রবিবার । ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় বিনোদন ১৪ অগাস্ট ২০২৫, ৪:৪১ অপরাহ্ন
শেয়ার

জন্মদিনে স্মরণ

জসিম: দি ‌‘অর্গানিক’ অ্যাকশন কিং


Jashim cover

জসিম (১৯৫০-১৯৯৮) ছবি: সংগৃহীত

সময়টা ১৯৭২ সাল। জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ (১৯৭৩) সিনেমার শুটিং চলছে। বেশ স্বাস্থ্যবান এক যুবক শুটিং দেখছেন। তিনি একপর্যায়ে নায়ক রাজ্জাক আর পরিচালক জহিরুল হককে বললেন যে, সিনেমার মারপিটের দৃশ্যগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বানানো, বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে না।

জহিরুল হক আগ্রহী হলেন। জানতে পারলেন যুবকের নাম আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন। ডাকনাম জসিম। বাড়ি ঢাকার নবাবপুরে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সে, বীর গেরিলা যোদ্ধা। যুদ্ধ থেকে ফিরে এখনো কোনো কাজে যুক্ত হয়নি। তবে খেলাধুলা করার অভিজ্ঞতা আছে।

জহিরুল হক তাকেই দায়িত্ব দিলেন সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যগুলো পরিচালনা করতে। জসিম নির্দেশনাও দিলেন ঠিকঠাক। জহিরুল হকের পছন্দ হলো।

jashim 2

এভাবেই জসিমের চলচ্চিত্রে পদার্পন। শুরুটা হয়েছিল ফিল্ম এক্সট্রা আর অ্যাকশন ডিরেক্টর হিসেবে। ছিলো তাদের পাঁচ বন্ধুর সম্মিলিত ‘জ্যাম্বস’ গ্রুপ। এই গ্রুপই পরিচালনা করত মারপিটের দৃশ্যগুলো।

পুরো লেখাটি অডিওতে শুনতে নিচে ক্লিক করুন
অডিও ফিচার জসিম: দি ‌‘অর্গানিক’ অ্যাকশন কিং

জসিম এরপর অভিনয়ে নিয়মিত হলেন। তখন তিনি খলঅভিনেতা। দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ (১৯৭৭) সিনেমাটি তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। এটি ছিলো রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ সিনেমার বাংলা রিমেক। ডাকাত সর্দার ‘গাফফার’ এর চরিত্রে তার অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়। তার এমন আরেকটি স্মরণীয় অভিনয় ছিলো ‘বারুদ’ (১৯৭৮) চলচ্চিত্রে। এটি ছিলো হলিউডের ‘দি গডফাদার’ অনুসরণে নির্মিত ছবি। এখানেও দেশীয় মেজাজে জসীমের অনবদ্য অভিনয়ের প্রমাণ মেলে। এরকমই আরেকটি স্মরণীয় খলঅভিনয় ছিলো ‘লাইলী মজনু’ (১৯৮৩) সিনেমায়। রাজ্জাকের সাথের সিকোয়েন্সে তিনি যেভাবে স্ক্রিন ডমিনেট করেছেন তা তাঁর অভিনয়ের শক্তিমত্ত্বার প্রমাণ।

jashim 1

অ্যাকশন দৃশ্যের শুটিংয়ে জসিম ।। ছবি: সংগৃহীত

তবে এইসময় থেকে জসিম খলচরিত্রের বাইরে ইতিবাচক চরিত্রেও অভিনয়ের চেষ্টা করছিলেন। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাফল্য আসে জহিরুল হকের ‘সারেন্ডার’ (১৯৮৭) সিনেমা দিয়ে। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা মেধাবী এক শিক্ষার্থী কীভাবে জড়িয়ে যায় অপরাধজগতের সঙ্গে, তা এখানে দক্ষতার সাথে তুলে এনেছেন পরিচালক জহিরুল হক। এই সিনেমায় কলম ফেলে দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেবার দৃশ্যে জসিম ছিলেন অনবদ্য।

জসিম এরপর থেকে বিভিন্ন সিনেমায় নায়কের কিংবা বড় ভাইয়ের চরিত্র করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে শাবানার সাথে তার জনপ্রিয় জুটি গড়ে ওঠে। এছাড়া, জাম্বু ও আহমেদ শরীফের সাথে তার নায়ক-খলনায়ক দ্বৈরথ ছিলো উপভোগ্য।

নব্বই দশকে জসিমের সিনেমাগুলোর ভেতর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় ‘কালিয়া।’ এই সিনেমায় আহমেদ শরীফের সাথে তার দ্বৈরথ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। গাঙ্গুয়াকে শায়েস্তা করার দৃশ্যে যে দুর্দান্ত অ্যাকশন তিনি দেখিয়েছিলেন, তা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অ্যাকশন সিকোয়েন্স। এছাড়াও আশি-নব্বই দশকে জনপ্রিয় অনেক সিনেমাতেই অভিনয় করেছেন তিনি।

জসিমের অ্যাকশন ও অভিনয় নিয়ে এবারে কিছু বলা যাক। তিনি মার্শাল আর্ট নির্ভর অ্যাকশন করতেন না। তার মারামারির ধরনটা ছিলো তীব্র ও হাতে হাতে। একেবারেই ন্যাচারাল ধাঁচে মারামারি। কিন্তু সেই মারামারিটাই এত জীবন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হতো যে, মনে হতো যেন সত্যি সত্যিই এটা ঘটছে! সহজ কথায়, জসীমের অ্যাকশন ছিলো একেবারেই ‘অর্গানিক’ অ্যাকশন।

জসিমের অভিনয়ে সংলাপগুলোকে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রক্ষেপণের একটা প্রবণতা ছিলো। তবে সেটা মেলোড্রামাটিক নয়। তার কণ্ঠে ও অভিব্যক্তিতে আবেগের প্রয়োগ ছিল যথাযথ। আবার খলঅভিনয়ে তিনি দক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলতেন কূটিলতা। এক্ষেত্রে অবশ্য গিমিক নয়, বরং তাঁর অভিনয় দক্ষতারই প্রাধান্য ছিলো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার অভিনীত চরিত্রগুলোর শ্রেণিগত অবস্থান। জসীম পর্দায় আবির্ভূত হতেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষদের প্রতিনিধি হিসেব। তিনি যখন ভিলেনদের শায়েস্তা করতেন, তখন পর্দায় তা দেখে আপামর জনতা পেত অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে মুক্তির স্বাদ।

জসিম জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট। বেঁচে থাকলে আজ ৭৫ বছর পূর্ণ করে ৭৬ এ পা রাখতেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মস্তিকে রক্তক্ষরণ (সেরিব্রাল স্ট্রোক)- এ আক্রান্ত হয়ে জসীম মারা যান।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ধারার প্রবর্তন, খলঅভিনয় ও চরিত্রাভিনয়ে অবদান জসিমকে স্মরণীয় করে রেখেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জসীম স্থায়ী আসন নিয়ে বেঁচে থাকবেন।