়িয়ে ক্ষমতার দখল নিরঙ্কুশ করে এবং পুনরায় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। চক্রাকারে ফিরে আসে শোষণ-অত্যাচারের সেই আদি রূপ। একনায়ক নেপোলিয়ন “সকল পশু সমান, তবে কেউ কেউ অধিকতর সমান”- সংবিধানে এরূপ বিভ্রান্তিকর সংস্কার সাধন করে সাধারণ পশুদের জীবনে রাজনৈতিক প্রতারণায় নির্মম শোষণের রাজত্ব কায়েম করে। যেখানে শাষক শ্রেণি মানুষ ও শুয়োর এক হয়ে যায়। একটি পশুখামারের আদলে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল ও রাজনীতির স্বার্থসত্যকে উন্মোচিত করেছে নাটকটি। উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণের মাধ্যমে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাকে স্পর্শ করে অতিক্রম করেছে বর্তমান সময়কে।
জর্জ অরওয়েলের উপন্যাসের অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এই কাহিনিকে মঞ্চপ্রয়োগ ঘটানো চাট্টিখানি কথা নয়! নির্দেশক অত্যন্ত সচেতনভাবে স্টাইলাইজড অভিনয় মেথডে থিয়েট্রিক্যাল প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে অভিনেতাদের অসাধারণ মঞ্চচলনে গল্পটিকে সমসাময়িক করে মঞ্চে তুলে ধরেছেন। পশুতন্ত্রের নাট্যচরিত্রগুলো— ন্যাপোলিয়ন, স্নোবল, ওল্ড মেজর কিংবা বক্সার- এরা প্রত্যেকেই সরাসরি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বা ক্ষমতা শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। ওল্ড মেজর হচ্ছেন কার্ল মার্কস ও লেনিনের যৌথ প্রতিরূপ, যিনি আদর্শের বীজ বপন করেন কিন্তু তা বাস্তবায়নের আগেই মারা যান। স্নোবল হলেন ট্রটস্কির প্রতীক সাহসী, চিন্তাশীল, কিন্তু ক্ষমতার খেলায় পরাজিত। নেপোলিয়ন শোষক ও শাসক শ্রেণির কর্ণধার। ক্ষমতালোভীরা অন্ধের মতো ছোটে এই বিপ্লবের পেছনে এবং পরিণতিতে শুধু কর্তৃত্ব বদল হয়, সত্যিকারের সাম্য আসে না। পশুতন্ত্রের রাষ্ট্রকাঠামোর রূপক-সাংকেতিক ও প্রতীকী ব্যঞ্জনার মধ্যদিয়ে মানবসমাজের এই অন্ধকার চিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ নাটকে। মানুষের খোঁয়াড় থেকে বিপ্লব করে কেড়ে নিয়ে নেপোলিয়ন নামক এক দাঁতাল শুয়োর ক্ষমতায় বসেন এবং বাকি পশুগণ মুক্তির আশা খোঁজে। কিন্তু দাঁতাল নেপোলিয়ন এই পশুপাখিদের সাথে নতুন রাজনৈতিক কূটচালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। শুরু করেন পশুতন্ত্রের নতুন নিয়মে অন্যায়-অত্যাচার। প্রতিবিপ্লব ঘটার আশাংকায় অন্যান্য পশুকে হত্যা করতে থাকে ক্ষমতাসীন নেপোলিয়নরা।

শোষণ-নিপীড়নের চূড়ান্ত পরিণতি অনিবার্য বিপ্লব। ইতিহাসের নানান বাঁকে সারা পৃথিবীতে মানুষ অসংখ্যবার নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছে, আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে। কিন্তু সেই ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে রুশ বিপ্লব- সকল বিপ্লবের পরিণতিই এক- শুধুই ক্ষমতার হাতবদল। এককালের শোষিত শ্রেণি ক্ষমতার ভারে গিয়ে দাঁড়ায় সেই শোষকেরই কাতারে। ফলে শ্রেণির পরিবর্তন হয়, কিন্তু সাধারণেরা চিরকাল শোষিত, নিপীড়িত আর বঞ্চিতই থেকে যায়। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ মানুষের এই চিরকালীন বঞ্চনারই প্রতিরূপ। এটি সেই সময়ের জ্বলন্ত ইতিহাসের এক রূপক চিত্র, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। যতদিন ইতিহাসের নামে মিথ্যা নেরেটিভ লেখা হবে, যতদিন বিপ্লবের নামে জনগণকে ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হবে— ততদিন এই নাটকটি এক অনিবার্য সতর্কবার্তা হিসেবে ফিরে ফিরে আসবে। এই নাটক কোন নির্দিষ্ট সময়ের নাটক নয়, এই নাটক কালোত্তীর্ণ সময়ের, এই নাটক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা সব শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণ! সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই নাটকের ভাষা অত্যন্ত প্রসঙ্গিক। যখন শিল্পমাধ্যম বিক্রি হয়ে যায়, শিল্পকলা জিম্মি থাকে, বৃদ্ধিজীবীরা মাথা বন্ধক রাখেন, কবি-সাহিত্যিকগণ ফরমায়েসী লেখা লেখেন বা লেখা বন্ধ রাখেন, তখন মঞ্চের আলোয় ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ কথা বলে, সমকালীন রাজনীতিকে শিল্পের ভাষায় সাহসী প্রশ্ন করে!

রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রযোজনা ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ নাটকে অভিনয় করেছেন— মিস্টার জোন্স চরিত্রে মো. হাবিবুল্লাহ, মিস্টার পিল্কিংটন চরিত্রে আবির খান অন্তু, বুড়ো মেজর চরিত্রে আলফেয়ার্ড এলিশায় জয়, নেপোলিয়ন চরিত্রে সাইফুল ইসলাম, স্লোবল চরিত্রে মো. সজিব হোসেন, স্কুইলার চরিত্রে নাজিম উদ-দৌলা, মিনিমাস চরিত্রে প্রীতি সূত্রধর, বক্সার চরিত্রে পলক চক্রবর্তী, মুরিয়েল চরিত্রে রিফাত আরা জুঁই, মোজেস চরিত্রে মেহেদী হাসান, মলি চরিত্রে অদ্রিতা দাস, বেঞ্জামিন চরিত্রে সুমন মিয়া রানা, ক্লোভার চরিত্রে মাইশা মাসফিকা তানিসা, হোয়াইম্পার চরিত্রে আশরাফুর দৌলা সোহেল, কুকুর চরিত্রে মৃদুল জাহান, আল্লারাখা মেহেদী হাসান ও মো. রেজাউল করিম, মুরগি চরিত্রে শর্মী চাকমা ও মেমোরী চাকমা, ভেড়া চরিত্রে মীর তৌসিফ, কবুতর ও গরু চরিত্রে শানন কুমার দেবনাথ এবং গাধা চরিত্রে নাজমুল আহসান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস, ল্যাবওয়ার্ক, শ্রেণি অভীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রভৃতির চাপ সামলিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মহড়া করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়াই কঠিন ব্যাপার। শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও চূড়ান্ত পরীক্ষা বাস্তবতা জেনেও নির্দেশক বেছে নিয়েছেন এই ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। টানা মহড়ায়, নিষ্ঠা, আন্তরিকতায় পাণ্ডুলিপি আত্মস্থ করছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। প্রতিটি অভিনয়শিল্পীর একনিষ্ঠতা জানান দেয় যে তারা মহড়াকক্ষে রীতিমতো আরাধনা করেছেন। এই একাগ্রতার বিষয়টি অদৃশ্য ছায়াসঙ্গী হয়ে প্রযোজনায় প্রতিফলিত হয়েছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণে নাট্যনির্দেশক সাইদুর রহমান লিপনের গৃহিত মহাচ্যালেঞ্জটি সফলতা লাভ করেছে। অভিনেতাদের মঞ্চচলন, কোরিওগ্রাফি, মঞ্চব্যবহার, উচ্চারণ, প্রজেকশন বেশ প্রশংসার দাবী রাখে। কোরিওগ্রাফ করেছেন অমিত চৌধুরী ও হাসান ইশতিয়াক ইমরান।

মিলনায়তনে প্রবেশ করেই দর্শকের চোখে ধরা পড়ে বিশালায়তনের মঞ্চ, নীলাভ একটি স্থির চিত্রপট, তার সামনে কাঠের বেড়া, প্ল্যাটফর্ম, চট, খড় প্রভৃতি দিয়ে তৈরি পশুখামারের সাজেসটিভ সেট। সেট ও প্রপস পরিকল্পনা করেছেন আব্দুর রাজ্জাক; তিনি একই সঙ্গে সহযোগী নির্দেশক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সেট পরিকল্পনা ও নির্মাণ সহযোগী সমর কান্তি সিংহ সৌম্য। সাধারণ সব উপাদান ব্যবহার করে অসাধারণ একটি সেট পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটে ব্যবহৃত কাঠ, বেডা, খড়, সিঁড়ি, রঙ, রেখা ও উচু প্ল্যাটফর্ম পশুখামারের আবহ তৈরিতে দারুণভাবে কাজ করেছে। পুরো নাট্যপ্রবাহে বারংবার সেট পরিবর্তন ও সংযোজনের বিষয় নেই। জাতীয় নাট্যশালার মূল হলের প্রচলিত প্রোসেনিয়াম অভিনয়ভূমিকে মূলত পাঁচটি অ্যক্টিংস্পেস হিসেবে বিভাজন করা হয়েছে— মঞ্চের আপ-সেন্টার, সেন্টার পয়েন্ট, ডাইন রাইট, ডাইন সেন্টার ও ডাউন লেফট। মঞ্চক্যানভাসের অভিনয়স্থান চুয়ান্ন ফুট প্রস্থের ষাট ফুট ক্ষেত্রগভীরতা, আর উচ্চতায় আঠার ফুট। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ নাটকের চরিত্রের সহযোগী চরিত্র হিসেবে মঞ্চে আসে- স্পেস, কম্পোজিশন, সেট, লাইট, কস্টিউম, প্রপস ও আবহসঙ্গীত। গল্পের প্রয়োজনে এসব চরিত্রের সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি হয় নতুন নতুন দৃশ্যকাব্য। দর্শক চোখ মেলে উপন্যাসটি দেখতে থাকেন। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ প্রযোজনাটির মঞ্চায়ন কৌশল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময়ের নাটকটি চলে বিরতিহীন; ভীষণ গতিময়। ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্যকল্প তৈরি হয়, আবার নিমিষেই বদলে যায়। বেশ চমৎকার আলোক পরিকল্পনা করেছেন ধীমান চন্দ্র বর্মন। পশুখামারের আবহে প্রতিবেশ তৈরি, নাট্যঘটনার আবেগ, ভাব ও টেক্সশ্চার বিনির্মাণে আলোক রঙ ও প্রক্ষেপণ দারুণভাবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সেট লাইট ও দৃশ্য পরিবর্তনে আলোর চেঞ্জওভার গল্পকে এগিয়ে নিতে গতি প্রদান করেছে। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ নাটকের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো পোশাক পরিকল্পনা। এই নাটকের অ্যানিম্যাল ফার্মের মালিক ও তার বন্ধুজন বাদে বাকী সব চরিত্র পশু-প্রাণি। আর চরিত্রগুলো হলো— শূকর, গরু, ভেড়া, ঘোড়া, ছাগল,কাক, মুরগী, গাধা, কবুতর এসব নানা প্রকৃতির। পোশাক ও মুখোশ সমন্বয়ে দারুণ থিয়েট্রিক্যাল কস্টিউম ডিজাইন হয়েছে এই নাটকে। পোশাক পরিকল্পনা করেছেন মহসিনা আক্তার ও পরিকল্পনা সহযোগী— রানা তঞ্চঙ্গ্যা, মীর আয়েশা আক্তার, সারোয়ার জাহান উপল, প্রীতি সূত্রধর, শর্মী চাকমা মেমোরী চাকমা, আশরাফুর দৌলা সোহেল। অভিনেতাদের চরিত্রানুগ চলন, মুভমেন্ট, জেশ্চার, ও আচার আচরণে সহায়ক পোশাক দেখা গেছে মঞ্চে। প্রতিটি পশু-প্রাণির জন্য স্বতন্ত্র মুখোশ ছিল, মুখোশ পরিধান ও ব্যবহারের পদ্ধতিতে ছিল অভিনবত্ব। অভিনেতার মুখমণ্ডল না ঢেকে মাথার সাথে আটকে দেখার ফলে মুখোশ সংলাপ প্রক্ষেপণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি, তবে কোনো কোনো চরিত্র মুখোশের চরিত্র সুনিদিষ্টভাবে স্পষ্ট না থাকার ফলে দর্শক পরিস্কারভাবে চরিত্রকে চিহ্নায়ন করতে পারেননি। মাথার উপরে মুখোশ পরিধানের ফলে মুখোশের ছায়া অভিনেতার মুখমণ্ডলকে গভীরভাবে অন্ধকারে রেখেছে। মুখোশ পরিধানের সময় অভিনেতাকে আরো সতর্ক থাকতে হবে নচেৎ ক্রস-লাইট বৃদ্ধি করে অভিনেতার মুখমণ্ডলে পতিত মুখোশের ছায়া অপসারণের কৌশল বের করতে হবে। মুখোশ পরিকল্পনা ডিজাইন ও নির্মাণ করেছেন সোহায়েল রহমান উজান ও পলক দাস। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন অসীম কুমার নট্ট; সহযোগী ছিলেন মীর তৌসিফ ও নাজিম উদ-দৌলা।

আবহসংগীতে পশ্চাত্য সংগীতের ব্যবহার, মুড, পশুতন্ত্রের পাশবিকতা, চেঞ্জওভার মিউজিক বেশ সহায়তা করেছে নাট্যঘটনার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃজনের ভাবরস নিষ্পত্তিতে। তবে বেশ কিছু অভিনয়প্রধান স্থানে আবহসংগীত বেমানান লেগেছে, নিরবতাও যে প্রকৃতির অন্যতম সংগীত সে বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। সার্বক্ষণিক আবহসংগীতের শব্দ বজায় রেখে সংলাপকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয়। আবহসংগীত প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সংলাপের চেয়ে অধিক উচ্চতায় ভলিউমের পরিমিতি রাখতে হবে। যা এই প্রযোজনায় মিউজিক ও সংলাপের সিনক্রোনাইজেশনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রযোজনার নেপথ্যে যারা ছিলেন— মেকআপ- তন্ময়, পোস্টার ডিজাইন- সোহায়েল রহমান উজান, মঞ্চ ব্যবস্থাপক- সাইফুল ইসলাম, সহকারী মঞ্চ ব্যবস্থাপক- মেহেদী হাসান, প্রযোজনা ব্যবস্থাপক- নজরুল সৈয়দ। রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের একাডেমিক শিক্ষার্থী প্রযোজনা হলেও অভিনয় ও প্রযোজনার সার্বিক মান বিবেচনায় এই নাট্যপ্রযোজনা অত্যন্ত সুসংহত ও পেশাদার মানসম্পন্ন। তারুণ্যদীপ্তি এই নাট্যপ্রযোজনা বলে দেয় থিয়েটারে বদল এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাডেমিক নাট্যশিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এসেছে পরিবর্তন নাট্যপ্রযোজনায়! গতি এসেছে নাট্যভাবনা, নাট্যরূপরেখা, নাট্য উপস্থাপনের ধরণ-আদল, চিন্তা ও ভাষায়। এই শুভ্র পরিবর্তনের স্পর্শ লাগুক বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চায়। উদ্ভাসিত হোক নিমজ্জমান থিয়েটারের শিল্পযাত্রার আন্দোলন!
ড. ইসলাম শফিক: টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, শিল্প সমালোচক ও শিক্ষক।




























