রবিবার । ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
ড. শরিফুল ইসলাম দুলু মতামত ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

রাজনৈতিক কো-ব্র্যান্ডিং ও ঘৃণার রাজনীতি: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মর্যাদাহানীর কৌশল


Dulu

বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই আবেগনির্ভর। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে দল, নেতা ও মতাদর্শ—সবকিছুই প্রতীকের মাধ্যমে পরিচালিত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে রাজনীতি শুধু ধারণার প্রতিযোগিতা নয়, হয়ে উঠেছে ব্র্যান্ডের প্রতিযোগিতা। দলগুলো নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ছে পরিকল্পিত রাজনৈতিক যোগাযোগ ও প্রচারের মাধ্যমে।

এই প্রেক্ষাপটে এক বিশেষ কৌশল দৃশ্যমান হয়েছে — রাজনৈতিক কো-ব্র্যান্ডিং। সহজভাবে বললে, প্রতিপক্ষের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে দুই বা ততোধিক দলকে একীভূতভাবে নেতিবাচক পরিচয়ে উপস্থাপন করা।

‘বিএনপি-জামায়াত’ কো-ব্র্যান্ডিং: একটি পরিকল্পিত ফ্রেম
২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে যে রাজনৈতিক যোগাযোগ রণকৌশল নিয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিএনপি ও জামায়াতকে এক ছাতার নিচে ফেলা। গণমাধ্যম, প্রচারপত্র, এমনকি সংসদীয় ভাষণেও দুই দলকে এক নামে তুলে ধরা হয়েছে— ‘বিএনপি-জামায়াত জোট’ বা ‘ধ্বংসাত্মক শক্তি’ হিসেবে।

এই কো-ব্র্যান্ডিং ছিল পারসেপশন ম্যানেজমেন্টের এক নিখুঁত প্রয়োগ। লক্ষ্য ছিল জনগণের মনে এমন ধারণা তৈরি করা, যেন বিএনপি মানেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, উগ্রবাদ বা যুদ্ধাপরাধের ধারক। ফলে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”—যা মূলত স্বাধীনতার পর জাতীয় ঐক্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক ছিল—তা ধীরে ধীরে একটি বিতর্কিত ট্যাগে পরিণত হয়।

রাজনৈতিক সুবিধা বনাম সামাজিক ক্ষতি
এই কৌশল আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিকভাবে সফল হয়েছিল। জনমনে তাদের অবস্থান ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি’ হিসেবে আরও দৃঢ় হয়, আর বিএনপি ক্রমে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যায়। কিন্তু এর সামাজিক মূল্য ছিল ভয়াবহ।
ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি সমাজে গভীর দাগ ফেলেছে। রাজনীতিতে মতবিরোধের জায়গায় এসেছে ব্যক্তিগত বৈরিতা। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জাতীয়তাবাদী ধারাকে ‘অতীতমুখী’ বা ‘অন্ধকার রাজনীতি’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে—যা মূল আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।

বিএনপির ভুল সিদ্ধান্তের দায়ও কম নয়
বিএনপি নিজেও এই ব্র্যান্ডিংয়ের ফাঁদে পড়েছে নিজের কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্তের কারণে। ২০০১–২০০৬ মেয়াদে জামায়াতকে জোটে রাখার সিদ্ধান্ত হয়তো স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ইমেজে ভয়াবহ ক্ষতি আনে।
আওয়ামী লীগ সেই সুযোগে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করে—‘বিএনপি মানেই জামায়াতের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা।’
এরপর থেকে জনমনে ‘জাতীয়তাবাদী রাজনীতি’ আর মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাতন্ত্র্যবোধ নয়, বরং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতীক হিসেবে দেখা শুরু হয়।

ঘৃণার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সংকট
রাজনৈতিক কো-ব্র্যান্ডিং কার্যত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এক ধ্বংসাত্মক উপাদান। যখন প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য ব্র্যান্ডিং অস্ত্র হয়ে যায়, তখন রাজনীতি নীতির লড়াই থেকে সরে গিয়ে ঘৃণার প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়।
আজ আমরা দেখতে পাই—বিএনপির যেকোনো বক্তব্য বা কর্মসূচি বিশ্লেষণের আগে প্রশ্ন ওঠে, ‘এর পেছনে জামায়াত আছে কি না?’। এটি শুধু রাজনৈতিক সন্দেহ নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিভাজনের প্রতিফলন।
এভাবে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার মর্যাদা হ্রাস পায়, এবং রাজনীতি পরিণত হয় দোষারোপ ও অবিশ্বাসের খেলায়।

নতুন রাজনৈতিক সচেতনতার সময়
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন প্রয়োজন নতুন ধরনের সংযম ও বোধ। ঘৃণামূলক প্রচারণা থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতিকে আবার ধারণার প্রতিযোগিতায় ফিরিয়ে আনা দরকার।
বিএনপি-আওয়ামী লীগের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি শুধুই ‘কে বেশি দেশপ্রেমিক’ এই বিতর্কে সীমিত থাকে, তবে গণতন্ত্র আরও দুর্বল হবে। জনগণকে জেতার লড়াই না হয়ে, ঘৃণাকে জেতার প্রতিযোগিতা চলবে।
জাতীয়তাবাদকে ঘৃণার ফ্রেম থেকে মুক্ত করে আবারও উন্নয়ন, আত্মনির্ভরতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ব্র্যান্ডে রূপান্তর করা দরকার। এটি শুধু বিএনপির রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্র ও সমাজেরও নৈতিক দায়িত্ব।

ধারণার লড়াইয়ে ফিরুক রাজনীতি
রাজনীতি কখনোই কেবল ক্ষমতার খেলা নয়; এটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভাষা। তাই রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং যদি মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে, তবে তা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য বিপদজনক।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এখানে প্রয়োজন ঘৃণার রাজনীতি নয়, যুক্তিনির্ভর ধারণার লড়াই। নতুন প্রজন্ম যদি রাজনীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়, তবে তাদের দেখতে হবে — কে বেশি চিৎকার করছে না, বরং কে বেশি চিন্তা করছে।
জাতীয়তাবাদকে ঘৃণার শেকল থেকে মুক্ত করার এই পুনর্জাগরণই হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরবর্তী অধ্যায়।

ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (MIB)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
[এই বিভাগের মতামত লেখকের নিজস্ব]