
তাকে চিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই। বাংলাদেশ টেলিভিশন তখন আমার কাছে একটি স্বপ্ন তৈরির কারখানা। যেখানে কাজ করেন মুস্তাফা মনোয়ারের মতো সৃজনশীল মানুষেরা। তখনো ভাবিনি এই স্বপ্ন তৈরির কারখানায় একদিন আমিও হবো একজন কারিগর।
১৯৭০ থেকে ১৯৭৬ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ তারপর ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ দিল্লির ‘ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামা’য় পড়াশোনা। ছাত্রজীবনে কর্মজীবন নিয়ে ছিলাম অনেকটা উদাসীন। বন্ধুরা যখন বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে আমি তখন থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য দেশের বাইরে চলে যাই। ফিরে এসে কি করবো জানিনা। একদিন দেখা করলাম মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের সেন্ট্রাল রোডের বাসায়। তিনি তখন বাংলাদেশ পারফর্মিং আর্টস একাডেমির নির্বাহী পরিচালক। তার আগ্রহে প্রতিষ্ঠানটির নাট্য প্রশিক্ষক হিসেবে আমি ও জামিল আহমেদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক) যোগদান করি ১৯৭৯ সালে।

মুস্তাফা মনোয়ার ও জামিল চৌধুরী
১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতা বিপ্লবের সময় বিটিভির চারজন কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীদের তালিকায় সেসময়ের বিটিভির মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী এবং জিএম মুস্তাফা মনোয়ার ছিলেন। কিন্তু আগেই খবর পেয়ে যাওয়ায় তারা সেদিন রামপুরা টিভি ভবনে আসেননি। কিছুদিন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পর একসময় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্দেশনায় তারা আবার কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু দুজনের কেউই আর বিটিভিতে ফিরতে রাজি ছিলেন না। রাষ্ট্রপতি জিয়া গুণী মানুষদের খুঁজে খুঁজে বের করতেন। তিনি জামিল চৌধুরীর মাধ্যমে জাতীয় সম্প্রচার একাডেমি (পরবর্তীতে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট) এবং মুস্তাফা মনোয়ার-এর উদ্যোগে বাংলাদেশ পারফরমিং আর্টস একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। পারফরমিং আর্টস একাডেমি পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং তিনি একসময় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন।
অনেকেই জানেন বিটিভির অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’র কথা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় চালু করা হয় ‘নতুন কুঁড়ি’ এবং বিটিভির বাইরে থাকলেও এই সিরিজটির মূল পরিকল্পনায় ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। জিয়াউর রহমানের বিটিভি নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিলো। তার সময়েই আমরা একদল তরুণ বিটিভিতে প্রযোজক পদে যোগদান করি ১৯৮০ সালে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি সে সময়ে জিয়ার উদ্যোগেই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এওয়ার্ড, একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক প্রবর্তন করা হয়। যদিও পরবর্তীতে এরশাদের সময় টেলিভিশন এওয়ার্ড বিলুপ্ত করা হয়েছিলো।

জামিল চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার ও খ ম হারূন
মুস্তাফা মনোয়ার বিটিভির বাইরে থাকলেও তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি টিভি নাটক নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’। ১৯৭৭ থেকে এই অসাধারণ প্রকল্পটি হাতে নিলেও ‘রক্তকরবী’র নির্মাণ শেষ হয় ১৯৭৯ সালের শেষে। সে সময় আমি যেহেতু পারফর্মিং আর্টস একাডেমির সাথে যুক্ত, তাই মুস্তাফা মনোয়ারের ‘রক্তকরবী’ সম্পাদনার কাজও কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে যখন ‘রক্তকরবী’ বিটিভিতে প্রথমবার সম্প্রচারিত হয় তখন পুরো বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গে’র নাট্য ও টিভি জগতে এক প্রচন্ড আলোড়ন তৈরি করে। বলে রাখি কলকাতার দর্শকদের তখন প্রধান আকর্ষণ ছিলো বিটিভি ঢাকা, তাদের দূরদর্শন কেন্দ্র নয়। নাট্যজগতের মহাপুরুষ শম্ভু মিত্র, চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিত রায় মন্তব্য করেছিলেন, টেলিভিশনে এতো বড় মাপের একটি নাটক এতো অসাধারণভাবে যে নির্মাণ করা সম্ভব, তা তাদের জানা ছিলো না। আমি তাই ‘রক্তকরবী’কে একটি টিভি নাটক না বলে টিভি মাধ্যমে নির্মিত একটি পূর্ণ থিয়েটার হিসেবে চিহ্নিত করতে পছন্দ করি। রক্তকরবী’র সেট সে এক বিশালতার নিদর্শন। শুধু সেট নয়, ত্রিমাত্রিক লাইটিং, কসটিউম, মেকআপ- সবকিছুতেই ছিলো নাটকীয় বৈচিত্র্য। আর চরিত্র রূপায়ণ যারা করেছিলেন – সেই দিলশাদ খানম, গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, সাইদুল আনাম টুটুলসহ সকলেই, তারা দিনের পর দিন যে পরিশ্রম করেছেন, তা অতুলনীয়। মুস্তাফা মনোয়ার একজন শিল্পের যাদুকর, সকলের কাছ থেকে সবটুকু কিভাবে আদায় করতে হয় তা তিনি জানতেন।

সাম্প্রতিক সময়ে মুস্তাফা মনোয়ার
মুস্তাফা মনোয়ার কলকাতায়ও যথেষ্ট সুপরিচিত ছিলেন। তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। তবে সেখানে পড়াশুনা শেষ না করে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সেখান থেকে ফাইন আর্টসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর ঢাকা ফিরে এসে ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় টেলিভিশন চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তিনি সেখানে প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে টেলিভিশন মাধ্যমকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল মাধ্যম হিসাবে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসেন।
খ ম হারূন: টেলিভিশন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।




























