
সেলিম আল দীন বাঙলা নাটকের গৌড়জন। ক্ষণজন্মা এই শিল্পপুরুষ ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রয়াত হন। আজ ১৮ আগস্ট তাঁর ৭৬তম জয়ন্তী।
বাঙলা নাটকের বাঁকবদলের অন্যতম কারিগর সেলিম আল দীন।
ফ্ল্যাসব্যাকে আমরা একটি ক্লাসরুমের ঘটনা কল্পনা করি౼
সময়কাল ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বাংলা বিভাগ। বরেণ্য শিক্ষক অধ্যাপক মনীর চৌধুরী ক্লাস নিচ্ছেন। ক্লাসে তিনি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে কারা কবিতা লেখো?’’ ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন মহা-উৎসাহে দাঁড়ালেন, তারমধ্যে সেলিম আল দীনও ছিলেন।
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাদের বললেন౼‘‘তোমরা বেরিয়ে যাও’’।
সবাই হতবাক! কিন্তু মুনীর চৌধুরী স্যারের কথা বলে কথা। কোনো শব্দ না করে, সবাই মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে না বাড়াতেই তিনি তাদের বললেন౼‘‘বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের মতো কবি এসেছেন, আরও কত কবি আছে বিশ্বসাহিত্যে, কবির কোনো শেষ নেই, শেষ নেই কবিতারও। তোমাদের মধ্যে কে জোর দিয়ে বলতে পারবে যে, সে জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভাল কবিতা লিখতে পারবে? যদি না পার, তাহলে কেন কবিতা লেখা?”
স্যারের কথায় কেউ উত্তর দিলেন না, সবাই চুপ থাকলেন। তখন তিনি বললেন౼‘‘তবে যারা নাটক লিখতে চাও তারা থাকতে পার।’’
থেকে গেলেন সেলিম আল দীন, শুরু করলেন নিয়মিত নাটক লেখা।
সেই তরুণ সেলিম আল দীন পরবর্তীতে বাংলা নাটকের অবিসংবাদিত শিল্পপুরুষ!
সেলিম আল দীন বাঙলা ভাষার অন্যতম সেরা নাট্যকার, দেশ-বিদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ‘নাট্যকার’, নাট্যশিক্ষক’, ‘নাট্যাচার্য’, ‘নাট্যগবেষক’, ‘নাট্যনির্দেশক’, ‘নাটকের মহাকবি’ প্রভৃতি অভিধায় সমাদৃত। তবে এসব ছাপিয়ে তিনি বাংলা নাটকের শেকড় সন্ধানী শিল্পপুরুষ ও নাট্যতাত্ত্বিক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেছেন। সেলিম আল দীন গণযোগাযোগের প্রত্যেকটি মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় কাজ করেছেন। সাহিত্য-সাময়িকীতে কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর প্রেস মিডিয়ায় আত্মপ্রকাশ ঘটে। পর্যায়ক্রমে তিনি গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখা আত্মস্থ করেছিলেন। মুদ্রণ মাধ্যম থেকে শুরু করে বেতার, মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন প্রভৃতি মাধ্যম তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক উভয় মাধ্যমেই সেলিম আল দীন দাপটের সাথে বিচরণ করেছেন। বাংলাদেশের মিডিয়ায় সেলিম আল দীন একটি ‘আইকোনিক ব্র্যান্ডের’ নাম। একটি নাম যশস্বী হতে সময় লাগে, একটি নাম ব্র্যান্ড হতে গুণ লাগে। সেলিম আল দীন౼এর যশস্বী নাট্যকার হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর রয়েছে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি ও পথপরিক্রমা। এই প্রস্তুতি পরিক্রমায় সেলিম আল দীন এর সৃজনজীবনে টেলিভিশন মাধ্যমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এটা অনস্বীকার্য- টেলিভিশন মাধ্যম সেলিম আল দীন-কে নাট্যরচনার শিল্পভূমিতে শক্তপায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। টিভি নাটক লেখার পাশাপশি সেলিম আল দীন টেলিভিশনের নানাবিধ অনুষ্ঠানে তিনি আলোচক ও উপস্থাপক হিসেবে অংশ নিয়েছেন। তিনি পেশাজীবন শুরু করেছিলেন বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে, পরবর্তীতে যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও নাট্যরচনার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘মাত্রা’য় যুক্ত থেকে বহু টিভি বিজ্ঞাপনের কপি লিখেছেন প্রথিতযশা এই অধ্যাপক। গণযোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের শক্তিকে তিনি সবসময় গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং তিনি নিজেও প্রাধান্য পেয়েছিলেন। সেলিম আল দীন প্রতিটি নতুনকে গ্রহণ করতেন সীমাহীন আকর্ষণে। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের আধুনিকতাকে তিনি খুব দ্রুত আত্মস্থ করার মানসিকতা রাখতেন, করতেন গবেষণা, বিস্তর ভাবনা-চিন্তা করতেন এসব নিয়ে। সত্তরের দশকের নয়া-প্রযুক্তি টিভি মাধ্যমের জন্য তিনি অসাধারণ সব কনটেন্ট রচনা করেছেন। টেলিভিশন মাধ্যমে সেলিম আল দীন-এর তিন যুগের সম্পৃক্ততার কর্মপরিধি, তাঁর রচিত নাটক এবং অংশ নেয়া অনুষ্ঠানের আধেয় অন্বেষণ ও প্রামাণ্য তথ্যাদির মিথষ্ক্রিয়ায় বক্ষ্যমাণ পর্যালোচনা।
টিভি নাট্যরচনার পূর্বাপর
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন; রবীন্দ্রোত্তর কালের অন্যতম সেরা নাট্যকার! তিনি কেন সেরা? কীভাবে তিনি সেরা হলেন? এই সেরা হওয়ার জন্য তাঁকে কেমনতর উপায়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়েছে! এসব বিষয় নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন। নাটক রচনার প্রস্তুতি, স্পৃহা, অনুপ্রেরণা বা পরিস্ফুটনের প্রেক্ষাপট জানতে হলে౼ তরুণ সেলিম আল দীন౼এর বেড়ে ওঠা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, সেসময়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাঁর পঠন-পাঠন ও মানস গঠন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। আলোকপাত করা প্রয়োজন তদানীন্তন পাকিস্তানে টেলিভিশন আবির্ভাবেব সময়কাল ও প্রেক্ষাপট।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের ফলে দুটি স্ব-শাসিত দেশ ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দেশভাগের দুই বছর পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামে ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট, বৃহস্পতিবার সেলিম আল দীন জন্মগ্রহণ করেন। মাতা ফিরোজা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। প্রকৃত নাম মঈনউদ্দিন আহমেদ। পিতা মফিজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন কাস্টমস্ কর্মকর্তা, তাঁর এই চাকুরিতে তিন বছরের অধিক এক কর্মস্থলে অন্য স্থলে বদলীর বিধান ছিল। পিতার বদলী চাকুরির কারণে সেলিম আল দীন অনেকগুলো স্কুলে তাঁকে অধ্যয়ন করতে হয়েছে। হাতেখড়ি হয় ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানায়। কিছুদিন পর তিনি নিজগ্রাম সেনেরখিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এই বিদ্যালয়ে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। বাবার কর্মস্থল বদলির জন্য ১৯৫৮ সালে পরিবারের সাথে মৌলভীবাজার বড়লেখা স্থানান্তরিত হন, সেখানে তিনি সিংহগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর সেখান থেকে কিছুদিন পর স্থানান্তরিত হন কুড়িগ্রাম জেলায়, সেখানে গিয়ে ভর্তি হন উলিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে; এই বিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন করেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। পিতার পুনঃপুন কর্মস্থল বদলির কারণে সেলিম আল দীন౼এর কিছুদিন বিদ্যালয়পাঠ স্থগিত থাকে। এসময় তিনি পর্যায়ক্রমে অবস্থান করেন রংপুর ও লালমনিরহাটে। ১৯৬০ সালে তিনি নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাশ করে ফেনী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাশ করার পর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। এসময়কালে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি ছাত্র সংগঠন National Student Federation সংক্ষেপে NSF গড়ে তোলেন। আইয়ুব-মোনেম সমর্থিত এই ‘জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন’ (এন.এস.এফ.) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন স্বৈরশাসকের প্রতাপ নিয়ে পেশীশক্তির মহড়া করে বেড়ায়। বিরোধী মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও নির্যাতন করে নাজেহাল করে। তাদের রুমের বই-খাতা, বিছানাপত্র পুড়িয়ে দিয়ে হল ত্যাগে বাধ্য করতো। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এদের ঘৃণা করতো এবং ভয়ও পেতো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ছিল না কারো। নাট্যকার সেলিম আল দীন ঘঝঋ এর একাংশের রোষাণলে পড়েন। স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নকালীন বাধ্য হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের বাংলা বিভাগে ১৯৬৮ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে এমএ সম্পন্ন করেন।
বাঁকবদল ও লেখক জীবনের প্রারম্ভকাল
সেলিম আল দীন-এর লেখকজীবনের হাতেখড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরে পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে- তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমেদ౼এর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায়। উলিপুরে থাকাবস্থায় স্কুল শেষে বাবার অফিসে গিয়ে সেখানকার কাগজ-কলমে তিনি কবিতা লিখতেন ও ছবি আঁকতেন। পিতা মফিজ উদ্দিন আহমেদ পুত্র সেলিম আল দীন౼ কে উৎসাহ দেয়ার জন্য ‘কবি’, ‘কবি সাহেব’ বলে তাঁকে সম্বোধন করতেন। পিতার এই উৎসাহ-উদ্দীপনা সেলিম আল দীনের বালকমনে ভীষণভাবে রেখাপাত করে। পিতা কবি হওয়ার স্বপ্নবীজ বুনে দেন বাল্যকালে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমকাল পর্যন্ত সেলিম আল দীন কাব্যচর্চায় নিবিষ্ট থেকেছেন। ১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে তাঁর লেখা কবিতা ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার প্রকাশের জন্য পত্রিকাটির সম্পাদক কবি আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) এর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর অফিসে গিয়েছিলেন। কবি আহসান হাবীব౼ এর সঙ্গে আলাপের পর সেলিম আল দীন গদ্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। ‘কহনকথা’ গ্রন্থে সেলিম আল দীন লিখেছেন౼ ‘আমি কবি আহসান হাবীরের কাছে ঋণী। আমি তাঁর কাছে কবিতা নিয়ে যাওয়ার পর উনি বললেন, তোমরা সবাই কবিতা লেখ, গদ্য লেখ না কেন? তখন তিনি আমায় গদ্য লেখায় উৎসাহ দিলেন।’
সেলিম আল দীন শুরু করলেন প্রবন্ধ লেখার কাজ। আমেরিকার কালো মানুষদের নিয়ে লিখলেন ‘নিগ্রো সাহিত্য’। প্রকাশিত হলো ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে। টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজে ভর্তির পর, জীবনের এই বাঁকবদল সেলিম আল দীন এর জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে। করটিয়ায় এসে তিনি বিখ্যাত কবি রফিক আজাদ౼ এর সান্নিধ্য লাভ করেন। কবি রফিক আজাদ-এর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে সেলিম আল দীন প্রচুর বিদেশি গ্রন্থ পড়ার সুযোগ লাভ করেন। সেলিম আল দীন౼ এর কাব্যচর্চার চিন্তাকে নাট্যচিন্তায় রূপান্তরে কবি রফিক আজাদ অগ্রণী অবদান রয়েছে। সেলিম আল দীন দিনলিপি গ্রন্থে বিরিশিরি পর্ব ও কবি রফিক আজাদ শিরোনামে লিখেছেন౼ ‘রফিক আজাদকে কৈশোরে বাবা ডাকতাম। এই জন্য যে- বিশ্বসাহিত্যও প্রথম পাঠ তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে তিনি করটিয়ায় আমাকে তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থ থেকে প্রচুর বিদেশি লেখক পড়বার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমার কবিতা চর্চার নাট্য রূপান্তরে তাঁর ভূমিকা সর্বাগ্রগণ্য।’
‘মঞ্চনাটকের মহাকবি’ অভিধায় সিক্ত সেলিম আল দীন মঞ্চের জন্য নাটক রচনায় মনোনিবেশের পূর্বে তিনি বেতার ও টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখে জনপ্রিয়তা ও সুধিজনের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। টেলিভিশনে নাটক রচনার পূর্বে তিনি বেতার মাধ্যমের জন্য নাটক লিখেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন- ষাটের দশকে বেতার ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাধ্যম, আপামর জনগণের কাছে অতি আপন একটি মাধ্যম। বেতারের সম্প্রচার পরিধি ছিল দেশজুড়ে। সেসময় বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বেতারের সাপ্তাহিক নাটক। দেশসেরা সব নাট্যকারদের নাটক প্রচারিত হতো রেডিওতে। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে সেলিম আল দীন বেতার প্রযোজনার জন্য ‘বিপরীত তমসায়’ নাটকটি লেখেন। নাটকটি ১৯৬৯ সালে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। প্রথম নাটক প্রচারের পর ‘সেলিম আল দীন’ নামটি সকলের মাঝে আলোড়ন তৈরি করে।
টিভি নাটক লেখা : শুরু যেখান থেকে
ঢাকায় টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় পাকিস্তান শাষণামলে। ডিআইটি ভবনে স্থাপিত পাইলট টেলিভিশন স্টেশন। পাকিস্তান টেলিভিশন-ঢাকা কেন্দ্রের সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। এটি এক নব যুগের সূচনা। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের সাথে সঙ্গতি রেখে ঢাকায় শুরু হয় সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সম্প্রচার। ঢাকা ও পাশ্ববর্তী ১০ মাইল ব্যাসার্ধভূক্ত এলাকা টেলিভিশনের প্রচার পরিধির আওতায় ছিল। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ৫০০ সাদা-কালো ২০ ইঞ্চি টেলিভিশন সেট লটারির ভিত্তিতে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ রূপান্তরিত হলো টিভি দর্শকে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো। সোমবার সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ থাকতো। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানমালায় সংবাদ, সংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান ও একটি বিদেশি সিনেমা প্রচারিত হতো। সিনেমা ও বিজ্ঞাপন ছাড়া সেসময় সকল অনুষ্ঠান একটি মাত্র স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্র থেকে ঊর্দু ভাষায় অনুষ্ঠান নির্মাণের চাপ থাকা সত্ত্বেও ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রর সব অনুষ্ঠান বাংলা ভাষায় প্রচার করা হতো। এবিষয়ে স্টেশন ম্যানেজার জামিল চৌধুরীর সঙ্গে অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ কলিম শরাফী, প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনিরুল আলম ও অনুষ্ঠান প্রযোজক মুস্তাফা মনোয়ার প্রমূখ ব্যক্তিদের অগ্রণী ভূমিকা বাংলা ভাষা ও শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
টিভি বিনোদনের মান বৃদ্ধির জন্য অনুষ্ঠান বিভাগের সৃজনশীল প্রযোজকবৃন্দ ডিআইটি স্টুডিও থেকে সরাসরি নাটক প্রচার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথম নাটক প্রযোজনা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় মনিরুল আলম౼ কে। প্রযোজক মুনীর চৌধুরীর হাস্যরসাত্মক ‘একতলা দোতলা’ নাটকটি নির্বাচন করেন। টানা একমাস মহড়ার পর ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নাটকটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। ‘একতলা দোতলা’ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম নাটক। অভিনয় করেছিলেন౼ লিলি চৌধুরী, ডলি ইব্রাহিম, খন্দকার রফিকুল হক, রামেন্দু মজুমদার, ফরিদ আলী, রবিউল আলম ও ফেরদৌসী মজুমদার। এই নাটকটি ব্যাপকভাবে দর্শকপ্রিয়তার পর, প্রতি মাসে একটি করে নাটক প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দ্বিতীয় প্রযোজনা ছিল কবীর চৌধুরীর রূপান্তরিত হাসির নাটক ‘বাড়ী বিক্রি’। এর পরের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা- মুস্তাফা মনোয়ার౼এর ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’। শেক্সপিয়ারের টেমিং অব দ্য শ্রু’র অনুবাদ ও নাট্যরূপায়ন করেছিলেন মুনীর চৌধুরীর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা অবলম্বনে প্রচারিত হয়েছে ব্যথার দান ও বাঁধন হারা। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে প্রচারিত হয়েছে ‘গৃহদাহ’। দর্শক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ডিআইটি স্টুডিও থেকে প্রতি মাসে দুইটি ও বিশেষ দিবস থাকলে তিনটি নাটকও প্রচার করা হতো। উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো- ত্রিরত্ন, ঘরোয়া, আমাদের মাসুম, নতুন বাড়ী, দম্পতি, সত্যিই স্যেলুকাস। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রের নিদের্শে টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধে আদেশ জারি হয়। পাকিস্তান সরকারের রোষাণলে পতিত হবার ঝুঁকি নিয়েও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনী অবলম্বনে কংকাল, দৃষ্টিদান, হৈমন্তী নাটক প্রচারিত হয়েছে।
খ্যাতিমান সব সাহিত্যিক, কবি ও নাট্যকারগণ নতুন এই টিভি মাধ্যমে নাটক রচনায় ভীষণ আগ্রহী হতে দেখা যায়। যাঁদের পাণ্ডুলিপিতে টিভি নাটকের শুরুর কাল (১৯৬৫-১৯৭০) সমৃদ্ধ হয়েছিল তাঁরা হলেন౼ মুনীর চৌধুরী, নুরুল মোমেন, কবীর চৌধুরী, আফসার ইবনে শাইখ, সাইদ আহমেদ, ওবায়দুল হক, আনিস চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, নীলিমা ইব্রাহিম প্রমূখ। তাঁরা বাংলা লোকজ ঐতিহ্য এবং মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাপনকে বিষয়বস্তু করে নাটক লিখতেন। এছাড়াও বাংলাসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্র দু’টি নাটক ডিআইটি স্টুডিও থেকে প্রচার করা হয়ছিল। এসময়ের টেলিভিশনের নাট্যপ্রযোজনার মধ্যে জহির রায়হানের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘কতগুলো মৃত্যু’ ও উপন্যাস অবলম্বনে ‘আরেক ফাল্গুন’ উল্লেখযোগ্য।
টিভি নাটকের হাতেখড়ি
পাকিস্তান টেলিভিশন, ঢাকা কেন্দ্রে প্রচারিত নাট্যপ্রযোজনার বিষয় ও কারিগরী মান বেশ মনোগ্রাহী ছিল। তৎকালীন টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ দেশের দুই অংশের মধ্যে অনুষ্ঠান বিনিময় কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকা কেন্দ্রের নাটকগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের দর্শকের মাঝে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। পূর্ব ও পশ্চিম দুই অঞ্চলের দর্শক রুচি বিবেচনা করে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ টিভি নাটকের জন্য ভালো গল্প ও সেরা নাট্যকার প্রাপ্তির লক্ষ্যে পা-ুলিপি নির্বাচনে বেশ কয়েকটি ধাপের ব্যবস্থা করেন। টেলিভিশন নাট্যপ্রযোজনার এই বাস্তবতায় খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যকারদের উত্তরসূরি হিসেবে সেলিম আল দীন౼এর টিভি নাটকের হাতেখড়ি। ১৯৭০ সালে সেলিম আল দীন౼ এর লেখা নাটক টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত হয়। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি-একুশ। টেলিভিশনের সাথে তরুণ সেলিম আল দীন౼এর পরিচয় করিয়ে দেয়ার নেপথ্য কারিগর হলেন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সম্পাদক কবি আহসান হাবীব। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত সেলিম আল দীন౼ এর কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কবি আহসান হাবীব তরুণ সেলিম আল দীন౼ এর ক্ষুরধার লেখা ও ক্ষিপ্রতার জন্য বেশ পছন্দ করতেন। একদিন তিনি একটি চিরকুট লিখে সেলিম আল দীন౼ কে পাঠালেন টিভি প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরী সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেলিম আল দীন ডিআইটি ভবনে গিয়ে আতিকুল হক চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তার সদ্য প্রকাশিত ‘লিব্রিয়াম’ গল্পটি টিভি নাটক করার জন্য আতিকুল হক চৌধুরীর কাছে জমা দেন। গল্পটি পাঠ করার পর আতিকুল হক চৌধুরী তরুণ গল্পকারের লেখায় অভিভূত হন এবং টিভি নাটক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে গল্পের পূর্বতন ‘লিব্রিয়াম’ নামটি পরির্বতন করে রাখা হয় ‘ঘুম নেই’। আলাপনে সেলিম আল দীন শীর্ষক এক সাক্ষাতকারে নাট্যজন বিপ্লব বালার প্রশ্নের উত্তরে টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত নাটকের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সেলিম আল দীন বলেন౼টেলিভিশনে প্রথম নাটক লিখলাম ১৯৭০ সালে ‘ঘুম নেই’। একটা নাটক লিখেই সবার নজর কেড়েছিলাম। গোলাম মোস্তফা সাহেব পরদিন ডিআইটি-তে গিয়ে জানতে চাইলেন- এটা কে লিখেছে? মুনীর চৌধুরী স্যার বললেন, ভালো হয়েছে, তবে আরো ভালো লিখতে হবে। তখন আমার বয়স বেশ কম, ডিআইটি-তে চেক আনতে গেলাম, তখন আমাকে সন্দেহ করা হলো যে, আমিই প্রকৃত নাট্যকার কি-না। কারণ, আমার গোঁফ-দাড়িও তখন তেমনভাবে গজায় নি। পরে আতিকুল হক চৌধুরী গিয়ে উদ্ধার করলেন। আবদুল্লাহ আল মামুন প্রশ্ন শুরু করলেন, তুমি কী কী পড়েছো? আমি তখন বললাম, চেখভ, আন্যুই, সার্ত্র-এসব পড়েছি। তখন ওয়েস্টার্ন লেখকদের বই পড়া গৌরবের ব্যাপার ছিল…তখন আতিক ভাই বললেন যে, এটা ফলস্ লোক না, জেনুইন। ব্যস, পেয়ে গেলাম চেক। ৪৫০ টাকা পেয়েছিলাম।’
কবি রফিক আজাদ, কবি আহসান হাবীব, নাট্যকার ও শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ এই চারজন শিল্পশিক্ষক সেলিম আল দীন-কে নাট্যরচনা পথকে অনেকটা চিনিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নব নাট্যচর্চাধারার সূচনা ঘটে। সমগ্র দেশে নাটক মঞ্চায়নের জন্য দল গঠনের তাগিদ অনুভূত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে সেলিম আল দীন মঞ্চের জন্য নাটক লেখা শুরু করেন। বহুবচন এর প্রযোজনায় ১৯৭২ সালে তাঁর রচিত নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয়। নাটকের নাম ছিল ‘সর্পবিষয়ক গল্প’; নির্দেশনা দিয়েছিলেন আমিরুল হক চৌধুরী। এর কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ১৯৭২ সালে ২-১১ ডিসেম্বর আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে ছেলেদের সাতটি ও মেয়েদের দু’টি হল মিলে মোট নয়টি হল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। মুহসীন হলের নাটক সেলিম আল দীন রচিত ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করে। দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিল এসএম হলের নাটক আল-মনসুর রচিত ও নির্দেশিত ‘রোলার ও নিহত এলএমজি’। সকলের উৎসাহ উদ্দীপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা মিলে ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট ‘নাট্যচক্র’ নামে থিয়েটারের একটি দল তৈরি করেন। এই দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন౼ ম. হামিদ, সেলিম আল দীন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, সালেক খান, খ ম হারূন, আল মনসুর, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকি, মো. জাফর ইকবাল, রাইসুল ইসলাম আসাদ, এহ্সানউল্লাহ, আকতার কমল প্রমূখ। নাট্যদল বহুবচন ও নাট্যচক্র’র পর বাংলাদেশের নাট্যআন্দোলনের বাঁক পরিবর্তনের প্রয়োজনে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা থিয়েটার’। ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর সেলিম আল দীন মঞ্চনাটক লেখায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। পাশাপাশি তিনি বেতার ও টেলিভিশনের জন্যও অসাধারণ সব নাটক রচনা করেন।
টিভি নাটক রচনা ও সম্প্রচার কাল
সেলিম আল দীন এর তিন যুগের অধিক সময়ের লেখালেখির কর্মমূখর জীবনে টেলিভিশনের জন্য তিনি বহু নাটক লিখেছেন। সর্বপ্রথম নাটক প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে এবং তাঁর জীবদ্দশায় সর্বশেষ নাটক প্রচারিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। তাঁর বেশিরভাগ নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে। বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন সম্প্রচার অনুমোদনের পর জনপ্রিয়তার শীর্ষ থাকা ‘একুশে টেলিভিশন’, ‘চ্যানেল আই’ ও ‘এনটিভি’তে সেলিম আল দীন রচিত একক ও ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়েছে। রচনা ও সম্প্রচারের ধারাবাহিকতায় সেলিম আল দীন রচিত উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন নাটকগুলো হলো౼ ঘুম নেই (১৯৭০), নীল নীল যন্ত্রণা (১৯৭২), মশারি’৭৩ (১৯৭৩), মুনিরা মফস্বলে (১৯৭৪), অশ্রুত গান্ধার (১৯৭৫), শ্যামল ছায়ায় (১৯৭৬), শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য (১৯৭৭), হলুদ পাতার গান (১৯৭৭), নাতাশা বাদশার সংসার (১৯৭৬/৭৮), ওহ্ দেবদূত (১৯৭৯), মাছি (১৯৮০), রক্তের আঙ্গুরলতা (১৯৮০), মাঠের পর মাঠ (১৯৮২), গল্প নিয়ে গল্প (১৯৮২), একদিন একরাত্রি (১৯৮২), প্রজাপতি (১৯৮৩), ভাঙনের শব্দ শুনি (পনের পর্বের ধারাবাহিক -১৯৮২-৮৩), শেষ বংশধর (১৯৮৩), শয্যা (১৯৮২), লালমাটি কালোধোঁয়া (পনের পর্বের ধারাবাহিক ১৯৮২-৮৩), আততায়ী (মঞ্চনাটক ১৯৮৩), গ্রন্থিকগণ কহে (আট পর্বের ধারাবাহিক ১৯৯০-৯১), অনৃত রাত্রি (১৯৯৩), ছায়া শিকারী (নয় পর্বের ধারাবাহিক ১৯৯৪-৯৫), হিতঙ্কর (১৯৯৯), সাতশ সাতাত্তর (সাত পর্বের ধারাবাহিক, বিটিভি-১৯৯৯), ইচ্ছাপূরণ, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের নাট্যরূপ (ইটিভি-২০০১), রঙের মানুষ (এনটিভি-২০০৩), বসবাস (সাত পর্বের ধারাবাহিক, চ্যানেল আই), নকশী পাড়ের মানুষেরা (এনটিভি-২০০১), ক্ষমা (ছাব্বিশ পর্বের ধারাবাহিক, এনটিভি-২০০৬), নিঃস্বরা ভালোবাসা (বিটিভি-২০০৭), সেইতো এলে ফিরে (এনটিভি-২০০৭), আঁধারের দ্বীপ শলাকা, হীরাফুল (এইচআইভি সচেতনামূলক ধারাবাহিক, বিটিভি-২০০৭), আদিম আগুন জ্বলেছিল (২০০৭), হীরাফুল (এইচআইভি সচেতনামূলক ধারাবাহিক, বিটিভি-২০০৭)। টেলিভিশন নাটক- ওহ্ দেবদূত, রক্তের আঙ্গুরলতা, অশ্রুত গান্ধার, শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, ছায়া শিকারী, রঙের মানুষ, ক্ষমা বাংলাদেশের টিভি নাট্যপ্রযোজনায় তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা লাভ করে।
টিভি নাট্যপ্রযোজনা প্রসঙ্গে পর্যালোচনা
সেলিম আল দীন౼ এর লেখা নাটক স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী কালে টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সেলিম আল দীন౼ এর নাটকে সমৃদ্ধ হয়েছে। সত্তরের দশকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তিনি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছেন। পরবর্তীতে থিয়েটারে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়ায় তিনি টিভি নাটক রচনা থেকে মঞ্চনাটকে অধিক মনযোগী হন। সেলিম আল দীন রচিত নাটকের নির্দেশনা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বহু গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি হয়েছেন, পেয়েছেন তারকা খ্যাতি, সমৃদ্ধ হয়েছেন প্রযোজক বা নির্দেশকবৃন্দ। সেলিম আল দীন-এর উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রযোজনা প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হলো౼
ঘুম নেই (১৯৬৯)
সেলিম আল দীন রচিত প্রথম টেলিভিশন নাটক ‘ঘুম নেই’। ‘ঘুম নেই’ নাটকের পূর্বতন মূল নাম ছিল ‘লিব্রিয়াম’। রচনাকাল ১৯৬৯ সাল। টিভিতে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। এটি একটি ঘুমের ঔষধের নাম বিধায় প্রযোজক ‘লিব্রিয়াম’ নামটি পরির্বতন করেন। ৩০ মিনিট ব্যাপ্তির এই নাটকটি ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। প্রযোজনা করেছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশা নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে এই নাট্যকাহিনীতে। নাটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে এসেছে নৈঃসঙ্গ্য। নাটকের প্রধান চরিত্র শরীফ খান একটি ট্রেডিং কর্পোরেশনের হেড ক্লার্ক। ছেলের জ্বর, স্ত্রীর গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা, সংসারের খরচাপাতি নিয়ে টানাটানি এসব মানসিক চাপের কারণে নিদ্রাহীনতায় কাটছে। অফিসে জরুরি ও গোপনীয় চিঠি টাইপরত অবস্থায় একটা ফোন কল আসে তার কাছে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, সাঈদা ব্লাড প্রেসারে মারা গেছেন, তিনি যেন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যান। শরীফ বুঝতে পারেন ফোনকলটা ভুল নাম্বারে এসেছে, বিষয়টা তিনি অপরপ্রান্তের লোকটিকে জানিয়েও দেন। কিন্তু এর মধ্যে ওই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটার দুটো লাইন টাইপ করার সময় বাদ পড়ে যায়। ফলে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা তাকে ডেকে পাঠান ও বকাঝকা করেন। ওদিকে সহকর্মী আফজাল সাহেবের সঙ্গে খেলা দেখতে যাওয়ার কথা দুপুরের পর। ছুটি চেয়ে তিনি দরখাস্ত দিয়েছিলেন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার কাছে, কিন্তু ছুটি মঞ্জুর হয় নি। তাকে ডেকে নিয়ে তিনি ধমক দিয়ে বললেন, এ রকম দরখাস্ত আর কখনো যেন তিনি না করেন। শরীফ খান খুব ভালো করেই বুঝতে পারেন, দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ গত কয়েকদিনের টানা নির্ঘুমতা আর ওই অদ্ভুত ফোন কলটাই এই ভুলের জন্য দায়ী। তিনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, সহকর্মী আফজাল সাহেবের কাছেও বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। বিষয়টি স্ত্রীর কাছে বলতে গেলে তিনি চলে যান ভিন্ন প্রসঙ্গে, কন্যার কাছেও বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। এরপর তিনি চলে যান পার্কে। পার্কের এক অচেনা মহিলার কাছে কথাটা বলেন, কিন্তু মহিলার অফিসিয়াল ব্যস্ততার কারণে তার কাছেও বিষয়টি তাৎপর্যহীন হয়। শেষ পর্যন্ত শরীফ সাহেব ডাক্তারের শরণাগত হয়েছেন। ডাক্তার সাহেব তাকে এমন একটা ঘুমের ওষুধ লিখে দেন, যেটা খেলে খোকার কান্না কিংবা স্ত্রীর চিৎকার কিছুই তার ঘুমের শান্তি নষ্ট করতে পারবে না।
শরীফ সাহেব ও ডাক্তারের সংলাপে বিষয়টি স্পষ্ট : শরীফ: তীব্র আবেগে। কী করে বোঝাবো ডাক্তার আমি কি করে বোঝাবো। এ মুহূর্তে আমার যে কী ভীষণ ইচ্ছা করছে একা থাকতে আমি একা থাকতে চাই, লিসা ও খোকা সবার কাছ থেকে। কেননা আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই, ফুটবল খেলা না দেখার দুঃখ, কিংবা চিঠির ভুল আর এক্সপ্লেনেশনের ভয়ের জন্য কারও সহানুভূতি আমার চাই না ডাক্তার।আমি একটু ঘুমাতে চাই।
ডাক্তার: একটা ওষুধ দিচ্ছি। এখুনি খেয়ে নেবেন।
শরীফ সাহেব ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাত্র পনেরো টাকা দিয়ে সুগারকোটেড মিষ্টি ড্রাগ লিব্রিয়াম কিনে নিয়ে যান। আনন্দিত চিত্তে ভাবছেন, সত্যি তাহলে আজ ঘুমাতে পারবো। মূলত শরীফ খানের এই নিঃসঙ্গতাই নাটকের প্রাণ। টিভি নাট্যপ্রযোজনা ‘ঘুম নেই’ এর মুল পা-ুলিপি ‘লিব্রিয়াম’ সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-১ এর নাটক হিসেবে সংকলিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে সেলিম আল দীন তাঁর মায়ের আদেশে সশস্ত্র সংগ্রামে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া, একিনপুর সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্যাম্পে তিনি ছিলেন। সহযোদ্ধারা তাঁকে যুদ্ধের ময়দানে না গিয়ে ক্যাম্পে থেকে নাটক-কবিতা লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।’ স্বাধীনতা লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশ, মানুষ ও মাটি নিয়ে সেলিম আল দীনের পূর্বেকার ভাবনাগুলোতে ভাঙচুর ঘটে। গণহত্যা আর পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নতুন এক আত্মপ্রত্যয় আবিষ্কার করেন। ১৯৭২ সালে লেখেন ‘নীল শয়তান : তাহিতি ইত্যাদি’।
নীল নীল যন্ত্রণা (১৯৭২)
স্বাধীনতার পর টেলিভিশনে সেলিম আল দীন౼ এর লেখা নাটক ‘নীল শয়তান: তাহিতি ইত্যাদি’ অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘নীল নীল যন্ত্রণা’। ১৯৭২ সালে বিটিভি’তে প্রচারিত ‘নীল নীল যন্ত্রণা’ তাঁর দ্বিতীয় নাটক, এটির প্রযোজকও ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। সেলিম আল দীন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্বাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র। এই নাটকটি প্রচার তারিখের পূর্বেরদিন সেলিম আল দীন౼ এর সরাসরি শিক্ষক অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ এর শ্রেণিকক্ষের একটি স্মৃতিময় ঘটনা তাঁকে নাট্যপথে অগ্রগামী হতে ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছিল౼
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ক্লাসরুম। ক্লাস নেবেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। ক্লাস শুরু হল। একেবারে পিনপতন নীরবতা। শুরুতে কয়েকজনকে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন করলেন তিনি, বেশির ভাগই তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারল না। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা তো কোন লেখাপড়া করনি, কোনকিছু জান না।’ কথাটা একটি তরুণের মনে খুব লেগেছিল, নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। শেষে বলেই ফেললেন, ‘আমি স্কুল-কলেজে থাকতে যা পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পড়েছেন কিনা সন্দেহ।” তরুণটির কথাটার পিছনে জোর ছিল। প্রমাণও ছিল। লিখেছিলেন ‘আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষার গল্প। তিনি আহমদ শরীফকে সেদিনই জানালেন, তিনি নাটক লেখেন, পরদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর লেখা একটি নাটক প্রচারিত হবে। তাঁর বিশ্বাস, এরকম নাটক এর আগে খুব একটা হয়নি। কথাটি বলেই তাঁর মনে হল, সর্বনাশ! কার সামনে কী বললেন তিনি। এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন। পরের দিন বন্ধুরা তাঁকে বললেন, ‘শরীফ স্যার তোকে খুঁজছেন। এখনই দেখা করে আয়।’ শুনে আমর্ম কেঁপে উঠেছিলেন তরুণটি। কাঁপা কাঁপা বুকে অধ্যাপক আহমদ শরীফের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন তিনি। ভেতরে কাজ করছিলেন অধ্যাপক শরীফ, সালাম শুনে মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘তোমার নাটক দেখলাম। তোমার অহংকার স্বার্থক।’ বলে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। তরুণটি এক মূহূর্ত দেরি না করে ছুটতে শুরু করলেন। আর ছুটতে ছুটতে একটা বড় বাজিতে জিতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে বন্ধুদের এসে বললেন, ‘শরীফ স্যার নাটক দেখেছেন, স্যার বলেছেন, আমার অহংকার স্বার্থক হয়েছে।’
মুনিরা মফস্বলে (১৯৭৩)
সেলিম আল দীনের ‘মুনিরা মফস্বলে’ নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭৩ সালে সম্প্রচারিত হয়। মুনিরা মফস্বল কলেজের আই.এ. ক্লাসের ছাত্রী। বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, কলেজে যাওয়া আসার মধ্যে বাংলা সিনেমা দেখে তার ভালোভাবেই দিনগুলো কাটছিল। হঠাৎ একদিন মুনিরা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তার কিছুই ভালোলাগে না। নিয়মিত কলেজে যায় না, মাঝে মধ্যে তার মাকে সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করে। মুনিরার বান্ধবী ফরিদার বিয়ে হয়েছে, সে ঢাকায় থাকে। মুনিরাও স্বপ্ন সেও ঢাকা যাবে একদিন। এই মফস্বল শহরে নয়, সে মহানগরীতে যেতে চায়। এ শহর তার ভালোলাগে না। তার খালাতো ভাই মীরন মেরিন বায়োলজিস্ট। মীরনের কাছে মুনিরা তার ভালোলাগার বিষয়টি প্রকাশ করে। মীরনকে তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে: ‘আমার গল্পের বই পড়তে ভালোলাগে। সমুদ্রের গল্প। জানেন সমুদ্র দেখার আমার ভারি সাধ। সমুদ্রের ঢেউ শব্দ চিন্তা করতেই ভালো লাগে।’ মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মুনিরার মধ্যে পরিবর্তন আসে। সে ভাবছে সমুদ্র নিয়ে, যেন ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের তলে ডুবুরিদের মতো। তার চোখের সামনে যেন প্রবল পাথর পান্না আর শৈবালের ঘর কিংবা উদ্দাম হাওয়ার সমুদ্র সৈকত। মীরন ইংল্যান্ডে চলে যায় ফলে মুনিরার স্বপ্ন পূরণ হয় না। মুনিরা চায় সুদূরের হাতছানি, ঝলমলে ঢাকার শহর, সমুদ্রের নীল ঢেউ। মুনিরার রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনার মধ্য দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি। হালকা-সরস পারিবারিক স্নেহ-মমতার কাহিনি নিয়ে মূলত নাটকটি রচিত। এই নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। ‘মুনিরা মফস্বলে’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-১ এ সংকলিত হয়েছে।
অশ্রুত গান্ধার (১৯৭৫)
সেলিম আল দীন রচিত ‘অশ্রুত গান্ধার’ নাটকটি ১৯৭৫ সালের ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। অশ্রুত গান্ধার নাটকে রয়েছে যুগলের প্রণয়কাহিনি। নীলু বড় লোকের মেয়ে, ভালোবেসেছে জুবেরকে। নীলুর ঘরে সৎ মা, তিনি নীলুকে দ্রুত পাত্রস্থ করতে চান। তবে তিনি জুবেরকে পছন্দ করেন না। বেকার জুবের সংস্কৃতিমনা, নাট্যামোদী এবং শিল্পের অনুরক্ত। নীলুর অমতে বিয়ে হয় সাঈদ নামক চামড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সাঈদ কালোবাজারি, সে মজুদদারি করে। তার বন্ধুদের নিয়ে সে মদ খায়, জুয়া খেলে। সুন্দরবনের হরিণের চামড়ার শোপিস সে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। নীলু খুব সংগীত প্রিয়। তবে তার স্বামী সংগীতানুরাগী নয়। সাঈদ জীবনে নাটক দেখে নি, গানের আসরে যায় নি। তার কাছে গোলাপের গন্ধের চেয়ে ট্যানারির গন্ধ অনেক ভালো। সংগীত থেকে নীলুকে উন্মূলিত করা হয়। শেষপর্যন্ত নীলু অসুস্থ হয়ে যায়। জুবেরেরও অনিদ্রায় কাটে দিন। তার বিদেশে যাওয়া হয় না। তাদের প্রণয় পরিণত রূপ লাভ করে নি। সামাজিক, পারিবারিক নিয়মরীতির বেড়াজালে জড়িত দুটি জীবন নষ্ট হয়। যুব সমাজের বেকারত্ব ও হতাশার দিকটি এখানে যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি কালোবাজারির প্রসঙ্গও এসেছে অশ্রুত গান্ধার নাটকে। আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজিত ‘অশ্রুত গান্ধার’ নাটকটি সেলিম আল দীন౼ কে টিভি নাট্যকার হিসেবে সাধারণ দর্শকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন শম্পা রেজা। ‘অশ্রুত গান্ধার’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-১ এ সংকলিত হয়েছে।
শ্যামল ছায়ায় (১৯৭৫)
সেলিম আল দীন টেলিভিশনের জন্য ১৯৭৫ সালে রচনা করেন শ্যামল ছায়ায় নাটকটি। টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ২১ মার্চ ১৯৭৬ সালে। একটি নিম্নববিত্ত পরিবারের কাহিনি নিয়ে নাটকটি রচিত। এদেশের মানুষের অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা, অস্তিত্বের সংকট প্রভৃতি বিষয়গুলো নাটকে উঠে এসেছে। বৃদ্ধ আশরাফ সাহেব আপার ডিভিশন ক্লার্ক ছিলেন। যথাসময়ে অবসরে গেছেন। মনির ও লাবণী তাদের দুই সন্তান। তারা অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠে শৈশব থেকে। আশরাফ সাহেব সৎ কর্মচারী ছিলেন। চাকুরি শেষে প্রাপ্ত ত্রিশ হাজার টাকা তার শেষ সম্বল। এক টুকরো জমি কেনার জন্য চেষ্টা করছেন। মেয়ে লাবণী আর্ট কলেজে পড়ে। এক সময় ভালবাসতো আসাদকে। কিন্তু আসাদের সঙ্গে তার ভালবাসা স্থায়িত্ব লাভ করে নি। শেষপর্যন্ত লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং সে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে সময় কাটায়। অপর দিকে আশরাফ সাহেবের ছেলে মনির বাসা ছেড়ে হলে থাকে। সংসারের অভাব, অনটন তার ভালো লাগে না। হতাশাই তার একমাত্র সঙ্গী। সে নেশা করে, জুয়া খেলে। শেষে মায়ের গলার চেন চুরি করে একটি সাইকেল কিনে বিশ্ব ভ্রমণে যেতে যায়। মূলত অসহায় নিরুপায় আশরাফ সাহেবের আর্থিক সংকট যেমন এখানে উঠে এসেছে, তেমনি স্বাধীনতা-পরবর্তী এদেশের যুব সমাজের হতাশা, বেকারত্ব এবং পথ-ভ্রষ্টতার দিকও খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে শ্যামল ছায়ায় নাটকে।
শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য (১৯৭৭)
মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ নাটকটি বিটিভি’তে ১৯৭৭ সালে প্রচারিত হয়। সেলিম আল দীন রচিত এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন-দিলশাদ খানম, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী ও আলেয়া ফেরদৌসী। ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ নাট্যপাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা হয়নি। সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-এ এই নাটকের পাণ্ডুলিপি নেই। নাট্যকার সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-২ এর ভূমিকা’য় উল্লেখে করেছেন- ঊনিশশ সাতাত্তর সালের লেখা౼ হলুদ পাতার গান, শিকড় কাঁদে জলকণার জন্য প্রভৃতি নাটকের পাণ্ডুলিপি বোধ হয় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ওহ্ দেবদূত (১৯৭৯)
১৯৭৯ সালে টেলিভিশনের জন্য সেলিম আল দীন রচনা করেন ‘ওহ্ দেবদূত’ নাটকটি। নাটকটির প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। নাটকে অভিনয় করেছিলেন- আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, আসাদুজ্জামান নূর ও মিতা চৌধুরী। পাণ্ডুলিপির চরিত্রগুলো হলো౼ রুক্কু, জামিল, লোপা, অনুপম, চিনুর মা, জুবায়ের, জামিল, ফারুক প্রমুখ।
একজন মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ সে মনে করে, পৃথিবীতে তার কোনো সাফল্যই নেই। পুরোপুরি সে ব্যর্থ। তাঁর সামনে হাজির হয় দেবদূত। জানতে চায়, কেন সে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে? দেবদূত অলৌকিক ক্ষমতায় লোকটির সব প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। লোকটি সফল হয়। কিন্তু পৃথিবীর নানা জটিলতায় আটকে পড়ে দেবদূত নিজেই। মানুষের পৃতিবীতে দৈব এসে আটকা পড়ে জীবনের জটিলতর জালে। ভিন্ন গ্রহ থেকে যে এসেছিল- সে লোপার কাছে রেখে গেছে তার অন্তরের ক্ষরণ চিহ্নরূপে। একটা হীরার আঙটি। হয়তো দেবদূত চিনুর জন্যে দিতে পারতো এক সুখপ্রদ শয্যা, ভালোবাসার অপূর্ব পরিণাম। কিন্তু সে হয় না। যে প্রেম সমুদ্রে গড়াবে তাকে পাহাড়ে বাঁধবে কে। রুক্কু তার একাকী শয্যায় বিড় বিড় করে- ও দেবদূত, দেখেছ তো মানুষের রক্তমাংসের শরীরে কোন দুঃখ কোন কষ্টের বীজ কীভাবে গাঁথা আর তা থেকে কী সব ডালপালা গজায়।
‘ওহ্ দেবদূত’ নাটকে আফজাল-সুবর্ণা জুটির অভিনয়ে দর্শক মুগ্ধ হয়। অভিনয়ের জুটি রসায়নে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই জুটি। আফজাল-সুবর্ণা বাংলাদেশের টিভি নাটকের সবচেয়ে সফল জুটি হওয়ার পেছনে এই নাটকের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ‘ওহ্ দেবদূত’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-২ এ সংকলিত হয়েছে।
রক্তের আঙ্গুরলতা (১৯৭৬)
সেলিম আল দীন౼ এর লেখা ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ নাটক প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। নাটকটির নামকরণ করেছিলেন চিত্রশিল্পী ও অভিনেতা আফজাল হোসেন। গল্পে ঠাঁই পেয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের এক তরুণের গল্প, যে ভীষণ জেদি। গল্পটা পুরোপুরি প্রেমের। প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেন- আফজাল হোসেন ও সুবর্ণা মুস্তাফা। এই নাটকে আফজাল-সুবর্ণা জুটির অভিনয় রসায়ন টেলিভিশনে ভিন্ন মাত্র যোগ করে। অভিনেতা আফজাল হোসেনের জন্য এই নাটকটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ টেলিভিশন নাটকে আফজাল হোসেন টিভি অভিনয়ে নিয়ে আসেন নতুন ধারা, নতুন ভাবনা। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ টিভি নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-১ এ সংকলিত হয়েছে।
শেষ বংশধর (১৯৭৯)
সেলিম আল দীন ১৯৭৯ সালে রচনা করেন ‘শেষ বংশধর’। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ‘শেষ বংশধর’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন- রাইসুল ইসলাম আসাদ, ক্যামেলিয়া মুস্তাফা ও হুমায়ুন ফরিদী প্রমুখ। ভৌতিক বিশ্বাসের দোলাচলে নাটকের গল্প বুনন করা হয়েছে। গ্রাফিক ছাড়া সে সময়ে ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু প্রযোজনা দলের সকলের আন্তরিক আগ্রহে ও অভিনয় শিল্পীদের অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় নাটকটি প্রচারিত হওয়ার সময়েই টিভি ভবনে ফোন আসা শুরু হয়েছিল౼ “কি দেখাচ্ছেন, আপনারা এধরনের ভয়ের নাটক দেখালে রাতে ঘুমাবো কি করে”। ‘শেষ বংশধর’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-২ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
আয়না সিরিজ (১৯৮২)
প্রযোজক ছিলেন নাসির উদ্দিন ইফসুফ নাট্যকার সেলিম আল দীন౼এর লেখা বেশ কয়েকটি নাটক প্রযোজনা করেছেন। ১৯৮২ সালে নাট্যধারা ‘আয়না’ নির্মিত হয়; কয়েকটি খণ্ড নাটকে প্রচারিত হয় ‘আয়না’ সিরিজ। কিন্তু আয়না সিরিজটি দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। প্রযোজক নাসির উদ্দিন ইউসুফ তাঁর লেখা স্মৃতিময় দশটি বছর নিবন্ধে অকপটে স্বীকার করেছেন টিভিতে কয়েকটি খণ্ড নাটক ‘আয়না’ শিরোনামে প্রচারিত হলো এবং ফলাফল স্মরণকালের বৃহত্তম ফ্লপ। মনমেজাজ খারাপ। নাট্যকার সেলিম আল দীন౼ এর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর প্রচণ্ড জেদ নিয়ে তৈরি করা হলো ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’।
ভাঙনের শব্দ শুনি (১৯৮৩)
সেলিম আল দীন রচিত বিটিভি ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’। ১৯৮৩ সালে নির্মিত এই নাটকের প্রযোজক ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ১৫ পর্বে নাটকটির সম্প্রচার সমাপ্ত হয়েছিল। নাট্যকাহিনীতে সূক্ষ্মভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষক শ্রেণি ও শোষিতের চিত্র আবহমান বাংলার জনপদের প্রেক্ষাপটে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। এদেশের নদ-নদী অনবরত তাদের স্রোতধারাগুলি পরিবর্তিত করে সময়ে সময়ে অনেক সভ্যতা গড়ে তুলেছে। নদী ভাঙনে সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা, ভাঙ্গাগড়া, প্রেম-ভালোবাসা, জীবনসংগ্রাম এবং এসবের বিপরীতে ভুমিদস্যুদের শোষণের গল্প এই নাটকের মূল আধেয়। এই নদীবিধৌত জনপদ ভাঙা-গড়ার, তেমনী এখানে বসবাসরত মানুষের গল্পও ভাঙা-গড়ার। গ্রাম্য মাতুব্বর সেরাজ তালুকদার লেবাসের আড়ালে একজন ক্ষমতাধর শোষক। গ্রামের সাধারণ মানুষ শরাফত, ফুলন, জমিলা, শেরালীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা আর অভাব-অনটনের সাথে লড়াইয়ের পাশাপাশি টিকে থাকার ভিন্ন লড়াই করতে হয় গ্রাম্য মাতুব্বর সেরাজ তালুকদারদের সাথে। দুধের সাথে অচেতনতার ঔষধ মিশিয়ে শরাফত আদর যত্ন করে খায়ানো হয়। প্রতারণার মাধ্যমে দলিলে টিপসই নিয়ে ভিটেমাটির জমি সেরাজ তালুকদার নিজের করে নেয়। লড়াইয়ে টিকতে না পেরে পাগলপ্রায় শরাফত আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
কালজয়ী এই ধারাবাহিক নাটকের বিভিন্ন চরিত্র রূপায়ন করেন : শরাফত- আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফুলন- ফেরদৌসী মজুমদার, জমিলা-সুবর্ণা মুস্তাফা, সেরাজ তালুকদার- হুমায়ুন ফরিদী, শেরালী- জহির উদ্দীন পিয়ার, বৃদ্ধ- ফরীদ আলী, ডাবলু আনোয়ার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, বাবুল আহমেদ ও মেহেদী আল আমীন। এই নাটকে সেরাজ তালুকদার চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদী অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় পরিচয় দেন। নাটকের প্রযোজক নাসির উদ্দিন ইউসুফ ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর স্মরক গ্রন্থে তাঁর ‘স্মৃতিময় দশটি বছর’ লেখা স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন౼ ‘এই নাটকে অভিনয়ের মধ্যদিয়া হুমায়ুন ফরিদী অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। জহির উদ্দীন পিয়ার ও ডাবলু আনোয়ারও বেশ দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছিলেন ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন।’ হুমায়ুন ফরিদী শোষক শ্রেণির প্রতিভূ হিসেবে সেরাজ তালুকদার চরিত্রে টুপি-পাঞ্জাবীর খোলসে শয়তানের জীবন্ত মূর্তি রূপে চরিত্রটিকে পর্দায় তুলে আনেন। সেরাজ তালুকদার নাট্যসংলাপ, ‘আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’ কিংবা ‘দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান’- আশির দশকে টিভি দর্শকের মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো।
ইতিহাস সত্য হলো౼ সম্প্রচারকালীন যখন নাটকটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন নাটকটির ব্যাপারে একটি সরকারি মহলের আপত্তির মুখে ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ নাটকের প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সেসময় ছাত্র আন্দোলন সোচ্চার হতে শুরু করেছে। স্বৈরশাসকের চরিত্রের সাথে মাতুব্বর সেরাজ তালুকদারের কর্মকা- প্রতীকী সাদৃশ্য রয়েছে, তাই নাটকটি স্বৈরশাসকের রোষাণলে পড়ে।
লালমাটি কালোধোঁয়া (১৯৮২)
নাসির উদ্দিন ইউসুফ এর প্রযোজনায় ‘লালমাটি কালোধোঁয়া’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বিখ্যাত একটি ধারাবাহিক নাটক। ‘লালমাটি কালোধোঁয়া’ সেলিম আল দীন রচিত পনের পর্বে সমাপ্ত হয়। সম্প্রচার সময়কাল ১৯৮২-৮৩। ‘লালমাটি কালোধোঁয়া’ নাটকে অভিনয় করেন౼ নার্গিস, আতাউর রহমান, ডাবলু আনোয়ার, মজিবুর রহমান দিলু, শতদল বড়ুয়া, নায়লা আজাদ নুপুর, রেজাউল করিম প্রমুখ।
গ্রন্থিকগণ কহে (১৯৯১)
সেলিম আল দীন রচিত ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ নাটকটি ১৯৯০-৯১ সালে প্রচারিত হয়। এটি আট পর্বের ধারাবাহিক নাটক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর নাটকটি প্রচারিত হতো। সেলিম আল দীন রচিত গ্রন্থিকগণ কহে নাটকটি এদেশের যাত্রা শিল্পীদের নিয়ে রচিত। এক কথায় বলা যায়, যাত্রা শিল্পের সামগ্রিক অবস্থার এক নিখুঁত দলিল। এদেশের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প আজ কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব যাত্রাপালা এক সময় মানুষের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল। নানা ধরনের চমকপ্রদ নাম ছিল সেসব যাত্রাদলের। ‘দি নিউ ঘোষাল অপেরা’ র কাহিনি নিয়ে নাটকের শুরু। এসব যাত্রা পালায় মঞ্চস্থ হয় লোকজ নানা কাহিনি মধুমালা মদনকুমার, গুনাই বিবি, রহিম রুব্বান, রাম-রাবণের পালা, বেহুলা-লখিন্দরের পালা প্রভৃতি। বর্তমানে যাত্রা শিল্পীদের নানা দুঃখ কষ্টে, আর্থিক টানাপোড়নে দিন কাটে। শত কষ্টের মধ্যে তারা এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। তাদের নিজেদের অভিনেতার সংকট, ব্যক্তিগত নানা দ্বন্দ্ব, যাত্রার মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা সবই আলোচ্য নাটকে নাট্যকার ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান যুগে যাত্রা শিল্পের ধ্বংসের জন্য দায়ী যুগের হাওয়া। পশ্চিমাধাচের নাচে গ্রামগঞ্জের মানুষও আনন্দ খুঁজে পায়। আর এ কারণে যাত্রাগানে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটায় এই শিল্প তার স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। নাট্যকার বাঙালির যাত্রা শিল্পের ক্ষয়িষ্ণু অবক্ষয়িত রূপটি এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন।
নাটকটি প্রযোজনা করেন শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশা। অভিনয় করেছেন- সুবর্ণা মুস্তাফা, জহির উদ্দিন পিয়ার, শিমুল ইউসুফ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাদেক বাচ্চু ও হুমায়ুন ফরীদি। টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-৩ এ সংকলিত হয়েছে।
অনৃত রাত্রি (১৯৯৩)
‘অনৃত রাত্রি’ নাটকটি সেলিম আল দীন ১৯৯৩ সালে রচনা করেন। নাটকটি প্রযোজনা করেন খ ম হারূন। মাত্র তিনটি চরিত্র নিয়ে নাট্যঘটনা আবর্তিত। একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ-বেদনার প্রকাশ। এই দম্পতির এক দেড় বছর বয়সী সন্তানের অকস্মাৎ মৃত্যু হয়। সন্তানহারা মা দিশেহারা পাগলপ্রায়। দিবস রজনী স্বামী-স্ত্রী মৃত সন্তানের জন্য হাহাকার করে। এই শূণ্যতা তাদের মাঝে ক্রমাগর দূরত্ব তৈরি করতে থাকে। এমন সময় ঘরের মধ্যে একজন আগন্তুকের উপস্থিতি তারা লক্ষ করেন। লোকটিকে চোর সাব্যস্ত করে রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলেন। ক্ষাণিক পর লোকটির বাঁধন খুলে যায়। লোকটিকে জাদুকর মনে হয়। তার আচরণও কৌতুহলপূর্ণ ও রহস্যময়। তারা হেলোসিনেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে; একটা বাস্তব বা অবাস্তব অথবা অতি কল্পনায় সাথে লোকটির দার্শনিক বাক্যালাপেস্বামী-স্ত্রীর পূর্বতন ধারণা পাল্টে যায়। স্বামী-স্ত্রী একজন অপরজনের প্রতি ভালোবাসা, টান বা হৃদ্যতা অনুভব করেন। মৃত সন্তানের জন্য হাহাকার মুগ্ধতায় রূপান্তরিত হয়। আগন্তুক যেভাবে অকস্মাৎ এসেছিলেন তেমনী ঘোরলাগা পরিবেশে অকস্মাৎ প্রস্থান করেন। রাতটিকে তাদের কাছে অনৃত রাত বলে প্রতীয়মান হয়। অভিনয় করেন- শিমুল ইউসুফ, রাইসুল ইসলাম আসাদ ও আহমেদ ইকবাল হায়দার। ‘অনৃত রাত্রি’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র- এ সংকলিত হয় নি।
ছায়া শিকারী (১৯৯৪)
১৯৯৪-৯৫ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত সেলিম আল দীন রচিত অন্যতম একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক। নয়টি পর্বে ধারাবাহিক নাটকটি সম্পন্ন হয়। ছায়া শিকারী নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন౼ গোলাম মোস্তফা, শহীদুজ্জামান সেলিম, আফসামা মিমি, শম্পা রেজা প্রমূখ। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশা।
হিতঙ্কর (১৯৯৯)
বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইদে প্রচারের জন্য প্যাকেজ নাটকের আওতায় নির্মিত হয় ‘হিতঙ্কর’। সেলিম আল দীন౼ এর লেখা এই নাটকটি পরিচালনা করেন আফজাল হোসেন। অভিনয় করেছিলেন౼ আফজাল হোসেন, বিপাশা হায়াত, হুমায়ুন ফরিদী, আবুল খায়ের প্রমুখ। ১৯৯৯ সালে নাটকটি বিটিভিতে প্রচার হয়েছিল।
সাতশ সাতাত্তর (২০০০)
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্যাকেজ নাটকের আওতায় সেলিম আল দীন রচিত ‘সাতশ সাতাত্তর’ নাটকটি ২০০০ সালে সম্প্রচারিত হয়। ‘সাতশ সাতাত্তর’ নাটকটি একটি উঁচু মানের রাজনৈতিক স্যাটায়ার। একটি ভাঙ্গা গাড়ীকে প্রতীকী কায়দায় রাজনৈতিক স্যাটায়ারে রূপান্তর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাশ করা এক যুবক গ্রাম থেকে এসে নগরে একা বাস করে। প্রেমে পড়ে বড় লোকের এক মেয়ের। সেই মেয়ের বান্ধবী প্রেম করে আরো বড় লোকের এক ছেলের সাথে।
পরিচালনা করেন ইউসুফ হাসান অর্ক ও মিনহাজুর রহমান। শিল্প নির্দেশনা-তানভীর হাসান, আবহসঙ্গীত- আবিদ রনি, অভিনয়౼তৌকির আহম্মেদ, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, মোশাররফ করি, পাভেল আজাদ, রশীদ হারুন, তারিক আনাম খান, নায়লা প্রমূখ।
ক্ষমা (২০০৩)
সেলিম আল দীন-এর লেখা ‘ক্ষমা’ এনটিভি’তে প্রচারিত ছাব্বিশ পর্বের ধারাবাহিক নাটক। নাটকটি ২০০৩ সালে প্রচারিত হয়। পরিচালনা করেন ইউসুফ হাসান অর্ক ও ফজলুল কবির তুহিন। শিল্প নির্দেশনা-তানভীর হাসান, আবহসঙ্গীত- জগলুল আলম। অভিনয় করেন- আফজাল হোসেন, অপি করিম, তারিন, মোশাররফ করিম, আমিরুল হক চৌধুরী, ইউসুফ হাসান অর্ক, ফজলুল কবির তুহিন, তানভীর হাসান, হিল্লোল, ফারহানা মিঠু, এস এম. মহসিন প্রমুখ।
রঙের মানুষ (২০০৮)
সেলিম আল দীন ও মাসুম রেজা যৌথ রচিত মেগা সিরিয়াল ‘ রঙের মানুষ’। নাটকটি ২০০৪ সালে সম্প্রচার শুরু হয়। বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভির নাটক ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় মেগা সিরিয়াল এটি। পরিচালনা করেন সালাউদ্দিন লাভলু। রঙের মানুষ হইলেন তারা, রঙ দেখেন যা কিছু রঙ ছাড়া। অচিন মানুষ পাবো আমি কোনখানে/জোড়দীঘির ধারে নয়/ঘরের খাট পালঙ্কে নয়, ছাতিম গাছের তলে নয়, অচিন মানুষ পাবো আমি কোনখানে। রঙ ছাড়া মানুষে বা জিনিসে যারা রঙ খুঁজে পার তারাই আমার রঙের মানুষ। তারা অচিন মানুষ। তাদেরকে খুঁজতে হবে। রঙের মানুষ, রঙ্গিলা আকাশে উড়াও অন্তরের হাউস, ভবের হাটে সাওদা করে রঙের হাটে যাও অন্তর বাহির এক করে এক তারে বাজাও। রঙের মানুষ, রঙ্গিলা আকাশে উড়াও অন্তরের হাউস। অভিনয়ে౼ এটিএম শামসুজ্জামান, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, সালাউদ্দিন লাভলু, তানিয়া আহমেদ, আহমেদ রুবেল, ফজলুর রহমান বাবু, বন্যা মির্জা, সমু চৌধুরী, রহমত আলী, আ খ ম হাসান, প্রাণ রায়, মিনু, রশীদ হারুন, আনিসুর রহমান মিলন, মুক্তি, ফেরদৌস আরা রুমী প্রমূখ। রংমেহের নামের এক গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবন নিয়ে নির্মিত এই নাটক নতুন একটি ধারার সুচনা করে, যা এখনো বহমান এবং নাটকের এই ধারাটি গ্রামবাংলার সাধারণ দর্শকের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়।
সেলিম আল দীন౼এর রচনার বিষয়, আঙ্গিক, শৈলী, ভাষা ও ব্যাপ্তিতে মহাকাব্যিক বিস্তারে ব্যাপৃত। তাঁর আখ্যানে- গদ্য, পদ্য হয়ে ধরা দেয়, সুর, ছন্দ, লয়, তাল, বর্ণনা চরিত্র হয়ে কথা বলে। সমসাময়িক বাঙলা নাট্যরচনার ধারাবাহিকতা বিচারে তিনি টেলিভিশন ও মঞ্চের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে উত্তাল আন্দোলন প্রেক্ষাপটে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রাঙাচোখ উপেক্ষা করে তিনি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছেন। নাটক লিখেছেন জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে, লিখেলেন স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে। এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে সেলিম আল দীন রচিত ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ প্রযোজিত ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। সেলিম আল দীন রচিত ও প্রচারিত টিভি নাটকের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। তিনি টেলিভিশনের জন্য যেমন রাজনৈতিক গল্প লিখিছেন, তেমনী লিখেছেন সমাজ পরিবর্তনের গল্প। প্রেম, ভালোবাস, নির্মল হাসির নাটক রচনাতেও তিনি ঈর্শনীয় সফলতা দেছিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার হিসেবে ‘টেনাশিনাস পুরষ্কার’ লাভ করেন। বেসরকারি টেলিভিশনের জন্যও তিনি অনেক নাটক লিখেছেন, যেসব নাটক বাণিজ্যিক ভাবেও শীর্ষস্থানে ছিল। ধারাবাহিক নাটক-ক্ষমা, মেগা সিরিয়াল-রঙের মানুষ, ধারাবাহিক নাটক-বসবাস, প্রত্ননারী- উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সেলিম আল দীন౼এর নাটকের পাণ্ডুলিপি ও ভিডিওচিত্র প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়- নাটকের নামকরণ থেকে শুরু করে সংলাপ, বর্ণনা, ভাষা, বিষয়, আঙ্গিক, চিন্তা প্রভৃতির প্রকাশভঙ্গিতে ভীষণ আধুনিক। বাঙলা ভাষাভাষীদের নিকট সেলিম আল দীন౼এর নাটকগুলো শিল্পসার্থকতায় অনন্য। ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক বলয় ও শিল্পতত্ত্বের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেলিম আল দীন একজন প্রতিবাদী নাট্যকার। জাতীয় নাট্যাঙ্গিক ও নাট্যমঞ্চের স্বরূপ আবিষ্কারে একনিষ্ঠ ছিলেন এই নাট্যগবেষক। মঞ্চের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন নাট্যরচনায় বিষয় ও আঙ্গিকে অভিনব ভাবনা এনেছেন। প্রান্তিক মানুষের ভাষাকে শিল্পমানে উন্নীত করার প্রচেষ্টায় তিনি টিভি নাটকের সংলাপ ও ভাষা ব্যবহারে নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর সৃষ্ট শিল্পরীতি ও নাট্যদর্শন টেলিভিশন নাটকে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। সেলিম আল দীন-এর টিভি নাট্যপ্রযোজনায় মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সঙ্গীত, চারুকলা, নৃত্যকলা এসব বিষয় অনায়াস বিচরণ করে। সস্তা বিনোদনের জন্য কোনো টিভি নাটক তিনি রচনা করেন নি। তিনি সর্বদা চেয়েছেন বাংলানাটক বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে জায়গা করে নিক। গণযোগাযোগের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম টেলিভিশনের শক্তিকে তিনি কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। বাঙলা ও বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে মুঠোয় নিয়ে তিনি নাটক রচনা করেছেন। সুষ্ঠু জনরুচি ও সংস্কৃতিবান মানস বিনির্মাণের লক্ষে তিনি টিভি নাটকের কৌশলে কাব্য-সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব, চিত্রকলা ও সঙ্গীতের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাট্যইতিহাসে সেলিম আল দীন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম।
ড. ইসলাম শফিক: টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, শিল্প সমালোচক ও শিক্ষক।