সোমবার । ডিসেম্বর ৮, ২০২৫
রকিব রেজা ফিচার ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:০৮ অপরাহ্ন
শেয়ার

তাশখন্দ

সিল্ক রোডের পুরাতন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিলনস্থল


Tashkhand Cover

তাশখন্দের কথা মনে হলেই একটা চুক্তির কথা মাথায় আসে। একটা যুদ্ধ বিরতি চুক্তি। এসব কথা ভাবছি আর আলো ঝলমল শহর দেখছি। সিল্ক রোডের অন্যতম প্রধান শহর, তাশখন্দ। লম্বা জার্নির কারণে মাঝে মাঝে তন্দ্রা চলে আসছে। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রায় ২০০০ বছর আগের কথা, যখন চীনের হান রাজবংশের (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে) রাজত্বকাল। তখন থেকে সিল্ক রোডের ব্যবহার শুরু হয়, কী জৌলুসপূর্ণই না ছিলো তাশখন্দের অতীত। সিল্ক রোড বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সেতুতে পরিণত হয়েছিল।

এর মধ্যেই ইয়ানডেক্সের ড্রাইভার বললো, তোমার হোটেলে পৌঁছে গেছি। আমার আধো ঘুম আধো জাগরণ কেটে যায়।

এখন রাত ৪.৩০ টা। লবিতে বসে আছি। রাত কাটার অপেক্ষা। সকাল হলে হোটেলে লাগেজ রেখে বের হবো শহর দেখতে। তারপর দুপুরে ফিরে চেকইন করবো হোটেলে। কারণ আমার হোটেল বুকিং বেলা দুইটা থেকে।

হোটেলের রিসেপশন খুব ব্যস্ত, তারা একটা ট্যুর গ্রুপকে বিদায় দিচ্ছে। তারপরও আমি কয়েককবার জিজ্ঞেস করেছি আমি এখন রুমে উঠতে পারি কিনা; রিসেপশনিস্ট জানিয়েছে, না, নির্দিষ্ট সময়ের আগে না।

Tashkhand 13

হোটেল উজবেকিস্তান

কিছুক্ষণ বসে, পায়চারি করে, তারপর হোটেলে ব্যাগ রেখে বাইরে বের হলাম। সামনে বিশাল গাছপালা ঘেরা ময়দান- আমির তিমুর স্কয়ার। দীর্ঘ কালো বিশাল অশ্বারোহী মূর্তিটা দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ছুটে আসছে এদিকেই। আর আমার পিছনে বিশাল হোটেল উজবেজিস্তান, এতো বড় যে দেখে মনে হবে কয়েকটা শপিংমল।

হোটেল উজবেকিস্তান তৈরি হয়েছিল সোভিয়েত আমলে। সে হিসেবে, হোটেলটার বয়স হয়েছে যথেষ্ট। হোটেলের ইতিহাস থেকে জানা যায়, নানা রকম দেশি-বিদেশি ডেলিগেটরা থেকেছেন এখানে। হোটেলের সামনের পুরোটা দেয়াল জুড়ে বিশাল ডিসপ্লে। রাশিয়ান আর উজবেক ভাষায় বিজ্ঞাপন চলছে, কি লেখা আছে বিজ্ঞাপনে আমি তা বুঝতে পারছি না।

এর মধ্যেই কয়েকজন পথচারি দেখেছি যারা নির্বিগ্নে যাচ্ছে তাদের কর্মস্থলে, এমনকি মেয়েদেরকেও একাকি চলতে দেখলাম। একজনকে রিকোয়েস্ট করে কয়েকটা ছবি উঠালাম নিজের। পর্বতসম হোটেলের পাদদেশে আমি নিতান্তই এক ক্ষুদ্র মানব। ১৭তলা উচ্চতার এই হোটেলে ৯০০ অতিথি থাকতে পারে একসাথে। বিশাল রেস্টুরেন্ট, শপিং প্লেস, জিম, সুইমিংপুল পার্কিং, লর্ন্ডি, শুমেকার, মানি একচেঞ্জ, অন্যান্য বিল্ডিংসহ এলাহি কান্ড।

১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হোটেলে অনেক ডিপলোম্যাট, শিল্পী, লেখক ও সোভিয়েত অভিজাতরা এসে উঠতেন। সাদা রঙের বিশাল অট্টালিকা, সামনে বাকানো জালের মতো নকশা করা প্রাসাদ, যেন এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নের প্রতীক। রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখা যায়, তাশখন্দের হৃদয়- আমির তিমুর স্কয়ার, চারপাশে ছড়ানো বাগান ও প্রশস্ত সড়ক। হোটেলে ভেতরে সোভিয়েত ধাঁচের ইন্টেরিয়র- উচ্চ ছাদ, ঝাড়বাতি, প্রশস্ত লবি- যার সাথে মিলেমিশে আছে আধুনিক সংস্কার। এখানে থাকলে যেন একই সঙ্গে ইতিহাস আর আধুনিকতার সংযোগ অনুভব করা যায়। লিফটে ওঠার সময় শুনলাম, দুজন বলাবলি করছে, এই হোটেলটা পুরানো আমলের, ‘কিন্তু গল্প করার মতো অনেক কিছু আছে’।

হোটেলটি পুরাতন হয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালে এটাকে পুনঃনির্মাণ করা হয়। এখন সব ধরনের আধুনিক সেবা যুক্ত করা হয়েছে। তারপরও এগোডা আর বুকিং ডটকমে এর রিভিউ অতোটা ভালো না, ১০ এর মধ্যে ৭ এর কিছু বেশি। হোটেল ব্যবসার জগতে নতুন হোটেলের কদর বেশি। তবে আমার কাছে হোটেলটা অনেক ভালো লেগেছে। এর বিশালত্ব, সুন্দর লিফ্ট, কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট, যেকোনো সমস্যায় তাৎক্ষনিক রেসপন্স, সবই ভালো।

এতোসব কথা বললাম, কিন্তু আমি তো এখনো হোটেলেই উঠতে পারিনি। ওঠার পরের গল্প আগে বলেছি।

বাইরে থেকে আশপাশ দেখে, আবার রিসেপশনে ফিরে এলাম। রিসেপশনিস্টকে বললাম, আমার হোটেলের রুমে উঠার ব্যবস্থা করো। সে বললো যদি ১৫ ডলার এখন পে করো তাহলে তুমি এই সকাল ছয়টাতেই রুমে উঠতে পারবে। আমি বললাম, ১০ ডলার নাও। সে রাজি হয়ে গেল। বললো, তোমার জন্য আজ সকালের ব্রেকফাস্টও কমপ্লিমেন্টারি। আমি তো আট ঘন্টা আগে হোটেলে উঠতে পেরেই খুশি। রুমে চলে গেলাম। এগোডা দিয়ে বুকিং করা ৪০ ডলারের রুম। বেশ ছোট কিন্তু ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। একা থাকার জন্য এটাই যথেষ্ট। আর এটা যেহেতু ঐতিহাসিক হোটেলে, তাই এর লিমিটেশন নিয়ে আমি চিন্তাই করলাম না।

বাথ নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে, নাশতা করতে গেলাম। আরে কী বিশাল রেস্টুরেন্ট! হরেক রকম খাবার, সাথে নানা রকমের চিজ, সিরিয়াল, হানি, ব্রেড, মিল্ক, টি, কফি। আর ইন্টান্যাশনাল হোটেলে যেসব কমন আইটেম থাকে সেগুলো তো আছেই, ফল-মূল জুসসহ আরও আছে উজবেক খাবার। সব মিলিয়ে ৫০ ধরনের আইটেম তো হবেই।

নাশতা করে রুমে গিয়ে দিলাম ঘুম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দুপুর হয়ে গেছে। কিন্তু বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সকাল দশটার দিকে নাস্তা করেছি, তাই দুপুরের খাবার নিয়ে খুব একটা ভাবলাম না। বারান্দার দরজা খুলে দিলাম, বেশ ঠান্ডা। কিন্তু রুমের ভেতরের এসির গরম আর বাইরের ঠান্ডা মিলে একটা ব্যালান্স হয়ে গেল।

জানালা দিয়ে তাশখন্দ শহর দেখছি, ট্যাক্সি, আর বাস চলাচল দেখতে পাচ্ছি। ব্যাটারির রিক্সা, সিএনজি বা টমটম কিছুই দেখতে পেলাম না। শহরটা মোটামুটি ব্যস্ত। কিন্তু ঢাকার মতো জ্যাম তো আর পৃথিবীর কোথাও নেই।

বাইরে বৃষ্টি এখনো চলছে। চোখ জুড়ে আবারও ঘুম চলে এলো। ঘুম ভাঙলো বিকাল ৫.০০টায়। বাইরে তাকালাম। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, ভাবলাম, না আর শুয়ে থাকা নয়। বের হতে হবে। প্রয়োজনে মেট্রো রেলে উঠে বসে থাকবো, তাও ঘরের মধ্যে আর নয়।

হোটেল থেকে বের হলাম । এখন আর বৃষ্টি নেই। সামনেই আমির তিমুর স্কয়ার। মনে হলো এটা দিয়েই শুরু করি।

আমির তিমুর স্কয়ার

Tashkhand 1

আমির তিমুরের ভাষ্কর্য

আমির তিমুর (তৈমুর লং নামে এদেশে পরিচিত) উজবেকিস্তানের জাতীয় বীর। পৃথিবীর ইতিহাসে তার ভাবমূর্তি যাই হোক, উজবেকবাসি তাঁকে জাতীয় বীরের মর্যদা দিয়েছে।

আমির তিমুর বিশাল স্কয়ার, আমার হোটেলের সাথেই। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সেখানে। বিশাল মূর্তি আমির তিমুরের। ঘোড়ার উপর চড়ে তিনি দিক্বিজয়ের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এই স্কয়ার তাশখন্দ শহরের সাথেই এক বিস্তির্ণ প্রাঙ্গন। আজকের দিনে এটা যেন আধুনিক নগরীর প্রাণকেন্দ্র, কিন্তু এর শেকড় ছড়িয়ে আছ বহু শতাব্দীর ইতিহাসে।

১৮৬৫ সালে, যখন রুশ সেনাপতি মিখাইল চেরন্যায়েভ তাশখন্দ দখল করেন, তখন শহরটি ছিল সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া এক রত্ন। সে সময় তাশখন্দ ছিলো রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ তুরকিস্তান সামরিক কমান্ডের কেন্দ্রে। পরের কয়েক বছরে তৈরি হয়েছিল সবুজে ঘেরা একটি ছোট্ট পার্ক, চারপাশে স্কুল, জিমনেশিয়াম আর সরকারি দপ্তর। ১৮৮২ সালে এই পার্কটির নামকরণ হয়েছিলো কনস্টান্টিনোভস্কি স্কয়ার। তবে সময়ের স্রোতে পার্কটির নাম বদলেছে, রূপ বদলেছে, আর ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন গল্প।

রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে যখন সোভিয়েত শাসনের হাত পড়ে, তখন স্কয়ারের বুকেও নতুন অধ্যায় শুরু হয়। স্কয়ারটির নাম আবারও বদলে যায়, নাম হয়, রেভলিউশন স্কয়ার, পরে লেলিন স্কয়ার। এখানে উঠে দাঁড়ায় লেলিনের ভাস্কর্য, চলতে লাগলো রাজনৈতিক সমাবেশ, সামরিক কুচকাওয়াজ আর বিপ্লবী শপথ। এক সময় এই স্থান হয়ে উঠেছিলো সাম্রাজ্যের শক্তি আর কর্তৃত্বের প্রতীক।

কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকে না। ১৯৯০ সালে বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ১৯৯১ সালে উজবেকিস্তান পেল স্বাধীনতা। পুরনো শৃঙ্খল ছিড়ে লেখা শুরু হলো নতুন ইতিহাস। লেলিনের মূর্তি সরিয়ে নেওয়া হলো, তার জায়গায় ১৯৯৪ সালে স্থাপন করা হলো মধ্যযুগের এক ‘মহান’ সম্রাটের বিশাল অশ্বারোহী ভাষ্কর্য- তিনিই আমির তিমুর। এই ভাস্কর্যের শিল্পী হলেন ইলখম জাব্বারেভ।

Tashkhand 2

সমরখন্দে আমির তিমুরের ভাষ্কর্য

ভাষ্কর্যে তাঁকে দেখানো হয়েছে সম্রাটের পেশাক-আশাকে সজ্জিত এক অশ্বারোহী রূপে। সেই তিমুর, যিনি শাসন করেছিলেন বিশাল সাম্রাজ্য, যিনি ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলার উপর দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর শক্তি। তাঁর বিখ্যাত উক্তি আজও স্কয়ারের মাটিতে খোদাই করে লেখা আছে, ‘‘শক্তি ন্যায়বিচারের মধ্যে নিহিত”।

তিনি ভূমধ্যসাগর থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল অঞ্চলে ২৭টি দেশের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রিভূত ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকের আমির তিমুর স্কয়ার যেন অতীত আর বর্তমানের সেতুবন্ধন। চারপাশে আধুনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়, যাদুঘর, আর উন্মুক্ত সবুজ প্রাঙ্গণ। দিনের আলোয় এখানে মানুষের ভিড়, শিশুর হাসি, পর্যটকের পদচারণা; আর সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে বাতাসে ভাসে ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস।

আমি এই বিশাল স্কয়ার দেখছি, আর ভাবছি, এতো সুন্দর করে সাজানো একটা এলাকা। এতো পরিচ্ছন্ন আর সবুজ যে দীর্ঘক্ষণ এখানে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। আমি স্থানীয়দের সহযোগিতায় এখানে কিছু ছবি তুললাম। তারপর দুজন উজবেকের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তাদের সাথে কিছু সময় কাটালাম। যদিও আমাদের কথোপকথন ছিলো বেশির ভাগই ইশারা-ইঙ্গিতে কারণ ইংরেজি এখানে খুব বেশি মানুষ জানে না। বুঝলাম তারা আমির তিমুরকে খুবই পছন্দ এবং ভক্তি করে।

তাদের সাথে ইশারা, অঙ্গভঙ্গি আর কিছু ইংরেজি শব্দের কল্যাণে আমাদের কথোপকথনের কিছুটা এখানে তুলে ধরলাম।
আমি বলি, সালাম।
তারাও বলে সালাম, তারপর বলে, তুমি কোন দেশের লোক?
আমি বলি, বাংলাদেশ।
ইন্ডিয়া?
না, ইন্ডিয়ার পাশে একটা স্বাধীন দেশ।
তুমি কি মুসলিম?
হুম, মুসলিম। শুনেছি, তোমাদের এখানে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। তাহলে তোমরা কেন সিগারেট ধরিয়েছো এই পাবলিক প্লেসে?
নিষেধ হলেও, যেখানে লোকজন কম সেখান খাওয়া যায়।
কী বলো! পুলিশ কিছু বলে না?
পুলিশ ধরলে জরিমানা করবে, আর যেহেতু এখানে মানুষজন কম তাই জরিমানা নাও করতে পারে।
এবার পাশে থাকা আরেকজন বললো, তুমি হিন্দি গান জানো? ‘জিমি জিমি জিমি, আজা আজা, আজা’। সুর করে গাইতে শুরু করে সে। উজবেকি ডাইলেক্টে ভালোই লাগে শুনতে।
এই গানটার কয়েক লাইন আমি জানি। কিন্তু হিন্দি ভাষা জ্ঞান আমার তোমাদের মতোই।
অন্যজন বলে শাহরুখ খান, সালমান খান। মুভি মুভি!
আমি বলি রাজ্জাক, জাফর ইলবাল। তারা হাসমতের মতো আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি বলি লোলার (লোলা ইয়োলদাশেভা) গান গাও বরং শুনি।
দুজনে খুশি হয়ে গাইতে শুরু করে।
এরপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলি, আমির তিমুর সম্পর্কে কিছু বলো।
একজন বলে আমাদের মহান জতীয় বীর হলো, আমির তিমুর।

আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিই। আমাকে আরো অনেক কিছু দেখতে হবে আজ। এখানে উজবেক জাতীয় বীর, আমির তিমুর সম্পর্কে কিছু বলা দরকার।

আমির তিমুর ১৩৩৬ সালের ৯ এপ্রিল উজবেকিস্তানের কেশ (আজকের শখরিসাবজ) শহরের কাছে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম তিমুর ইবনে তরঘাই বারলাস। তিনি তুর্কি-মঙ্গোল বারলাস গোত্রের বংশোদ্ভুত ছিলেন। কৈশোর থেকেই তিনি ছিলেন শক্তিশালী, বুদ্ধিমান আর যুদ্ধকৌশলেও পারদর্শী। একটি যুদ্ধে আহত হয়ে তাঁর ডান পা ও হাত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এজন্য তাঁকে অনেক সময় তৈমুর (Timur the Lame) লং বলা হয়। কিন্তু এই দুর্বলতা তাঁকে মোটেও দমাতে পারেনি। বরং তিনি মন ও বুদ্ধিকে শক্তিশালী করেন, যুদ্ধকৌশল শেখেন এবং গড়ে তোলেন এক অমিত শক্তিশালী সেনাবাহিনী। অবশেষে হয়ে ওঠেন সেই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী সম্রাট।

কৈশোরে তিমুর কিছুদিন মেষপালক ছিলেন। তিনি শিখেছিলেন ধৈর্য্য, শৃঙ্খলা ও নজরদারির গুরুত্ব। পরে তিনি বলতেন-ভেড়ার পাল সামলানো তাঁকে সেনা নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে। যেমন- কখন বিশ্রাম দিতে হবে, কখন দ্রুত এগোতে হবে, আর কীভাবে সৈন্যদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে।

তিমুর যুবক বয়সেই যুদ্ধজীবন শুরু করেছিলেন এবং ধীরে ধীরে তিনি মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। ১৩৭০ সালে তিনি সমরখন্দ দখল করেন এবং এটিকে তাঁর রাজধানী ঘোষণা করেন। এরপর শুরু হয় তাঁর একের পর এক সামরিক অভিযান। তিনি মঙ্গল ও স্থানীয় শাসকদের পরাজিত করেছিলেন। ১৩৯৮ সালে তিনি দিল্লিতে আক্রমণ করেন ও সুলতার নাসিরুদ্দিন মাহমুদের বাহিনীকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেছিলেন। তবে কয়েক মাস পর তিনি ভারত ছেড়ে চলে এসেছিলেন।

১৪০২ সালে তিনি আঙ্কারার যুদ্ধে ওসমানীয় সুলতান বায়েজিদ প্রথমকে পরাজিত ও বন্দি করেছিলেন। তিনি গোল্ডেন হোর্ডের খান তখতমিশকেও পরাজিত করেছিলেন।

বলা হয়, যুবক বয়সে তিমুর এক রাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন- এক বিশাল সম্রাট তাঁকে একটি তরবারি উপহার দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘তুমি পৃথিবীর চার কোণ জয় করবে’। এই স্বপ্নকেই তিনি নিজের ভাগ্যের ইশারা বলে মনে করেছিলেন। পরে তিনি তাঁর জীবনে সেই স্বপ্নকেই বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন। মধ্য এশিয়া থেকে ভারত, পারস্য, আরব পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিলো।

তাঁর সেনাবাহিনী ছিল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী, কিন্তু নিষ্ঠুরতার জন্যও পরিচিত। অনেক শহর ধ্বংস ও হাজার হাজার মানুষ হত্যার জন্য তাঁর নাম ইতিহাসে ভয়ঙ্কর শাসক হিসেবেও পরিচিত।

আমির তিমুর শুধু সেনানায়ক ছিলেন না, তিনি শিল্প, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। তিনি সমরখন্দ শহরকে এক মহিমান্বিত রূপ দিয়েছিলেন। বিখ্যাত গুর-ই-আমির মাজার, বিবি খানম মসজিদ, অসংখ্য মাদ্রাসা ও বাগান তাঁর আমলেই নির্মিত হয়েছিল। বলা হয়, যেসব দেশে তিনি জয়লাভ করতেন, সেখানকার স্থপতি, শিল্পী ও পন্ডিতদের তিনি সমরখন্দে নিয়ে আসতেন। সমরখন্দকে তিনি একটি স্বপ্নের রাজধানী বানাতে চেয়েছিলেন। তাঁর উত্তরসূরিরা, বিশেষ করে নাতি উলুঘবেগ, রেগিস্তান স্কয়ার নির্মাণ, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানে বিশাল অবদান রেখেছিলেন।

একটি গল্প আছে- আমির তিমুর নাকি শহরের মাঝে একটি উঁচু খুঁটির মাথায় একটি সোনার আপেল ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘যে পারে সে এই আপেল নিয়ে যাক।’ কিন্তু দীর্ঘদিন কেউ আপেল নেওয়ার সাহস করেনি। কারণ তিমুরের শাসনে শহর এতো নিরাপদ ছিলো যে মানুষ আইনকে ভয় ও শ্রদ্ধা করত। অবশেষে যখন কেউ একজন আপেলটি নিয়ে গেল, তখন তিমুর গর্বভরে বলেছিলেন, আমার সাম্রাজ্যের শক্তি শুধু সেনায় নয়, ন্যায় ও শৃঙ্খলাতেও।

আমির তিমুরের শেষ স্বপ্ন ছিলো চীন জয় করা। ১৪০৪ সালে তিনি প্রায় দুই লাখ সৈন্য নিয়ে চীনের দিকে রওনা দিয়েছিলেন কিন্তু শীতকালে কাজাখস্তানের ওত্রার নামক স্থানে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ১৪০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমরখন্দে ফিরিয়ে এনে গুর-ই-আমির মাজারে সমাধিস্থ করা হয়। আজও সেই সমাধি, মধ্য এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন।

শোনা যায়, তাঁর সমাধির শিলালিপিতে লেখা ছিল, ‘যে এই সমাধি ভাঙবে, সেই ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনবে’। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত প্রত্নতাত্ত্বিক মিখাইল গেরাসিমভ তাঁর সমাধি খনন করলে কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায় (২২ জুন ১৯৪১, অপারেশন বারবারোসা), জার্মানরা সোভিয়েত আক্রমণ করে।

পরবর্তীতে সমাধি পুানরায় যথাযখভাবে নির্মাণ করা হলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ঐতিহাসিকরা এই ঘটনাকে কাকতালীয় বলে মনে করলেও অনেকেই এই ঘটনাকে তিমুরের অভিশাপ বলেই মনে করে।

আমির তিমুরের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবে তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন বাবর, যিনি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিমুর নাকি তাঁর সেনাপতিদের বলেছিলেন- ‘তোমরা যুদ্ধ জিতে সাম্রাজ্য পাবে, কিন্তু যদি ঐক্য হারাও, তবে সাম্রাজ্য টিকবে না।’ সত্যিই তাঁর মৃত্যুর পর বিশাল সাম্রাজ্য টেকেনি, ছোট ছোট অংশে ভেঙে গিয়েছিল।

আমির তিমুরকে ইতিহাসে একজন মহান সম্রাজ্য নির্মাতা হিসেবেও দেখা হয়। আবার কেউ তাঁকে নিষ্ঠুর বিজেতা হিসেবেও মনে করেন।

আমির তিমুর স্কয়ারের চারপাশ ঘিরে আছে, হোটেল উজবেকিস্তান, ল ইউনিভার্সিটি, আমির তিমুর জাদুঘর, তাশখন্দ চায়েমস (ক্লক টাওয়ার) ও ফোরাম প্যলেস।

ফোরামস্ প্যালেস
স্কয়ার দেখা শেষ হলে আমি এসে দাঁড়ালাম ফোরামস্ প্যালেস এর সামনে। এই প্যালেস তৈরি করা হয়, ২০০৯ সালে। এখানে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বিশাল প্রসাদটির স্থাপত্য শৈলীর পাশাপাশি আকার-আকৃতিও বিস্ময়কর। প্রায় ১০০০০ বর্গমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা এই প্রাসাদের বাইরের অংশ সাজনো হয়েছে বিশাল স্তম্ভ দিয়ে। তবে এর সবচেয়ে অনন্য অংশ হলো এর গম্বুজ, যা প্রায় ৪৮ মিটার উঁচু এবং শীর্ষে সারস পাখির মূর্তি দিয়ে অলংকৃত।

ল ইউনিভার্সিটি
এখান থেকে গেলাম, ল ইউনিভার্সিটি ভবন দেখতে। যা উনবিংশ শতকের একটি স্থাপত্য নির্দশন। এটি প্রক্তন তুরকিস্তান গভর্নর জেনারেল কাউফমানের নির্দেশে তৈরি করা হয়েছিলো। ভবনটি বন্ধ থাকায় এখানে আর তেমন সময় ব্যায় না করে অন্যান্য স্থাপনা দেখতে গেলাম।

আমির তিমুর জাদুঘর

Tashkhand 3

আমির তিমুর জাদুঘরে তাজমহলের মিনিয়েচার (ডানপাশের ছবি)

এইখানে আমি ঘন্টা দেড়েক ছিলাম। অসাধারণ একটি জাদুঘর। খুবই সুন্দর করে সাজানো। এই জাদুঘরে প্রবেশের জন্য বিদেশিদের গুণতে হবে ৪০০০০ সোম যা ৪০০ টাকার সমান। এই জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়েছিলো, আমির তিমুরের ৬৬০তম জন্মবর্ষিকী উপলক্ষে। এখানে আমির তিমুর ও তিমুরিদ যুগ সম্পর্কিত অসংখ্য প্রদর্শনী রাখা হয়েছে। এখানে আছে সুন্দর সুন্দর সব মিনিয়েচার (যেমন- তাজমহল, কি কারণে ওটা এই জাদুঘরে রাখা হয়েছে তা জিজ্ঞেস করেও আমি সদুত্তর পাইনি, আমার মনে হয়, তাজমহল যদিও মুঘল রাজবংশ আমির তিমুরের বংশধর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, তারপরও এটা তৈমুরীয় স্থাপত্য শৈলী এবং শৈল্পিক কৃতিত্বেরও একটি উল্লেযোগ্য উদাহরণ, যা এই রাজবংশের সাংস্কৃতিক নিদর্শন।) আছে সমানীয় কুরআনের একটি অনুলিপি। হলের দেওয়ালে উজবেকিস্তানের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদেও চিত্রকলা রয়েছে, যেখানে আমির তিমুরের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এছাড়াও এখানে আছে তৈজসপত্র, তিমুরিদ যুগের ব্যবহার্য সামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র ও পোশাক। এখানে পরিচয় হয় কাজাকিস্তানের দুই তরুণী টুরিস্টেও সাথে, যারা আমাকে ছবি তুলে দিতে সহায়তা করে।

Tashkhand 4

আমির তিমুর মিউজিয়াম

তাশখন্দ চায়েমস (ক্লক টাওয়ার)
এরপর গেলাম তাশখনদ চায়েমস (ক্লক টাওয়ার) দেখতে। সম্ভবত আমির তিমুর স্কয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন হলো তাশখন্দ চায়েমস। ১৯৪৭ সালে নির্মাণের পর থেকে বহু দশক ধরে এটি তাশখন্দের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই ভবনের নকশাকার ছিলেন এ.এ. মুখামেদশিন এবং এর প্রকল্প উদ্যোগ নেন তাশখন্দের ঘড়ি নির্মাতা আই.এ.আইজেনস্টাইন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি জার্মানির আলেনস্টেন থেকে একটি বিখ্যাত ঘড়ি যন্ত্র নিয়ে আসেন এবং তার রেজিমেন্টের পক্ষ থেকে তাশখন্দকে উপহার দেন। তার বাইরের সজ্জায় অংশ নেন উজবেকিস্তানের বিখ্যাত গাঁচ শিল্পী উস্তো শিরিন মুদারভ। ২০০৯ সালে পুরোনা চায়েমসের প্রতিফলনস্বরুপ আরেকটি নতুন চায়েমস নির্মিত হয়। আজ দুটি মিলে স্কয়ারের এক অনন্য দ্বার হিসেবে পরিচিত।

আমির তিমুর জাদুঘর থেকে বের হয়ে দেখি ৪ থেকে ৫ জন ছেলেমেয়ে কোথাও যাচ্ছে। কোথাও বেড়াতে গেলে স্থানীয়দের সাথে কথা বলা আমার অন্যতম কাজ হয়ে ওঠে। লোকালদের সাথে কথা বললে জানা যায় সেখানকার প্রকৃত চিত্র, হালচাল।
ছেলেমেয়েগুলোকে আমি বললাম, তোমরা কোথায় যাও?
তারা বললো, যাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম, এখন বাসায় ফিরছি।
আমি বললাম, এখন যদি বাসায় না গিয়ে, অন্য কোথাও বেড়াতে যাও, যেমন- ম্যাজিক সিটি। তাহলে কেমন হয়।
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, খুব মজা হয়, কিন্তু মা বকা দেবে। কেউ কেউ বললো, পড়া আছে।
আমি ভাবলাম, অবস্থা তো দেখি, আমাদের মতোই।
তোমরা কি আমাকে একটু হেল্প করতে পারো, ট্যাক্সি ডেকে দিয়ে?
তারা বললো, অবশ্যই পারি। তারপর ইয়ানডেক্স অ্যাপ দিয়ে ট্যাক্সি ডেকে দিলো তাদের মধ্য থেকে একজন।

আমি চললাম কুকেলদাশ মাদ্রাসা দেখতে। শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। বেশ বড় বড় বিল্ডিং আছে দেখি এই শহরে। রাস্তাগুলোও অনেক চওড়া। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার আছে। কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানে উঁচু লোহার বেড়া, বিশেষ করে চওড়া এক্সপ্রেস ওয়ে ধরনের রাস্তায়। এসব জায়গা দিয়ে পথচারী পারাপার নিষেধ। এখানে নিচ দিয়ে আন্ডারপাস আছে। সবাইকে ওখান দিয়েই, সিড়ি ভেঙে নেমে তারপর যেতে হবে। না হলে জরিমানা। কোথাও কোথাও ট্রাফিক সিগনালে পথচারী পারাপারের জন্য সময় মানুষের সবুজ চিহ্ন ভাসে আর ঘড়ির মতো টিক টিক শব্দ হতে থাকে। শুধু এই সময়ই মানুষ পার হতে পারে। কোথাও কোথাও, অঞ্চল ভেদে এর শিথিলতাও আছে। তবে সারা তাশখন্দ শহরে আমি কোথাও খাড়া সিড়িওয়ালা ওভার পাস দেখিনি। যদিও এই শহর সিড়ির শহর, অনেক উচু-নিচু জায়গা দেখেছি, যেখানে প্রচুর সিঁড়ি আছে।

কুকেলদাশ মাদ্রাসা

Tashkhand 5

কুকেলদাশ মাদ্রাসা

কুকেলদাশ মাদ্রাসা হল তাশখন্দের একটি মধ্যযুগীয় মাদ্রাসাা যা চোরশু বাজার এবং চোরশু মেট্রো স্টেশনের কাছে অবস্থিত। এটি ১৫৭০ সালের দিকে শায়বানী শাসক দরবেশ সুলতান দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

এই মাদ্রাসাটি হলুদ ইট দিয়ে তৈরি, এবং এটি একটি ঐতিহ্যবাহী বর্গাকার আকৃতির, যার একটি বড় প্রবেশদ্বার এবং একটি অভ্যন্তরীণ উঠোন রয়েছে। অভ্যন্তরীণ উঠোনের চারপাশের দোতলায় ছাত্রদের বসবাসের জন্য ঘর আছে। এর প্রবেশদ্বারটি ২০ মিটার উঁচু এবং এর পাশে দুটি টাওয়ার আছে। মাদ্রাসাটি দীর্ঘকাল ধরে ইসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিলো। এখানে কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষ দেওয়া হতো।

১৮৩০-৩১ সালে মাদ্রাসার প্রথম তলাটি ভেঙে ফেলা হয় এবং এর ইট দিয়ে নিকটবর্তী কেলারবেগি মাদ্রাসা তৈরি করা হয়েছিলো। পরে এটি পুনরুদ্ধার করা হয়। ১৮৬৮ সালের ভূমিকম্পে মাদ্রাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে ১৯০২-১৯০৩ সালে এটি পুননির্মাণ করা হয়। ১৯৫০ এর দশকে এটি আবারও পুননির্মাণ করা হয় এবং ১৯৬৬ সালের তাশখন্দ ভূমিকম্পে বেঁচে থাকা কয়েকটি ধর্মীয় ভবনের মধ্যে এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।

১৮ শতকে মাদ্রাসাটিকে ক্যারাভানসেরাইতে রূপান্তরিত করা হয়। তারপর এটি একটি দুর্গ হিসেবেও কাজে লাগানো হয়েছিলো। ২০ শতকে এটি ছিল একটি জাদুঘর, প্রথমে নাস্তিকতা এবং পরে লোকসঙ্গীতের। ১৯৯০ এর দশকে, ভবনটি আবার একটি মাদ্রাসায় পরিণত হয়।

বর্তমানে মাদ্রাসাটি সক্রিয় এবং ঐতিহাসিক স্থান হিসেবেও পরিচিত। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায়। এই মাদ্রাসাটি দেখার জন্য বিদেশী হিসেবে আপনাকে দিতে হবে ১৪০০০ সোম যা ১৪০ টাকার সমান।

সুন্দর বিল্ডিং, দারুণ কারুকাজসহ এই ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার জন্য ১৪০ টাকা ঠিকই আছে বলে আমার মনে হয়।

আগেই বলেছি এই মাদ্রাসা দেখার সময় আমার পরিচয় হয় এক হৃদয়বান যুবকের সাথে যে আমাকে সমছা (সমুচা) খাইয়েছিলো, মেট্রোতে চড়িয়ে ‘বেশ-কাজন’ নামের বিখ্যাত প্লভ এর রেস্তোরায় পৌঁছে দিয়েছিল। মুগ্ধ হয়েছিলাম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেশনগুলোর সৌন্দর্য্য দেখে। এখন মেট্রো স্টেশনগুলো নিয়ে একটু বলা যাক।

তাশখন্দ মেট্রো

Tashkhand 6

তাশখন্দ এর একটি মেট্রোস্টেশন

তাশখন্দ মেট্রো স্টেশনগুলো প্রতিটায় খুবই সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর। এই শহরে পা দিয়েই আমার মনে হয়েছিলো এ শহর যেন পুরনো আর নতুনের মেলন্ধন। মাটির ওপরে গড়ে উঠেছে আধুনিক উজবেকিস্তান আর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে এক অপূর্ব জগৎ- তাশখন্দ মেট্রো। প্রত্যেকটা স্টেশন আলাদা আলাদারকম সুন্দর। মার্বেল পাথর, মোজাইক, ঝুলন্ত ক্যান্ডেল লাইট আর ঝাড়বাতি দিয়ে অন্যন্য সুন্দর করে স্টেশনগুলো তৈরি করা হয়েছে।

২০১৮ পর্যন্ত এই স্টেশনগুলোতে ফটো বা ভিডিওগ্রাফি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিলো কিন্তু বর্তমানে ছবি তোলা উন্মুক্ত। ২০১৮ সালের আগে মেট্রো স্টেশনগুলোকে নিউক্লিয়ার বোম থেকে বাঁচার জন্য শেল্টার ও আর্মির সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। একারণে ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ ছিলো বলে জানা যায়।

মধ্য এশিয়ার একমাত্র মেট্রো হচ্ছে তাশখন্দ মেট্রো, যার কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯৭২। তারপর ১৯৭৭ সালে চিলনজার লাইনের প্রথম পর্যায়টি খোলা হয়। তাশখন্দ মেট্রো স্টেশনগুলো তার অনন্য স্থাপত্য নকশার জন্য বিখ্যাত যা উজবেজিস্তানের কবি, লেখক, মহাকাশ ও বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, আলিশার নাভোই স্টেশন ১৫ শতকের কবিকে সম্মান জানিয়ে, গফুর গুলিম ২০ শতকের লেখককে সম্মান জানিয়ে নকশা করা হয়েছে। আর কোসমনাভতস স্টেশনের থিম হলো, মহাকাশ ও বিজ্ঞান, যেখানে ভেলেন্টিনা টেরেসকোভা’র মুরাল আছে। আর দেওয়ালে আছে মহাকাশচারীর ছবি, তারাভরা আকাশ ও উজবেক নভোচারী ভ্লামিদির জানিবারভকে সম্মান জানানো হয়েছে। তাশখন্দ স্টেশন আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো- শহরের নিজস্ব ইতিহাস, সাদা মার্বেল, ঝাড়বাতি, একদিকে সোভিয়েত মহিমা আর অন্যদিকে স্থানীয় শৈল্পিক ছোয়া। তাশখন্দ মেট্রোতে মোট ৪৮টি স্টেশন ও ৪টি লাইন রয়েছে।

Tashkhand 7

তাশখন্দের আরেকটি মেট্রো স্টেশন

আমি তাশখন্দে অনেকগুলো মেট্রো স্টেশন দেখেছি, মেট্রোতে চড়ার সূত্রে। মানুষজনকে বিদেশীদের প্রতি খুবই আন্তরিক আর সহায়তাপরায়ন দেখেছি, যা মেট্র্রোর ক্ষেত্রে খুবই বিরল। এমনকি জায়গা খালি থাকলে বসতে বলেছে কোনো কোনো যাত্রী। আমার কাছে তাশখন্দ মেট্রোকে খুবই সেফ মনে হয়েছে। ইনসিডেন্টের হারও এখানে খুবই কম। প্রত্যেক স্টেশনেই সবুজ পোশাক করা অন্তত ২ জন করে সিকিউরিটি গার্ড দেখেছি আমি।

আমি চোরসুবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। মাঝখানে একটা স্টেশনে ট্রেন বদল করে তারপর বেশ খানিকটা হেঁটে ‘বেশ কাজন’ নামের রেস্টুরেন্টে এ গিয়ে প্লভ খেয়েছিলাম। প্লভ খাওয়ার জন্য যে ওয়েটার এসেছিলো তার সাথে আমার কথোপকথন আগের পর্বে বলেছি। সে ঘোড়ার মাংসের প্লভ নেবো কিনা জানতে চেয়েছিল। এখন আর একটু বলি।

রেস্টুরেন্টটা দোতলা, ডুপ্লেক্স স্টাইলের, বিশাল। গমগমে ভীড় আর ভরপুর লোকজন। সুন্দর করে ডেকরেশন করা। বাইরে ‘বেশ কাজন’ লেখাটা উজবেকিস্তানের নকশা করা প্লেট দিয়ে দুর্দান্ত সুন্দর করে সাজানো। সেখানে কাস্টমাররা গিয়ে একের পর এক দলীয় ছবি আর সেলফি তুলছে। বাইরের গাড়ির গ্যারেজের পাশে বিশাল রান্নাঘর। সেখানে বিশাল বিশাল ৮/১০টা চুলায় প্লভ রান্না করা হচ্ছে। ভীড় করে ভিডিও করছে ইউটিউবাররা আর সাধারণ কাস্টমাররা। রান্না আর অর্ডার অনুযায়ী প্লেট সাজানোও চলছে পাশিাপাশি। ইউটিউবারদেরকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে রান্নার ভিডিও করার জন্য। বলা ভালো, আমিও আমার গোপ্রো ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম।

Tashkhand 8

প্লভ এর রান্না ঘর

একপাশে কাউন্টারে কয়েকজন বিল নিচ্ছে। অন্য আর একটা দিকে চা, জুস, আর বেভারেজ এর কর্নার। মানুষজনের সামনে একটা করে বিশাল সাইজের থালা আসছে। সাথে ২সেট করে চামচ। তারা বড় থালার, দুপাশ থেকে দুজন খাচ্ছে বা চারজন খাচ্ছে। বিশাল বিশাল থালা তারা দুজনে খেয়ে শেষও করছে। তাদেন ইনটেকের পরিমাণ আমার কাছে অনেক বেশি বলেই মনে হলো।

ওয়েটারকে আমি বললাম, প্লভের সাথে কোয়েলের ডিম দাও কয়টা? ১টা নাকি ২টা?
সে বললো মিনিমাম ৮টা নিতে হবে।
আমি বললাম, ৪টা নিলে চলে না? দাম কী একই?
সে বললো না ৪টার দাম কম হবে।
আমি বললাম তাহলে মিনিমাম ৮টা বলছো কেন?
সে হেসে বললো, চারটাও নিতে পারো, আটটাও নিতে পারো। আটটা নিলে টেস্ট বেশি হবে।
মনে মনে বলি, আমি তো প্লভের টেস্ট নিতে এসেছি,কোয়েলের ডিমের না।

আমি ৪টাতেই বলবৎ থাকলাম। সে প্লভের প্লেটে কোলেলের ডিম দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে এলো। সাথে স্লাইস পাউরুটির ঝুড়ি আর লাল চা।

খাওয়া শেষে বিল দিয়ে বাইরে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভেতরে এসে জুস কর্নারে গেলাম। একটা লাল রংয়ের জুসের বড় বোতল, লিটার দেড়েক হবে, নিয়ে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম ফ্রেস জুস। মানে ফ্রেস বেদানার জুস। আসলে না, আর্টিফিসিয়াল। তবে খুবই টেস্টি।

চিনি একটা জিনিস বটে, যাতে বেশি পরিমাণ পড়ে সেটাই টেস্টি হয়ে ওঠে। পরে রাস্তার ধারে যারা হাত মেশিন দিয়ে চিপে রস বের করে ফ্রেস জুস বেচে। তাদের কাছ থেকেও ফ্রেস বেদানার জুস খেয়ে দেখেছি। কষ কষ লাগে, কম মিষ্টি। আর দামও অতোটা কম না। ছোট একটা বোতলের দাম, ৩০০ বাংলা টাকার সমান। শুনেছি ১০০ টাকায়ও পাওয়া যাই। আমি অনেক বেশি খুঁজে দেখিনি।

বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। রেস্টুরেন্টের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিলো যাদের সাথে পরিচয় হলো। এরা ভিন্ন ভিন্ন বয়সী। এসেছেন কাজাখস্তান থেকে বেড়াতে। বললো তারা ইন্ডিয়াতেও গেছে কয়েক বার।

আমি জানতে চাইলাম কয়েকবার কেন?
একজন বললো, তুমি কী লোটাস টেম্বল দেখেছো?
আমি বললাম দূর থেকে গাড়িতে বসে কয়েকবারই দেখেছি। ভেতরে যাওয়া হয়নি কখনো।
একজন বললো, তুমি কি জানো ওটা কোন ধর্মের?
আমি ধন্দে পড়ে গেলাম। আমার তো অনুমান ছিলো ওটা হিন্দু ধর্মের!
ওদের মধ্যে যিনি একটু সিনিয়র, মানে ৪০/৪৫ বছর বয়সী, তিনি বললেন ওটা বাহা-ই ধর্মের টেম্পল। তারপর বললেন, এই ধর্মের মূল লক্ষ্য হলো- মানবজাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠা, সব ধর্মকে এক পরিবার হিসেবে দেখা। পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
আমি বললাম, যাক, তোমাদের ধর্ম বিষয়ে জানা গেল।
সিনিয়র জন জানতে চাইলেন, কোন হোটেলে উঠেছি?
আমি হোটেলের নাম বললাম।
তিনি বললেন, আমরা এয়ারপোর্টের দিকে একটা হোটেলে উঠেছি।
রাত ৯টার বেশি বেজে গেছে। কিন্তু বৃষ্টি থামছে না।
সিনিয়র বললেন, কাছেই মেট্রো স্টেশন, চলো কিছুটা ভিজলেও মেট্রোতে করে চলে যাই। আর তোমার তো মেট্রো স্টেশনের কাছেই হোটেল।
আমি বললাম, চলো, আমার কাছে ছাতা আছে। তাদের সাথে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু শুরু করার পর দেখি স্টেশন আর আসে না। এদিকে ভিজে যাচ্ছি। আমার স্নিকার ভিজে যাচ্ছে। কাল সকালে এই ভেজা জুতা নিয়ে আমি কী করবো। আর অনেক ঠান্ডা লাগছে। তাদেরকে বললাম, আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে যাবো। তোমারা চলে যাও ট্রেন স্টেশন। তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল।

আমি একটা যাত্রী ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রী ছাউনির বিস্তার বড় না। বৃষ্টি গায়ে এসে লাগছে, ভয়ানক ঠান্ডা। যাত্রী ছাউনির সাথে একটা ছোট্ট কাঁচঘেরা কনফেকশনারি। একটা ছেলে দোকানদারী করছে।
আমাকে ইশারা করে ভিতরে বসতে বললো। আমি গেলাম, তাকে সালাম দিলাম। সে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো।
বললো চা বা কফি কিছু খাবো কিনা। আমি না করলাম। কনফেকশনারীর ভেতরটা বেশ গরম। হিটিং সিস্টেম ভালো।
কয়েক মিনিট পর ট্রানশ্লেটর অ্যাপে লিখে বললাম, আমি ইয়ানডেক্স কল করি, তুমি ড্রাইভারের সাথে কথা বলে, তোমার এখানে আসতে বলো।
সে বললো, আমি রাশিয়ান, আমাকে রাশিয়ান ভাষায় লিখে জানাও।
আমি তাই করলাম। সে ইয়ানডেক্স ড্রাইভারের সাথে কয়েকবার কথা বললো। এর মধ্যে আবারও চাও সাধলো। আমি বললাম, আমি ফুল হয়ে আছি। এখন কোনো কিছুই খেতে পারবো না।
আমি জানতে চাইলাম, এখানে কি উজবেক ভাষা ছাড়াও রাশিয়ান ভাষায়ও অনেকে কথা বলে?
সে বললো, হ্যা অনেকেই বলে। ৬-১০ পার্সেন্ট মানুষ রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। এছাড়াও তাজিক, কাজাক, তাতার, কারাকালপাক ভাষায়ও কথা বলে।
কিছুক্ষণ পর ইয়ানডেক্সে এর ট্যাক্সি চলে এলো। আমি তাকে রহমত (ধন্যাবাদ) বলে বিদায় নিলাম।

রাতে হোটেলে ফেরার পর মনে হলো রুমটা বেশ ছোট। রিসেপশনে বলতেই, নতুন রুম দেখানোর জন্য লোক পাঠালো। কয়েকটা রুম দেখার পর একটা পছন্দ হলো, ১৩ তলায়। রুমে কিছুক্ষণ থাকার পর মনে হলো রুমটা বেশি গরম। আবার রিসেপশনে যোগাযোগ করলাম। রুম সার্ভিসের লোক এলো। লোকটার বাড়ি রাশিয়াতে। এখানে কাজ করে।

আমি তাকে বললাম, রুম তো বেশি গরম।
সে বললো, শীতের দেশ রুম তো গরম হবেই।
না, বেশি গরম!
শীতকালে রুম শুধু গরম করার জন্য সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম কাজ করে। এটা দিয়ে শীত ও তাপ দুইটা একসাথে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আমি বললাম, তাহলে?
সে বললো, তুমি দরজা খুলে রাখো। বাইরের ঠান্ডা আর ভেতরের গরম মিলে ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বললাম, যদি সাপ পোকামাকড় আসে?
না এমন হওয়ার কথা না। এই হোটেলে এটা হবে না।
যদি ভূত আসে!
সে তো হেসেই অস্থির। তারপর বললো, সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো ভূত নেই।
আমি বললাম, কেন তুমি শোনোনি, ইউরোপ ভূত দেখেছে, ভূত।
সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ফ্যাল ফ্যাল করে। তারপর বললো, এটা সেন্ট্রাল এশিয়া। তারপর শুভ রাত্রি বলে চলে গেল।

পরদিন সকালে গেলাম রিসেপশনে। বললাম, আমার তো আরও ২দিন বেশি থাকা দরকার তোমাদের এখানে। কাল, পরশু না, এক সপ্তাহ পরে আমি সমরখন্দ থেকে ফিরে এসে তোমাদের হোটেলে থাকতে চাই। কতো করে রুম রেন্ট নেবে প্রতি রাতে জন্য?
রিসেপশনিস্ট বললো, ৫০ ডলার প্রতি রাতের জন্য।
আমি বললাম আমি তো ৪০ ডলার করে এগোডা থেকে পেয়েছি।
সে বললো, আমরা ৪০ ডলারে দিতে পারবো না।
আমি বললাম, আমার সাথে সরাসরি ডিল করলে তো প্লাটফর্ম চার্জ দেওয়া লাগে না।
সে বললো, এ ক্ষেত্রে তোমার বুকিং প্লাটফর্ম থেকেই রুম বুক করা ভালো হবে। কারণ আমরা এখানে সিঙ্গেল রুম ৫০ ডলারের কমে দিতে পারি না।
আমি বললাম, ঠিক আছে।

যেহেতু তার সাথে কথা বলে লাভ হলো না, তাই হাঁটা দিলাম রেস্টুরেন্টেন দিকে। নাস্তার পর আমার কাছে থাকা বোতলে পানি ভরার জন্য গেলাম। নিলাম কিছুটা। হোটেলের এক ওয়েটার আমার কাছ থেকে বোতল নিয়ে ভরে দিলো। দেখি গরম পানি দিয়েছে। ভাগ্যিস মুখে ঢেলে দিইনি। পরে সে আমার ইশারা বুঝে আবার ঠান্ডা পানি দিয়ে ভর্তি করে দিলো বোতল।

হোটেল থেকে বের হয়ে, সংলগ্ন মেট্রো স্টেশনে গেলাম। মেট্রো স্টেশনটা মাটির নিচে। নামার সময় দেখি এক গায়ক গিটার বাজিয়ে গান করছে। যেমন আমি অন্যান্য দেশেও দেখেছি। কিছুটা সময় তার গান শুনলাম। উজবেক নয়, ইংরেজি গান। ছেলেটা ভালো গান করে।

তারপর অনেকগুলো সিড়ি ভেঙে নিচে নামলাম। কাউন্টারে গিয়ে ২০ টাকা দিয়ে টিকেট কিনলাম। যেখানেই যাবো ২০ টাকা ভাড়া। আমাদের দেশে এমন না কেন!

একটা কাগজের টিকেট পেলাম। এখানে প্লাস্টিকের কার্ডও আছে, তবে দেওয়া হয় লম্বা মেয়াদের টিকেটের জন্য। ৩০টা রাইডের জন্য ১৫০০০ সোম, বাংলাদেশি ১৫০টাকা, মানে প্রতিবার মেট্রোতে চড়ার জন্য মাত্র ৫টাকা! ভাবতে পারেন, একটা দেশ কেবলমাত্র উন্নয়শীল, তারপরও সেখানে পাবলিক সার্ভিসে নিশ্চয়ই অনেক ভর্তুতি দেওয়া হয়। এখনো এই দেশের মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, তুরষ্ক, রাশিয়াসহ নানা দেশে যায় ভাগ্য ফেরানোর জন্য। সংসার, পরিবার ছেড়ে এই দেশের মেয়েরা কাজ করে নানা দেশে! তারপরও এখানে খাবার দাবারসহ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অনেক সস্তা।

Tashkhand 9

আলিশের নাভোই থিয়েটার হল-তাশখন্দ

আমার গন্তব্য আলিশের নাভোই থিয়েটারে যাওয়া। ট্রেনে এক যুবকের সাথে দেখা হয়ে গেল। সে ইংরেজি শিখছে। কৌতুহলী হয়ে আমাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছে।

আমিও বললাম, চলো ইংরেজি চর্চা করি। তারপর জনতে চাইলাম, সে কি পড়ে, কোন বিষয়ে আগ্রহ তার বেশি, তার বাবা কি করে। তার গন্তব্য এখন কোথায়?
সে বললো, ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি।
আমি বললাম, আলিশের নভোয় থিয়েটারে যাচ্ছি।
নির্দিষ্ট স্টেশনে নামলাম, তারপর দেখি সে আসছে। আমি বললাম, কোথায় যাও?
সে বললো, চলো তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি।
তোমার ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে না?
না, তেমন কিছু দেরি হবে না।
আমরা পৌছে গেলাম আলিশের নাভোই থিয়েটার হলের কাছে।

আলিশের নাভোই ছিলেন উজবেকিস্তানের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক উজ্জল নক্ষত্র। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পপৃষ্ঠপোষক এবং মহান মানবতাবাদী। উজবেক জাতি তাঁকে তাদের জাতীয় কবি ও সাংস্কৃতিক গর্ব হিসেবে মানে। তাশখন্দ, সমরখন্দ কিংবা হেরাত ভ্রমণের সময় তাঁর নাম আপনি প্রায় সর্বত্র শুনবেন- রাস্তার নাম, বিশ্ববিদ্যালয়, থিয়েটার এমন কি মেট্রো স্টেশনের নামও তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

তিনি ১৪৪১ সালে আজকের আফগানিস্তান কিন্তু তৎকালীন তিমুরীয় সাম্রাজ্যের অংশ হেরাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সম্রাট হুসাইন বায়কারার ঘনিষ্ট বন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীসম উপদেষ্টা। তিনি তুর্কি (চাগতাই) ভাষাকে এক উচ্চতর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ফার্সি বা আরবি নয়, তুর্কি ভাষাতেও গভীর দার্শনিক ও কাব্যিক রচনা সম্ভব।

কথিত আছে, হেরাতের প্রাসাদের পাশে তিনি একবার একটি বাগান তৈরি করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে তিনি সেখানে বসে কবিতা লিখতেন। তিনি বলতে, “প্রকৃতি মানুষের আত্মাকে জাগিয়ে তোলে, আর জাগ্রত আত্মাই কবিতার জন্ম দেয়”। আজও হেরাতের মানুষ সেই বাগানের গল্প করে, যেনো সেটি কবির আত্মার প্রতীক হয়ে আছে।

নাভোই শুধু রাজসভাতেই নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। তিনি নিজ অর্থে স্কুল, মাদ্রাসা, সেতু, রাস্তা এমনকি দরিদ্রদের জন্য সরাইখানা তৈরি করেছিলেন। মানুষ বলে, নাভোই না থাকলে, হেরাত শুধু রাজাদের শহর হতো, মানুষের না।

একবার এক সভায়, কেউ তাকে বলেছিল- ফার্সি সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ, তুর্কি ভাষা কি কবিতার জন্য যথেষ্ট পরিণত? নাভোই হেসে বলেছিলেন, ভাষা নয়, ‘হৃদয়ই কবিতার জন্ম দেয়’। এরপর তিনি মুহাকামাত আল-লুগাতাইন নামে গ্রন্থ লিখে প্রমাণ করেন যে তুর্কি ভাষাও গভীর কাব্যের বাহন হতে পারে।

রাজা হুসাইন বায়কারা ও আলিশের নাভোইর বন্ধুত্ব ছিল কিংবদন্তির মতো। রাজা যখন যুদ্ধ ও রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, নাভোই তাঁকে মনে করিয়ে দিতেন- শিল্প আর সংস্কৃতি না থাকলে রাজ্য কেবল ধ্বংশস্তুপে পরিণত হয়।

নাভোই থিয়েটার হল থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাসত-ই-ইমাম দেখবো বলে বের হলাম। কিন্তু ট্যাক্সি আমাকে ব্রডওয়ে নামের একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়েছিল। তারপর এক হৃদয়বান মানুষ ও তাঁর শিশু সন্তানদের সাথে আমার দেখা হয়। সে গল্প আগেই বলেছি। যাদের সাথে হাসত-ই-ইমাম দেখি ও তারপর ফিরে আসি হোটেলে।

ম্যাজিক সিটি

Tashkhand 10

কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে, সন্ধ্যায় আবার বের হলাম। এবারের গন্তব্য ম্যাজিক সিটি দেখা। ম্যাজিক সিটি এক অসাধারণ জায়গা। অনেকটা ডিজনিল্যান্ডের আদলে তৈরি মূল স্থাপত্য আছে এখনে, যা অপূর্ব লাইটিং এর কারণে আর ফোয়ারার সুউচ্চ নান্দনিক নৃত্যে হয়ে ওঠে মনোরম। এখানে আছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট, ওপেন এয়ার শো, ক্যাফে, গেমস কর্ণার, গিফট শপ, আলোর ঝলকানি, শিশুদের জন্য রাইড ও লেক। খুবই দৃষ্টিনন্দন আর আধুনিক একটা পার্ক। রাত্রে বেড়াতে গেলে আকাশ ছোঁয়া ফোয়ারার পানির উৎক্ষেপন আর ডিজনিল্যান্ডের মতো স্থাপনাটির রং বদলাবে আলোকসজ্জার কল্যাণে প্রতি মুহূর্তে। আপনার সন্ধ্যা হয়ে উঠবে মনোরম। এখানে প্রবেশের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না।

এরপর গিয়েছিলাম, সিটি সেন্টার শপিং মলে, এটা তাশখন্দ শহরের একটা অত্যন্ত আধুনিক ও বিলাসবহুল শপিং মল। এখানে আছে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের ফ্যাশন ও লাইস্টাইল স্টোর, ইলেকট্রনিক্স, কসমেটিক্স ও স্থানীয় পন্যের সমাহার। এখানে আছে বিশাল ফুডকোর্ট, শিশুদের খেলার জোন এবং সিনেমা হল। বলে রাখা ভালো এখানে অ্যাপেল স্টোরও আছে।

Tashkhand 11

তাশখন্দ সিটি পার্ক

এই সিটি মলের বাইরে আছে আর এক বিখ্যাত পার্ক নাম সিটি পার্ক। এটি শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাবলিক স্পটগুলোর একটি, যেখানে স্থানীয় মানুষ ও ভ্রমণকারীরা আরাম করে সময় কাটতে আসে। পর্কেও ভেতরে রয়েছে সবুজের বিস্তৃত লন, গাছপলা দিয়ে তৈরি নানা প্রাণীর ভাষ্কর্য, সাজানো বাগান, সুন্দর লেক, হাঁটার পথ ও শিশুদের জন্য খেলার জায়গা। সন্ধার পর যখন আলোকরশ্নি জ্বলে ওঠে, তখন পুরো পার্কটি এক জাদুনগরীতে রূপ নেয়। এখনে শুধু বিশ্রাম নয়, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওপেন-এয়ার কনসার্ট আর ফোয়ারা শো দেখা যায়। আর আশপাশে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, ফুডকোর্ট, ক্যাফে, আর আলোর ঝলকানি।

তাশখন্দ শহরে দেখার আরও অনেক জায়গা আছে। আমি তাশখন্দ পর্ব আজ এখানেই শেষ করছি। সমরখন্দ আর বুখারার গল্প নিয়ে সুযোগ হলে অন্য কোনো পর্বে নিয়ে আসবো।

তাশখন্দে আপনি আরও যা যা অবশ্যই দেখতে যাবেন। সেগুলো হলো, তাশখন্দ মিউজিয়াম, স্টেট মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি, চরশু বাজার, ইনডিপেডেন্স স্কয়ার, মেমোরিয়াল স্কয়ার, মনুমেন্ট অব কারেজ, নবরুজ পার্ক, মিনার মসজিদ, পোলিশ ক্যাথলিক চার্চ, টিভি টাওয়ার, স্টেট মিউজিয়াম অব অ্যাপলায়েড আর্ট, কুলেলদাস মাদ্রাসা, হাসত-ই-ইমাম, ক্যাথলিক চার্চ, আর তাসখন্দের বাইরে, আমিরসই, চিমগাও ও চারবাক মাউন্টেন ভ্রমণ করবেন।

Tashkhand 12

চরশু বাজার: হরেকরকম পণ্যের সম্ভার দিয়ে সাজানো এক বাজার

তাশখন্দে শপিং করবেন সিটি সেন্টার ছাড়াও সমরখন্দ দরভোজা শপিং মল ও চরশুবাজার। আর সমছা, প্লভ ও ডোনার খেতে ভুলবেন না। বাসে আর মেট্রোতে করে শহর রাউন্ড দেওয়ার কথা অবশ্যই মনে রাখবেন।

উজবেক ট্রেন ব্যবস্থা খুবই উন্নত, সে কারণে আফ্রোসিয়াব (দ্রুতগামি) ট্রেনে করে সমরখন্দ ও বুখারা যাওয়ার কথা কথা মনে রাখবেন। আর খিবা ভ্রমণ তো তালিকা থেকে বাদই দেওয়া উচিত না।

রকিব রেজা: উন্নয়নকর্মী।