বহুদিন ধরেই সিলেট অঞ্চল, বিশেষ করে মৌলভীবাজারের মানুষের কাছে লন্ডন বা ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন যেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। জন্মের পর থেকেই অনেক পরিবারে গড়ে ওঠে প্রবাসে পাড়ি জমানোর আশা। এইচএসসি শেষ করেই অনেকে পড়াশোনা থামিয়ে বিয়ে করে বা দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ যান ছাত্র ভিসায়, কেউ ওয়ার্ক পারমিটে-সব মিলিয়ে লক্ষ্য একটাই, প্রবাসে স্থায়ী হওয়া।
বিসিএস পরীক্ষা বা সরকারি চাকরিজীবন নয়, বরং লন্ডন বা আমেরিকায় পৌঁছানোই অনেকের কাছে হয়ে উঠেছে সম্মান ও গৌরবের প্রতীক। এই মানসিকতাকে পুঁজি করে সিলেটে গড়ে উঠেছে এক বিশাল দালালচক্র ও আদম ব্যবসার নেটওয়ার্ক, যারা প্রবাসের স্বপ্ন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলভীবাজারসহ সিলেটের বিভিন্ন থানায় এবং আদালতে ভিসা জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাগুলোর অভিযোগ প্রায় একই—দালালচক্র ওয়ার্ক পারমিট বা বিদেশি ভিসা দেওয়ার আশ্বাসে অগ্রিম টাকা নেয়, পরে জাল ভিসা বা কস লেটার ইস্যু করে, আবার অনেককে কিছুই দেয় না। টাকা ফেরত চাইলে দালালচক্র গা-ঢাকা দেয়। দালালচক্রের অনেকে দেশ থেকে পালিয়ে প্রবাসে গিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতারণার বড় একটি অংশ দেশে ও বিদেশে থাকা চক্র একসঙ্গে পরিচালনা করছে। বিদেশে থাকা কেউ ভিসা দেওয়ার আশ্বাস দিলে, তার দেশে থাকা আত্মীয় বা এজেন্সির মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করা হয়।
টাকা জোগাড় করতে ভুক্তভোগীদের কেউ জমিজমা বিক্রি করেছেন, কেউ ঋণ নিয়ে শেষ সম্বল হারিয়েছেন। প্রতারিতদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও দারিদ্র্য নেমে এসেছে। অথচ প্রতারকরা সেই টাকায় প্রবাসে বা দেশে আলিশান বাড়ি তৈরি করে বিলাসী জীবনযাপন করছে।
দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হলে এ ধরনের প্রতারণা আরও বাড়বে। তাই বিশেষজ্ঞরা কিছু করণীয় পরামর্শ দিয়েছেন-
১️⃣ দালালের সঙ্গে অবশ্যই লিখিত চুক্তি করবেন এবং তার পরিবারের অন্তত একজন সদস্যকে সাক্ষী রাখবেন।
২️⃣ টাকা পরিশোধ করবেন শুধুমাত্র ব্যাংকের মাধ্যমে।
৩️⃣ ভিসা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ অর্থ প্রদান করবেন না।
৪️⃣ ভিসা ব্যর্থ হলে ফেরতের নিশ্চয়তা হিসেবে চেক সংগ্রহ করুন।
৫️⃣ ভিসা দাতার ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের কপি সংরক্ষণ করুন।
বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন খারাপ নয়, তবে অন্ধভাবে দালালের হাতে জীবন সমর্পণ করা আত্মঘাতী। পড়াশোনা শেষ করে, সঠিক প্রক্রিয়ায় বা সরকারি চ্যানেলে গেলে ঝুঁকি অনেক কম। সরকার যেন দ্রুত বিদেশগামী জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয় এবং দালালচক্রের লাগাম টেনে ধরে-এমনটাই সময়ের দাবি।