সোমবার । ডিসেম্বর ৮, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ৭ অগাস্ট ২০২৫, ৫:৫৬ অপরাহ্ন
শেয়ার

জাদুর ঘোড়া ইউনিকর্ন: কল্পনা নাকি বাস্তবেও ছিল!


Unicorn cover

পৌরাণিক নানান কাহিনীতে আমরা পাই ইউনিকর্নের উপস্থিতি। কল্পনার সেই এক শিংয়ের ঘোড়া, তুমুল গতিসম্পন্ন অলৌকিক এক জীব। বাস্তবে তারা আছে, এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই, তবে প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় পাওয়া যায় তাদের উল্লেখ। প্রাচীন ভারত, সুমের, এসিরিয়া, ব্যাবিলন ও পারস্যের নানান শিল্পকর্মে, নকশায় ও দলিলে আমরা পাই এদের উল্লেখ। এই সভ্যতাগুলোর সংস্কৃতির সঙ্গে ছিলো কল্পনার সেই জাদুর ঘোড়ার সংযোগ। সেসব সভ্যতা সম্পর্ক জেনে নেয়া যাক একে একে।

হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সিলমোহর
ইউনিকর্নের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় গড়ে ওঠা সভ্যতায় সিলমোহরে দেখা মেলে ইউনিকর্নের। সিলমোহরগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ১৫০০ বছরের পুরনো। সেখানে ইউনিকর্নকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চমৎকার শৈলী ও নৈপুণ্যের সঙ্গে। স্বর্গের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিলো বলে মনে করা হয়। মহেঞ্জোদারোর ইন্ডাস উপত্যকায় পূজোর নৈবদ্য হিসেবে জ্বালানো আগরবাতি ও প্রদীপের গায়ে দেখা যায় ইউনিকর্নের মাথার ছবি।

মহেঞ্জোদারোয় ইউনিকর্নের সিল । ছবি: করাচি জাদুঘর

এদের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন মহাভারতেও। উচ্চৈঃশ্রবা নামে এক সাদা ঘোড়ার উল্লেখ আছে তাতে। সমুদ্রমন্থনের ফলে উত্থান ঘটেছিলো তার। ঘোড়াটির ছিলো একজোড়া ডানা, যাতে সে উড়তেও পারতো। এর সঙ্গে বৈশিষ্ট্যগত মিল পাওয়া যায় ইউনিকর্নের। এছাড়া, এখানে আছে অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা। মহাভারতের এমন বিভিন্ন রাজা ও যোদ্ধাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা কপালে এক শিং লাগিয়ে ঘোড়ার মতো দ্রুত গতিতে যুদ্ধ করতেন। গবেষক গৌতম বজ্রাচার্যের মতে, মহাভারতে ঘোড়ার শিং দিয়ে বিশেষ পানিপাত্র তৈরির যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা ইউনিকর্নের সঙ্গে মেলে।

সুমেরিয় সভ্যতায় ইউনিকর্ন

ইরাকের হিলায় স্থাপনায় ইউনিকর্ন । ছবি: সংগৃহীত

প্রাচীন ভারতের পাশাপাশি আমরা সুমেরিয় সভ্যতাতেও দেখা পাই ইউনিকর্নের। মেসোপটেমিয়ায় গড়ে ওঠা সবচেয়ে পুরনো সভ্যতা এটি। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে রয়েছে ইউনিকর্ন। পাথরে খোদাইকৃত সিল ও দেয়ালের গায়ে অঙ্কিত চিত্রে দেখা মেলে ইউনিকর্নের। বিশেষত সুমেরিয় সভ্যতার শহর উর (Ur)- এ আছে এমন অনেক নিদর্শন।

স্থাপনাগুলোর থামে দেখা যায় খোদাইকৃত ও অঙ্কিত ইউনিকর্নের ছবি। সময়ের হিসেবে যা খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালের। এমন একটি চিত্রে দেখা যায়, একদল সুমেরিয় মানুষ ইউনিকর্নদের সঙ্গে অবসর যাপন করছে। পাথরে খোদাই করা সিলেও দেখা যায় মানুষের সঙ্গে কৃষিকাজে যুক্ত আছে ইউনিকর্ন!

এসিরিয় সাম্রাজ্যে ইউনিকর্ন
এবার যাওয়া যাক প্রাচীন এসিরিয় সভ্যতায়। এখানকার শিল্পে, রাজকীয় অর্চনায় ও প্রতীকীকাজে হাজির ইউনিকর্ন। সাধারণ ও বিশেষায়িত সিলমোহর থেকে শুরু করে প্রাসাদের দেয়াল ও স্তম্ভে আমরা দেখতে পাই ইউনিকর্নের ছবি।

এসিরিয় সভ্যতার দেয়াল লিপিতে ইউনিকর্ন । ছবি: সংগৃহীত

সেসব জায়গায় ফুটে উঠেছে তাদের দৈনন্দিন জীবন ও পৌরাণিক কাহিনীর নানান ছবি। এর সঙ্গে কখনো কখনো দেখা যায় ট্রি অব লাইফ বা জীবনবৃক্ষকে। এর ফলে স্বর্গের সঙ্গেও সম্পর্কিত হয়ে ওঠে ইউনিকর্ন। এশারহাডন ও আশুরবানিপালে পাথুরে স্লাবে জীবনবৃক্ষের সঙ্গে দেখা মেলে ইউনিকর্নেরও।

এছাড়া এসিরিয় সভ্যতায় রাজাদের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে যে পতাকা প্রদর্শিত হতো, তাতেও থাকতো ইউনিকর্নের ছবি৷ এতে ইউনিকর্ন হয়ে উঠেছিলো তাদের কর্তৃত্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক৷ এসিরিয় সভ্যতার বিস্তৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা তৃতীয় শালমানিসার কালো এক উঁচু স্তম্ভ বানিয়েছিলেন, যার দেয়ালে ছিলো ইউনিকর্নের ছবি।

ব্যাবিলনের ইশতার গেট ও অন্যান্য

ব্যাবিলনের ইশতার গেটে অঙ্কিত ইউনিকর্ন । ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

এসিরিয় সভ্যতার পর এবার আসা যাক ব্যাবিলনে। এখানকার সভ্যতায় ও শিল্পকর্মে রয়েছে ইউনিকর্নের জোরালো উপস্থিতি। বিশেষত দেবি ইশতারের সঙ্গে আছে এর সম্পর্ক। ব্যাবিলনের সংস্কৃতিতে ইউনিকর্নের গুরুত্বের প্রমাণ ‘ইশতার গেট’ এ এর উপস্থিতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭৫ সালে রাজা দ্বিতীয় নেবুচাঁদনেজার এটি তৈরি করেন৷ এখানে চকচকে ইটের ওপর অঙ্কিত আছে ইউনিকর্নের ছবি।

পরবর্তীতে রাজা ডারিয়াস দ্য গ্রেট ও প্রথম জার্জিস প্রাসাদের সর্পিল থামগুলোর গায়ের নকশায় স্থান দেন ইউনিকর্নকে। ডারিয়াস তার কবর ফলকেও ইউনিকর্নের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। মনে করা হতো, এতে স্বর্গপ্রাপ্তি সহজ হবে।

এছাড়া, ব্যাবিলনে পাথরখন্ড ও মাটির স্থাপনাগুলোয় থাকা কিউনিফর্মের লেখনিতে উল্লেখ পাওয়া যায় ইউনিকর্নের। সে সময়ের একটি সিলমোহরে গৃহপালিত নানান প্রাণির সঙ্গে দেখা যায় একে। অন্যদের তুলনায় একে বড় করে দেখানো হয়েছে সেখানে।

পারস্য সভ্যতায়
পারস্য সভ্যতা একদিকে যেমন জাঁকজমকপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী, অন্যদিকে আধ্যাত্মবাদ ও শিল্পেও অনন্য৷ পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিলো ইউনিকর্ন।

পারস্যের সুসা মন্দিরের দেয়ালে অঙ্কিত ইউনিকর্ন, ছবি: সংগৃহীত

পারস্যের প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ এর দেয়ালে থাকা বেশকিছু নকশায় ইউনিকর্নের দেখা মেলে। পারস্যের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত ব্যক্তির অধীনে একে থাকতে দেখা যায়। এটি ভূমধ্যসাগর ও মেসিডোনিয়ান গ্রিস পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তারের চিহ্ন বহন করে। সুসা-য় থাকা মন্দিরের বাইরের দেয়ালেও এর উপস্থিতি দেখা যায়।

এমনকি পারস্যের সিংহাসন যে অলংকারখচিত চাদরে মুড়ে রাখা হতো, সেখানেও ছিলো ইউনিকর্নের ছবি।

সবশেষে
পৃথিবীর প্রভাবশালী পাঁচটি সভ্যতায় নানাভাবে উপস্থিতি রয়েছে ইউনিকর্নের। গ্রীক দার্শনিক টিসিয়াস তার ইন্ডিকা’য় প্রথম উল্লেখ করেন এর। একে ভারত অঞ্চলের প্রাণি হিসেবে ধরে নিলেও এর কথা তিনি জেনেছিলেন পারস্য থেকে। এর বাইরে সুমেরিয়, এসিরিয় ও ব্যাবলনিয় সভ্যতাতেও আছে এর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। বাস্তবের পৃথিবীতে নিছক কল্পনার বিষয় হয়ে রইলেও পৌরাণিক গল্পগাথা এবং প্রাচীন সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ইউনিকর্নের নাম।

তথ্যসূত্র: অ্যান্সিয়েন্ট অরিজিনস