
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ধর্ম ও রাজনীতির অটুট সম্পর্কের দীর্ঘ এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষণা করেছিল। দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মকে কোনোভাবেই রাজনীতির হাতিয়ার বানানো হয়নি। কিন্তু ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা দেখেছি—রাজনীতি কখনও সরল থাকে না। এখানে ধর্মের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, ভোট ব্যাংক তৈরি এবং সামাজিক প্রভাব বিস্তারের নানা প্রয়াস চালানো হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে হিপোক্রেসি বা ভণ্ডামির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। হিপোক্রেসি মানে হলো একরকম নৈতিকতা বা বিশ্বাস প্রচার করা কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীত কাজ করা। সহজভাবে বলতে গেলে, প্রকাশ্যে ধর্মের পক্ষে কথা বলা আর বাস্তবে তার বিপরীত কাজ করা—এটাই রাজনৈতিক হিপোক্রেসি। বিশেষ করে যখন কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী ধর্মকে ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার বানায়, তখন এটি সমাজের জন্য শুধু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে না, ধর্ম ও নৈতিকতার বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাংলাদেশে কট্টর ডানপন্থী ইসলামি চক্রের উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা একদিকে ধর্মীয় শাসন ও নৈতিকতার দাবিতে আগ্রহি, অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আচরণ পরিবর্তন করছে। একদিকে রোজা পালন ও ইসলামিক বিধি-নিষেধকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে, অন্যদিকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, গীতা পাঠ করছে। এই ধরনের আচরণ রাজনৈতিক হিপোক্রেসির সরাসরি উদাহরন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কৌশল নতুন নয়। বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, ক্ষমতা অর্জন বা ধরে রাখার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্যা হলো, ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থ হাসিল করা হয়, নৈতিকতা নয়। ধর্ম, যা আদতে মানুষের জীবন এবং সমাজকে ন্যায়, সহমর্মিতা ও শৃঙ্খলার দিকে পরিচালিত করে, তা হয়ে ওঠে ক্ষমতার জন্য কৌশল।
হিপোক্রেসি যে সমাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে, তা স্পষ্ট। ধর্মীয় হিপোক্রেসি যখন রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রবেশ করে, তখন মানুষের বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নাগরিকরা ধ্রুব সত্য ও নৈতিকতার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ধর্মের মুখোশ দেখতে পায়। এর ফলশ্রুতিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা জনগণের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
একই সঙ্গে, হিপোক্রেসি রাজনৈতিক চর্চার একটি দিক হিসেবেও দেখা যায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো নানা বাহ্যিক প্রকাশ ও ছদ্ম আচরণ গ্রহণ করে। কখনো ইসলামের প্রচার, কখনো সেকুলারিজমের বাণী, আবার কখনো মধ্যপন্থী নীতি—সবই কেবল ভোট এবং জনপ্রিয়তা অর্জনের কৌশল। এ প্রক্রিয়ায় মূল নৈতিকতা নষ্ট হয়। রাষ্ট্র ও সমাজের স্বচ্ছতা হ্রাস পায়। নাগরিকরা বুঝতে পারে না, কি বিশ্বাসযোগ্য এবং কি নয়।
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—হিপোক্রেসি সবসময় নেতিবাচক অর্থ বহন করে না। কখনো কখনো রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশের উদাহরণে দেখা যায়, এটি মূলত ক্ষমতার জন্য প্রয়োগিত ভণ্ডামি। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো কখনোই নৈতিকতা নয়; এটি প্রতারণা।
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া এই ধরনের হিপোক্রেসি চিহ্নিত এবং প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব পাচ্ছে। সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা জোরদার করা ছাড়া হিপোক্রেসির প্রতিকার কঠিন। রাজনৈতিক নেতা বা দল তাদের আচরণে স্বচ্ছতা, ধর্মীয় নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা বজায় রাখলে এই প্রবণতা কমানো সম্ভব।
এক কথায়, ধর্মের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতা অর্জন বা রাখার প্রক্রিয়ায় হিপোক্রেসি কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি সমাজ ও ধর্মের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ধর্ম কখনো ক্ষমতার হাতিয়ার হতে পারে না। রাষ্ট্র এবং সমাজের স্বাভাবিক ক্রম বজায় রাখার জন্য, নাগরিকদের জন্য নৈতিকভাবে সুসংগত ও ধর্মীয়ভাবে প্রমাণিত আচরণ অপরিহার্য।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একই থাকে—এটি কি নৈতিকতা নাকি প্রতারণা? বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চর্চার আলোকে উত্তর স্পষ্ট: এটি এক ধরনের প্রতারণা। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা শুধুই হিপোক্রেসি। নাগরিকরা সচেতন থাকলে, ধর্ম ও রাজনীতির এই ধোঁকাবাজি চক্র ভেঙে দেওয়া সম্ভব। নৈতিকতা ও সত্যিকারের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করাই সমাজের জন্য একমাত্র উপযুক্ত পথ।
ড. মোঃ শরীফুল ইসলাম দুলু: স্পেশালিষ্ট, সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ইনোভেশন এন্ড ট্রান্সফরমেশন [সিপিআইটি]
এই বিভাগের সব মতামত লেখকের নিজস্ব