
খাবারের জন্য ফিলিস্তিনিদের নিত্যদিনের হাহাকার
যুদ্ধের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র হচ্ছে ক্ষুধা। অথচ আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টভাবে বেসামরিক মানুষকে অনাহারে রাখাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলেও, বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এর বিচার হয়। এর ফলে ক্ষুধাজনিত মৃত্যুকে এখনও ‘অবশ্যম্ভাবী দুর্ভাগ্য’ হিসেবে দেখা হয়, ইচ্ছাকৃত সহিংসতা হিসেবে নয়।
১৯৪৩ সালের বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা
১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মানুষ তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মারা যাচ্ছিল। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ১৮ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া সপ্তাহেই ১,৩১৯ জন মারা গেছে। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্ষুধার্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪,৩৩৮ জন, এর মধ্যে প্রায় এক হাজার জন মারা যান। আগস্টের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাস্তায় ও হাসপাতালে পাওয়া যায় ২,৫২৭ জন অনাহারে মৃত মানুষের লাশ।
ভারত তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের অন্যতম ভরসাস্থল। ১৯৪২ সালে জাপানবিরোধী লড়াইয়ের নামে ব্রিটিশ সেনারা বাংলাসহ কয়েকটি অঞ্চলে ‘স্কর্চড আর্থ’ নীতি চালু করে। খাদ্য মজুদ ধ্বংস করা হয়, পরিবহন ব্যবস্থা অচল করা হয়, যাতে জাপানিরা কোনো সরবরাহ না পায়। অথচ এর ভয়াবহ খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে— লাখো মানুষ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
লন্ডনে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট লিও অ্যামারি প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মন্ত্রিসভাকে অনুরোধ করেছিলেন অন্তত পাঁচ লাখ টন শস্য বাংলায় পাঠাতে। কিন্তু ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, চাহিদার এক-চতুর্থাংশেরও কম বরাদ্দ দেয়। পরে অ্যামারি স্বীকার করেন, মন্ত্রিসভা বিষয়টিকে ভারতীয়দের ‘অতিরঞ্জিত কৌশল’ হিসেবে দেখেছিল। অথচ দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধাজনিত মহামারিতে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারান।
সেই সময় ব্রিটিশ সরকার সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশ দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী খবর না দিতে। বরং তারা চাইছিল ‘ভিক্ষুক সমস্যা’র মতো দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের গল্প ছাপাতে, যাতে ক্ষুধাকে দারিদ্র্যের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখানো যায়। কিন্তু দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা সেন্সর ভেঙে বাস্তব চিত্র প্রকাশ করে। যদিও এর ফলে দায়ীদের কোনো আইনি পরিণতি হয়নি।
কেন দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি?
কারণ, যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক আইন প্রণেতারা নিজেরাই খাদ্য অবরোধ ও অনাহারকে যুদ্ধকৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ২০ শতকে খাদ্য অবরোধকে এক ধরনের কার্যকর কৌশল হিসেবে বিবেচনা করত— যা সরাসরি হত্যাযজ্ঞের মতো দৃশ্যমান নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর। ফলে ক্ষুধাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে দেখা হলেও, এর বিচার প্রক্রিয়া কখনও জোরদার হয়নি।
আন্তর্জাতিক আইন ও বাস্তবতা
১৯৭৭ সালের জেনেভা কনভেনশনের অতিরিক্ত প্রটোকলে স্পষ্টভাবে বেসামরিক মানুষকে অনাহারে রাখাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরে রোম স্ট্যাটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এটিকে সরাসরি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।
তবু বাস্তবে এর বিচার হয় না। কারণ, ক্ষুধা-সৃষ্টির প্রমাণ অন্য যুদ্ধাপরাধের মতো সরাসরি দৃশ্যমান নয়। এটি ধীরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এবং নীতির আড়ালে ঘটে। প্রমাণ করতে হয়— এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে, কেবল অব্যবস্থাপনা বা সরবরাহ ঘাটতির কারণে নয়। অবরোধ, অবরোধনীতি বা নিষেধাজ্ঞা সাধারণত “বৈধ” সামরিক কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে ব্যক্তিগত দায় প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কেন এই অপরাধের বিচার জরুরি
কঠিন হলেও বিচার থেকে পিছু হটার সুযোগ নেই। ক্ষুধা যে ক্ষতি করে তা বোমা বা হত্যাযজ্ঞের মতোই ভয়াবহ। এটি সমাজকে ভেঙে দেয়, মানুষের শরীর ও মনের উপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। এবং এ কারণেই ক্ষুধাকে যুদ্ধের কৌশল নয়, যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
গাজায় চলমান পরিস্থিতি আবারও দেখিয়ে দিয়েছে ক্ষুধা কীভাবে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়। যতদিন পর্যন্ত আদালত ও প্রসিকিউটররা ক্ষুধাকে অপরাধ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে বিচার না করবেন, ততদিন পর্যন্ত ক্ষমতাধররা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই ভয়াবহ অস্ত্র ব্যবহার করেই যাবে।
আল জাজিরা থেকে অনূদিত