
নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা ঘনিয়ে আসছে। আগামীকাল শুক্রবার ঘোষণা করা হবে নোবেল শান্তি পুরস্কার। এ বছরের সম্ভাব্য বিজয়ীদের আলোচনায় একটি নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে সবচেয়ে বেশি—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
হোয়াইট হাউসে ফেরার পর থেকেই ট্রাম্প নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে তুলে ধরছেন। তার দাবি, তিনি অন্তত ‘সাতটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন’। সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের পর ট্রাম্প বলেন, এটি তার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার ফল এবং তিনি ‘অষ্টম যুদ্ধেরও সমাপ্তি’ ঘটিয়েছেন।
এদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে চলমান সংঘাতের মধ্যেই এবারের পুরস্কার ঘোষণা হতে যাচ্ছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য এ বছর ৩৩৮ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। নরওয়ের সংসদ কর্তৃক মনোনীত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি চূড়ান্ত বিজয়ী নির্ধারণ করবে।
ট্রাম্প কেন মনে করেন, তিনি শান্তি পুরস্কারের যোগ্য
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ‘সবাই বলছে, নোবেল শান্তি পুরস্কারটা আমার পাওয়া উচিত। আমি সাতটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছি—কেউ কখনও তা পারেনি।’
তিনি দাবি করেন, তিনি কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড, কসোভো-সার্বিয়া, কঙ্গো-রুয়ান্ডা, পাকিস্তান-ভারত, ইসরায়েল-ইরান, মিশর-ইথিওপিয়া এবং আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছেন।
তবে এসব যুদ্ধের অনেকগুলোতেই ট্রাম্প প্রশাসন নিজেই সরাসরি জড়িত ছিল, এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ট্রাম্পের বাস্তব ‘কৃতিত্ব’ কতটা?
গাজার যুদ্ধের ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে কেউ কেউ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। তার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার পর ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। তবে মার্কিন অস্ত্র ও কূটনৈতিক সহায়তাই গাজার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করেছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধেও ট্রাম্পের ভূমিকা বিতর্কিত। তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে ইরান পাল্টা হামলা চালায় মার্কিন ঘাঁটিতে।
ভারত-পাকিস্তান, কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড ও রুয়ান্ডা-কঙ্গো যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের ভূমিকা আংশিক এবং অনেক সময় যৌথ উদ্যোগের অংশ ছিল।
২০২০ সালে ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে সার্বিয়া-কসোভো চুক্তি করিয়েছিলেন, তবে সেই অঞ্চল এখনও অস্থির।
বিশেষজ্ঞদের মত
ওসলো শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিনা গ্রেগার বলেন, ‘গাজার যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ভূমিকা প্রশংসনীয় হতে পারে, কিন্তু এখনই তাকে পুরস্কৃত করা আগেভাগে হয়ে যাবে।’
তিনি যোগ করেন, ‘ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি অনেক সময় আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিকে গেছে, যা আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’
ট্রাম্পের আগ্রহের পেছনে কারণ
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে নিজের তুলনা টানেন। ওবামা ২০০৯ সালে শান্তি পুরস্কার পান ‘আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সহযোগিতা জোরদারে অসাধারণ প্রচেষ্টার জন্য’—যদিও তখন তিনি মাত্র কয়েক মাস ক্ষমতায় ছিলেন।
ট্রাম্প বলেন, যদি আমার নাম ওবামা হতো, আমি ১০ সেকেন্ডেই পুরস্কারটা পেতাম।
নরওয়ের সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ট্রাম্প নরওয়ের অর্থমন্ত্রী জেন্স স্টলটেনবার্গের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন নোবেল পুরস্কার নিয়ে লবিং করার জন্য।
বিতর্কিত নোবেল ইতিহাস
নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেল চেয়েছিলেন, এটি দেওয়া হবে ‘যিনি জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, স্থায়ী সেনাবাহিনী বিলোপ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক অবদান রেখেছেন’ এমন ব্যক্তিকে।
কিন্তু বাস্তবে পুরস্কারটি বহুবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভিয়েতনাম যুদ্ধের যুদ্ধবিরতি করিয়ে পুরস্কার পান, যদিও তার নীতিতেই কম্বোডিয়ায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ হয়েছিল।
১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের শিমন পেরেস, আইজ্যাক রবিন রবিন এবং প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাত ওসলো চুক্তির জন্য পুরস্কৃত হন, কিন্তু পেরেস নিজেই একাধিক যুদ্ধের নকশাকার ছিলেন।
অং সান সুচি ১৯৯১ সালে পুরস্কার পান গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে, কিন্তু পরে রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় নীরব ভূমিকায় থাকার কারণে সমালোচিত হন।
ওবামার ক্ষেত্রেও সমালোচকরা বলেন, তার পুরস্কারটি ছিল “অকালপ্রসূত”।
ট্রাম্পের মনোনয়ন ও সম্ভাবনা
২০২৫ সালের পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন গ্রহণ শেষ হয়েছে জানুয়ারি ৩১ তারিখে, ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার কয়েক দিন পর।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেট, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের নেতারা যৌথভাবে তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
মার্কিন প্রতিনিধি বাডি কার্টার ও ফাইজারের সিইও আলবার্ট বোরলাও ট্রাম্পকে যোগ্য বলে মনে করেন। তবে জুলাইয়ের পর দেওয়া মনোনয়নগুলো ২০২৬ সালের জন্য গণ্য হবে, যেখানে পাকিস্তান ইতিমধ্যে ট্রাম্পের প্রার্থিতা দিয়েছে।
নোবেল কমিটি এখনো নিশ্চিত করেনি, ট্রাম্পের নাম চূড়ান্ত বিবেচনায় আছে কি না।
যদি ট্রাম্প না জেতেন?
সেপ্টেম্বরে ভার্জিনিয়ায় এক সামরিক সভায় ট্রাম্প বলেন, আমাকে পুরস্কার না দিলে এটা আমেরিকার জন্য অপমান।
তিনি অভিযোগ করেন, ওরা পুরস্কার দেবে এমন কাউকে, যে কিছুই করেনি—অথবা যে আমার মন নিয়ে বই লিখেছে।
নরওয়েতে এ নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে, ট্রাম্প জিততে না পারলে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই দেশটির রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
তবে নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্থ আইড স্পষ্ট করে বলেছেন, নোবেল কমিটি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এতে কোনো ভূমিকা নেই।
যদিও ট্রাম্প নিজেকে ‘শান্তির স্থপতি’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন এবং কয়েকটি সংঘাত সমাধানে তার ভূমিকা ছিল, তবুও তার আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক হামলার নির্দেশ এবং বিতর্কিত পদক্ষেপগুলো নোবেল শান্তি পুরস্কারের মূল চেতনার সঙ্গে কতটা মানানসই—সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আল জাজিরা অবলম্বনে