
ইতিহাস জুড়ে কিছু রহস্য রয়েছে, যেগুলো হয়তো কখনোই চূড়ান্তভাবে সমাধান হবে না। যেমন— জ্যাক দ্য রিপারের আসল পরিচয়, কিংবা ক্লিওপেট্রার সমাধির অবস্থান। কখনো হয়তো প্রমাণ হারিয়ে গেছে বা কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস হয়ে গেছে। আবার কখনো নতুন কোনো প্রমাণ সামনে আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম থাকে, অথবা বেঁচে থাকা প্রমাণগুলো এতটাই অস্পষ্ট হয় যে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা কখনো একমত হতে পারেন না।
এই উত্তরহীনতা নিজেই এই রহস্যগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এখানে আমরা দেখব ১০টি এমন ঐতিহাসিক রহস্য, যেগুলোর চূড়ান্ত উত্তর হয়তো আমরা কখনোই পাবো না।

১৯২৪ সালে কি মাউন্ট এভারেস্ট অভিযাত্রীরা শৃঙ্গ স্পর্শ করেছিলেন?
মাউন্ট এভারেস্টে প্রথম নিশ্চিতভাবে পৌঁছানো ব্যক্তি ছিলেন এডমন্ড হিলারি এবং টেনজিং নোরগেই, যারা ২৯ মে, ১৯৫৩ সালে শৃঙ্গ স্পর্শ করেন। তবে তারা প্রথম ব্যক্তি নাও হতে পারেন।
১৯২৪ সালে ব্রিটিশ পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু কম্যান “স্যান্ডি” আর্ভাইন এবং জর্জ ম্যালোরি মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় থেকে গবেষকরা ধরে নিয়েছেন যে, হয়তো তারা মৃত্যুর আগে শৃঙ্গ স্পর্শ করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে কনরাড আঙ্কার প্রায় ২৭,০০০ ফিট (৮,২২৯ মিটার) উচ্চতায় ম্যালোরির দেহ খুঁজে পান। ২০২৪ সালে, আর্ভাইনের পা, (যা তখনও মোজা ও বুটে ঢেকে ছিল), ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডকুমেন্টারি দল দ্বারা আবিষ্কৃত হয়। তবে, দুজনের সঙ্গে যেসব ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। এই ঘটনাগুলো নিয়ে অনুমান প্রচুর, কিন্তু সম্ভবত আমরা কখনো নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না যে তারা শৃঙ্গ স্পর্শ করেছিলেন কিনা।

মেরি সেলেস্টের অদ্ভুত রহস্য
৫ ডিসেম্বর, ১৮৭২ সালে, ব্রিটিশ জাহাজ ‘ডেই গ্রেশিয়া’ মেরি সেলেস্টের কাছে আসে। জাহাজটি পরিত্যক্ত ও ভেসে চলছিল, আজোরস দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ৪০০ মাইল (৬৪৪ কিমি) পূর্বে। একটিও লাইফবোট ছিল না, কোনো লড়াই বা ক্ষতির চিহ্নও দেখা যায়নি। জাহাজে থাকা ১০ জন যাত্রী এবং ক্রুকে আর কখনো দেখা যায়নি।
ব্যাপারে অনেক তত্ত্ব এসেছে। একটি হলো, জাহাজের মদ্যজাত পানপাত্র থেকে লিক হওয়া গ্যাস দেখে ক্রুরা ভয় পেয়ে জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছিল, কারণ তারা ভেবেছিল এটি আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। অন্য তত্ত্ব হলো, জলঘূর্ণি বা waterspout জাহাজের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল। আজও এর চূড়ান্ত উত্তর অজানা।

ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি: অদ্ভুত কোডের রহস্য
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি, একটি ছোট বই যা ইয়েলের বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত, বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। ৬০০ বছর আগে তৈরি এই কোডেক্সে অনেক অদ্ভুত চিত্র এবং লেখা আছে। লেখাগুলো অজানা একজন লেখক লিখেছেন। এটি বোঝা যায় না যে, এগুলো কোনো অজানা ভাষা, কোড নাকি শুধুই অর্থহীন লেখা।
এ ব্যাপারে অনেক তত্ত্ব এসেছে—হয়তো এটি একটি রেফারেন্স বই, কল্পকাহিনী, অথবা গোপন সোসাইটিতে প্রবেশের চেষ্টা। কিন্তু আজও কোনো স্পষ্ট সমাধান পাওয়া যায়নি, এবং মনে হয় এটি কখনো উদঘাটনযোগ্য হবে না।

পেকিং ম্যানের হাড়গুলো কোথায়?
পেকিং ম্যান নামে পরিচিত হোমিনিনের হাড় ১৯২৩ সালে ঝৌকৌদিয়ান গ্রামের কাছে একটি গুহা থেকে পাওয়া যায়। ১৯৩৭ সালে জাপান চীনে আক্রমণ করে এবং ১৯৪১ সালে হাড়গুলো যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর চেষ্টা করে, যা ব্যর্থ হয়। হাড়গুলোর অবস্থান আজও অজানা।
একটি তত্ত্ব হলো এগুলো সমুদ্রে পড়ে গেছে। অন্য তত্ত্ব অনুযায়ী এগুলো চীনের কোথাও দাফন করা আছে। সম্প্রতি ঝৌকৌদিয়ানের গুহায় খননকাজে নতুন পেকিং ম্যান সম্পর্কিত সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে, যা কিছুটা আলো ফেলে।

কিং আর্থার কি সত্যিই ছিলেন?
কিং আর্থারের গল্প এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বলা হয়েছে। ক্যামেলট, রাউন্ড টেবিলের নাইটরা, যাদুকর মের্লিন এবং এক্সক্যালিবার- সবাই কিং আর্থারের গল্পের অংশ।
তবে ইতিহাস অনুযায়ী, যদি কিং আর্থার সত্যিই থাকতেন, বাস্তবতা কম জাদুময় হতো। নবম শতাব্দীর প্রাচীনতম এক লেখায় এক নেতার (হয়তো রাজা নন) যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। ব্রিটেনে অনেক স্থান কিং আর্থারের সঙ্গে যুক্ত, যেমন টিনট্যাজেল, কিন্তু খননকাজ এখনও নিশ্চিত করে এর প্রমাণ দেয়নি।

রোয়ানকোকের অদৃশ্য উপনিবেশ
২২ জুলাই, ১৫৮৭ সালে জন হোয়াইট রোয়ানকোক দ্বীপে পৌঁছান। কয়েক মাস পরে তিনি ইংল্যান্ডে যান সরবরাহ আনতে। তিন বছর পরে ফিরে এসে দেখেন সব লোক অদৃশ্য।
লোকগুলো কোথায় গেল তার সন্ধান করতে গিয়ে তিনি একটি ক্লু পান। ক্লুটি হলো প্রাচীরে খোদাই করা শব্দ “CROATOAN” এবং গাছে খোদাই করা “CRO”। হোয়াইট অনুমান করেছিলেন তারা ক্রোয়াটোয়ান দ্বীপে গিয়েছিল, যা এখন হ্যাটারাস দ্বীপ নামে পরিচিত। ঝড় তাকে সেখানে পৌঁছাতে বাধা দেয়। তিনি আর সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে পারেননি।
কিছু নথি বলে চিফ পাওহাটান কিছু লোককে হত্যা করেছিলেন, তবে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী স্প্যানিশদের আক্রমণে কলোনিস্টরা মারা যান। তবে লোকগুলোকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্য।

উইলিয়াম কিডের লুকানো ধন কোথায়?
উইলিয়াম কিড, যিনি প্রায়ই ক্যাপ্টেন কিড নামে পরিচিত, ছিলেন ১৬০০ সালের শেষ ভাগে সাগরপথে চলা এক কুখ্যাত স্কটিশ প্রাইভেটার। তাকে ব্রিটিশ সরকার দস্যুদের ধরার জন্য নিয়োগ করেছিল, তবে শেষ পর্যন্ত নিজেই দস্যু হিসাবে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন ১৭০১ সালে।
মৃত্যুর আগে কিড অনেক জাহাজ ধরেছিল এবং লুটপাট করেছিল। তবে তার সবচেয়ে বড় জাহাজটি ছিল “কেডাগ মারচেন্ট”, যা ইংল্যান্ডের এক ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ফরাসি অনুমতিপত্র নিয়ে চলছিল এবং এটি মুঘল সম্রাটের পারিষদদের মালপত্র বহন করছিল। এটি ব্রিটিশদের চোখে কিডকে দস্যু বানায়।
কিড নিউ ইয়র্কে অন্য একটি জাহাজে যাত্রা করেন নিজের নাম ছড়িয়ে দেখাতে। কিড দাবি করেছিল সে প্রায় ১ লাখ পাউন্ড (আজকের প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার) লুটপাট করে কোথাও লুকিয়েছে, এবং জীবন বাঁচাতে অবস্থান জানাবার প্রস্তাব দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে। কিন্তু প্রস্তাব অস্বীকৃত হয়, এবং কিড মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন।
কিড চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত দাবি করেছিলেন, তিনি একমাত্র ব্রিটিশ রাজ্যের অনুমোদিত জিনিসগুলোই লুট করেছেন। মৃত্যুর পর তার দেহ টেমস নদীর ওপর একটি লোহা খাঁচায় পিচ দিয়ে ঢেকে প্রদর্শিত হয়। আজও তার লুট করা ধন পাওয়া যায়নি এবং সম্ভবত কখনোই পাওয়া যাবে না।

জ্যাক দ্য রিপার কে ছিলেন?
১৮৮৮ সালে, জ্যাক দ্য রিপার লন্ডনে অন্তত পাঁচজন নারী হত্যা করেছিলেন এবং তাদের দেহ ভয়ঙ্করভাবে বিকৃত করেছিলেন। রিপারের নামানুসারে পুলিশের প্রতি আক্রমণাত্মক চিঠি পাঠানো হয়েছিল। (কোনো চিঠি আসলেই রিপারের লেখা ছিল কি না, তা বিতর্কিত)
“জ্যাক দ্য রিপার” নামে এই চিঠি থেকেই এসেছে। রিপার কখনো ধরা পড়েনি। সময়ের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি সন্দেহভাজন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জন মরিস ২০১২ সালে তার বই Jack The Ripper: The Hand Of A Woman-এ বলেছেন যে, লিজি উইলিয়ামস নামের একজন নারী হতে পারে রিপার। তবে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা এই তত্ত্বের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মূল পরিচয় কখনো জানা যাবে বলে মনে হয় না।

জিমি হোফা কোথায়?
টিমস্টার ইউনিয়ন নেতারূপে পরিচিত জিমি হোফা, যিনি মাফিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; ৩০ জুলাই, ১৯৭৫ সালে মিশিগানের ওকল্যান্ড কাউন্টিতে নিখোঁজ হন। ১৯৮২ সালে তাকে আইনত মৃত ঘোষণা করা হয়। তার খুনির পরিচয় এবং লাশের অবস্থান আজও রহস্য।
পুলিশ ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ডেট্রয়েট এবং ওকল্যান্ড কাউন্টির বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেছেন, কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি। এক জনপ্রিয় তত্ত্ব ছিল যে, হোফার দেহ নিউ জার্সির জায়ান্টস স্টেডিয়ামের নিচে চাপা রয়েছে। তবে এটি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ ও ২৬ অক্টোবর, এফবিআই নিউ জার্সির একটি ল্যান্ডফিলে “সাইট সার্ভে” করে। সেখানে একজন ল্যান্ডফিল কর্মী বলেছিল তার এবং তার বাবার দায়িত্ব ছিল হোফার দেহ একটি স্টিল ব্যারেলে লুকানো। তদন্তে কোনো ব্যারেল পাওয়া যায়নি। এফবিআই স্পোকসম্যান মারা শ্নাইডার বলেন, “কোনও প্রমাণমূলক জিনিস পাওয়া যায়নি। তবে আমরা যে কোনও সম্ভাব্য সূত্র অনুসরণ চালিয়ে যাব।”
হোফার হত্যাকারীর পরিচয়ও অজানা। ২০০৬ সালে মৃত্যুর আগে, রিচার্ড “দ্য আইসম্যান” কুকলিনস্কি দাবি করেছিলেন যে তিনি হোফাকে হত্যা করেছেন এবং দেহ ধাতব খোড়ায় ফেলেছেন। কিন্তু পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা এই স্বীকারোক্তিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সময়ের সঙ্গে মনে হচ্ছে হোফার দেহ সম্ভবত কখনো পাওয়া যাবে না।

ক্লিওপেট্রার সমাধি কোথায়?
প্রাচীন লেখকরা লিখেছেন যে, মৃত্যুর পরে ক্লিওপেট্রা এবং তার প্রেমিক মার্ক অ্যান্টনি একসাথে সমাধিস্থ হয়েছেন, ৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। লেখক প্লুটার্ক (খ্রিষ্টাব্দ ৪৫–১২০) লিখেছেন, সমাধি ছিল আয়সিস মন্দিরের কাছে, “উচ্চ এবং সুন্দর” এবং স্বর্ণ, রূপা, এমেরাল্ড, মুক্তা, ইবনি ও হস্তি দিয়ে ভরা।
কিন্তু সমাধির অবস্থান আজও অজানা। ২০১০ সালে, মিশরের প্রাক্তন প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রী জাহি হাওয়াস আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে তাপোসিরিস ম্যাগনা নামে একটি স্থানে খনন করেছিলেন। সেখানে ক্লিওপেট্রা সময়ের সমাধিসহ বহু সমাধি পাওয়া যায়। তবে ক্লিওপেট্রার সমাধি পাওয়া যায়নি। হাওয়াস জানান, সমাধি যদি থেকে থাকেও, তা হয়তো লুণ্ঠিত এবং শনাক্তযোগ্য নয়।




























