
মিশরে তিন দিন ধরে পর্দার আড়ালে চলা নিবিড় আলোচনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইসরায়েল এবং হামাস তার প্রস্তাবিত ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, “এর অর্থ, সব জিম্মিকে খুব দ্রুত মুক্তি দেওয়া হবে। একইসাথে, একটি শক্তিশালী, টেকসই ও চিরস্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসরায়েল তাদের সৈন্যদের একটি নির্দিষ্ট সীমানায় ফিরিয়ে আনবে।”
তবে এই প্রথম ধাপের বিস্তারিত বিবরণ তিনি দেননি।
এই সমঝোতা এমন এক সময়ে হলো, যখন ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের চালানো হামলার দুই বছর দুই দিন পূর্ণ হয়েছে। ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল।
এরপর ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই অভিযানে ৬৭, ১০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এই সংখ্যাকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দফতর এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে যে, শুক্রবার সকালেই ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা এই যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।
দেখে নেওয়া যাক এই চুক্তি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে––
কী কী বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে?
চুক্তিটি ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হওয়ায় এখন একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা। তবে বিভিন্ন খবরে জানা যাচ্ছে, রাতের বেলাতেও গাজার কিছু অংশে ইসরায়েলি বিমান হামলা চলেছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনী এমন একটি রেখায় ফিরে আসবে যার ফলে গাজার ৫৩ শতাংশ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত একটি মানচিত্র অনুযায়ী, এটি ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের তিনটি ধাপের মধ্যে প্রথম।
বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, “নতুন (সেনা) মোতায়েন লাইনে (নির্ধারিত এলাকায়) সরে যাওয়ার” প্রস্তুতি চলছে।
এরপরই ৭২ ঘণ্টার একটি গণনা শুরু হবে। এই সময়ের মধ্যে হামাসকে জীবিত বলে ধারণা করা ২০ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে। এর পরপরই মৃত ২৮ জন জিম্মির দেহাবশেষ ফেরত দেওয়ার কথা, যদিও এই প্রক্রিয়া শেষ হতে কতদিন লাগবে তা স্পষ্ট নয়।
একটি ফিলিস্তিনি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, এর বিনিময়ে ইসরায়েলও তাদের কারাগার থেকে প্রায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।
এছাড়া গাজা থেকে আটক আরও ১,৭০০ জনকে ছাড়া হবে।
বন্দিদের পরিচয় এখনো প্রকাশ করা হয়নি, তবে হামাসের জমা দেওয়া তালিকায় এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম ছিল, যারা প্রাণঘাতী জন্য একাধিক যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করছেন।
তবে ইসরায়েলি মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, সবচেয়ে পরিচিত বন্দিদের একজন, মারওয়ান বারঘুতি, এই আদান-প্রদানের আওতায় মুক্তি পাচ্ছেন না।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতিটি ইসরায়েলি জিম্মির দেহাবশেষের বিনিময়ে ১৫ জন গাজাবাসীর মৃতদেহ ফেরত দেবে ইসরায়েল।
একইসাথে, শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ শুরু করবে। উল্লেখ্য, গত আগস্ট মাসেই জাতিসংঘ-সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিশ্চিত করেছিলেন।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ত্রাণ পাঠানোর কথা থাকলেও ফিলিস্তিনি সূত্র বলছে, শুরুতে দৈনিক অন্তত ৪০০ ট্রাক ত্রাণ ঢুকবে এবং পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে।
একজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রায় ২০০ সেনার একটি বহুজাতিক বাহিনী যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করবে, যাতে মিশর, কাতার, তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সৈন্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওই কর্মকর্তার ভাষায়, তাদের কাজ হবে যুদ্ধবিরতি “তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করা এবং কোনো পক্ষ যেন তা লঙ্ঘন না করে, তা নিশ্চিত করা।”
আরেকজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, গাজার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনা মোতায়েন করা হবে না।
এরপর কী হতে পারে?
চুক্তির প্রথম ধাপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। তবে সেই পথ খুব একটা সহজ হবে না, কারণ সেখানে অনেক বিতর্কিত বিষয় রয়েছে।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, উভয় পক্ষ রাজি থাকলে যুদ্ধ “অবিলম্বে শেষ” হয়ে যাবে। গাজাকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করা হবে এবং সেখানকার সব “সামরিক ও সন্ত্রাসী অবকাঠামো” ধ্বংস করা হবে।
গাজার শাসনভার সাময়িকভাবে ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাটদের একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির হাতে দেওয়া হবে। এই কমিটির কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করবে একটি ‘শান্তি বোর্ড’, যার নেতৃত্বে থাকবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বোর্ডে আরও থাকবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।
সংস্কারের পর গাজার শাসনভার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) কাছে হস্তান্তর করা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার শাসনে হামাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভূমিকাই থাকবে না। হামাস সদস্যদের জন্য দুটি পথ খোলা থাকবে- হয় তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ ক্ষমা পাবে, অথবা অন্য কোনো দেশে নিরাপদে চলে যেতে পারবে।
কোনো ফিলিস্তিনিকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হবে না এবং যারা চলে যেতে চাইবে, তারা ভবিষ্যতে ফিরে আসার সুযোগ পাবে।
গাজার অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল “ট্রাম্প অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা” তৈরি করবে।
সম্ভাব্য মতবিরোধ কোথায়?
চুক্তির পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে আলোচনায় বেশ কিছু বিষয়ে বড় ধরনের মতপার্থক্যের আশঙ্কা রয়েছে।
হামাস বরাবরই বলে এসেছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা অস্ত্র সমর্পণ করবে না।
এই পরিকল্পনায় প্রাথমিক সাড়া দেওয়ার সময়ও তারা নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে নীরব ছিল, যা থেকে অনেকে ধারণা তাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
অন্যদিকে, ইসরায়েল যদিও পুরো পরিকল্পনাটিতে সম্মতি দিয়েছে, কিন্তু নেতানিয়াহু যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভূমিকার বিরোধিতা করেছেন।
হামাসও চাইছে “একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি আন্দোলনের” অংশ হিসেবে গাজায় তাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা থাকুক।
সবচেয়ে বড় জটিলতা হতে পারে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের মাত্রা নিয়ে। প্রথম ধাপে তারা গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। হোয়াইট হাউজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে এটি ৪০ শতাংশ এবং পরবর্তীতে ১৫ শতাংশে নামানো হবে।
পরিকল্পনায় একটি “নিরাপত্তা পরিধি” রাখার কথা বলা হয়েছে, যা “গাজা সন্ত্রাসী হুমকি থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত” বহাল থাকবে।
এসব কথার মারপ্যাঁচে পূর্ণাঙ্গ সেনা প্রত্যাহারের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হয়নি, যা নিয়ে হামাস স্পষ্ট অঙ্গিকার চাইবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা




























