
বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক সূচকে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এই অর্জনের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে একটি মৌলিক প্রশ্নের ওপ— আমরা কি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং আমাদের রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করতে পারব? টেকসই ভবিষ্যতের জন্য এ দুটি উপাদানই অপরিহার্য।
সু শাসনের অপরিহার্যতা
সু শাসন কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা নয়; এটি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার এবং নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া। আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা জনগণের আস্থাকে ক্ষুন্ন করছে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন টিকিয়ে রাখতে হলে শাসনব্যবস্থাকে অবশ্যই নাগরিকমুখী হতে হবে। কার্যকর প্রশাসন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব নয়।
জনকল্যাণমুখী রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা
রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়, ফলে জনস্বার্থ অনেক সময় অবহেলিত হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণের মতো মৌলিক খাতে নীতি প্রণয়ন প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়। এই ধারা টেকসই হতে পারে না।
জনকল্যাণমুখী রাজনীতি মানে হলো জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলোকে নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রে আনা। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা, তরুণদের কর্মসংস্থান, কৃষকের ন্যায্য দাম বা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা—এসব ইস্যুকেই জাতীয় এজেন্ডার শীর্ষে রাখতে হবে। জনগণের সমস্যার সমাধানেই যখন রাজনীতি পরিচালিত হবে, তখনই গণতন্ত্রে আস্থা ফিরে আসবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সংস্কার
সুশাসন ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতির জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সংসদ ও দুর্নীতি দমন কমিশন যদি স্বাধীন ও কার্যকর না হয়, তবে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানই টেকসই গণতন্ত্রের ভিত্তি।
তরুণ ও নারীর অন্তর্ভুক্তি
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মই আগামী দিনের চালিকাশক্তি। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিতে তাদের কণ্ঠস্বর যথেষ্ট প্রতিফলিত হয় না। একইভাবে, নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশগ্রহণও এখনও সীমিত। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে তরুণ ও নারী নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে। রাজনীতিকে হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, যেখানে সমাজের প্রতিটি শ্রেণিবর্গের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
নৈতিকতা ও জবাবদিহি
দুর্নীতি বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অন্তরায়। ক্ষমতার অপব্যবহার, অস্বচ্ছ সিদ্ধান্ত ও শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো নৈতিক নেতৃত্ব ও কার্যকর জবাবদিহি ব্যবস্থা। রাজনীতির কেন্দ্রে যখন সেবা, সততা ও দায়িত্ববোধ থাকবে, তখনই সু শাসন বাস্তবে রূপ নেবে।
সম্মিলিত দায়িত্ব
সু শাসন ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতি কেবল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নয়। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি খাত এবং সাধারণ জনগণ— সবাইকে এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে। গণমাধ্যম হতে হবে সত্য ও স্বচ্ছতার রক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে নীতি প্রণয়নের উদ্ভাবনী কেন্দ্র, আর নাগরিকদের হতে হবে জবাবদিহির দাবিদার।
টেকসই ভবিষ্যতের পথে
বাংলাদেশের টেকসই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির মানোন্নয়নের ওপর। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে, জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সু শাসন ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতি যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতারও উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
ড. মো. শরীফুল ইসলাম দুলু: পলিটিক্যাল ইনোভেশন এন্ড ট্রান্সফরমেশন স্পেশালিষ্ট।