
ভারতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মুসলমানদের একটি সাধারণ ধর্মীয় অভিব্যক্তি—‘আই লাভ মুহাম্মদ’—নিয়ে তীব্র দমনপীড়ন চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশ হানা দিয়েছে বাজারে, বাড়িতে; শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এমনকি অনেকের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত
ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের কানপুর শহরে ৪ সেপ্টেম্বর ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মুসলমানরা একটি আলোকিত বোর্ডে লিখেছিলেন—“I Love Muhammad”। এই লেখা “I Love New York”-এর আদলে তৈরি করা হলেও স্থানীয় কিছু হিন্দু বাসিন্দা আপত্তি জানান। তাদের অভিযোগ, এই বোর্ড স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী উৎসবে নতুন সংযোজন, যা উত্তরপ্রদেশের আইনে অনুমোদিত নয়।
কিন্তু এর জের ধরে পুলিশ দুই ডজনেরও বেশি মুসলমানের বিরুদ্ধে মামলা করে “ধর্মীয় বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া” অভিযোগে, যার শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল।
ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ
কানপুরের ঘটনায় মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা প্রতিবাদ জানালে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তেলেঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরসহ একাধিক রাজ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে, এমনকি টি-শার্টেও “I Love Muhammad” লেখা দেখা যায় ব্যাপকভাবে।
এর মধ্যে ২৬ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বেয়ারেলি শহরে কানপুরের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এক ইমামের নেতৃত্বে বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পরে পুলিশ ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে ইমাম তাওকির রাজা ও তার আত্মীয়রাও আছেন। অভিযুক্তদের অন্তত চারটি বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়।
আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অভিযোগ
ভারতের সংবিধান নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার দেয়। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং ১৯(১)(এ) অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত। তবু পুলিশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “I Love Muhammad” লেখা বা এমন পোশাক পরিধানের ঘটনাতেও ‘ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানো’ বা ‘অশান্তি সৃষ্টি’র অভিযোগে মামলা করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানিয়েছে, অন্তত ২২টি মামলায় ২,৫০০ মুসলমানের নাম রয়েছে এবং প্রায় ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সংগঠনটির জাতীয় সমন্বয়ক নাদিম খান বলেন, আইনের কোথাও ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা বা লেখা অপরাধ নয়। তাই প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ধারায় মামলা করছে, যাতে ধর্মীয় অভিব্যক্তিকে অপরাধ হিসেবে দেখানো যায়।
তিনি আরও বলেন, ভারতের সর্বত্র হিন্দু দেবদেবীর অস্ত্রধারী মূর্তি, ছবি ও পোস্টার রয়েছে। যদি তা মুসলমানদের জন্য ‘উত্তেজনাকর’ না হয়, তবে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ কেন হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে?
বুলডোজার দিয়ে ঘর ধ্বংস
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে মুসলমানদের বাড়িঘর ভাঙার ঘটনা বেড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো নোটিশ বা আদালতের আদেশ ছাড়াই এই ধ্বংসযজ্ঞ চলে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আগেই বলেছে, বাড়ি ভাঙা কোনো ‘শাস্তি’ নয়, তবে মাঠপর্যায়ে সেই নির্দেশ অনেক সময়ই মানা হয় না।
মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান আকর প্যাটেল বলেছেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা কোনোভাবেই অপরাধ হতে পারে না। এটি শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় অভিব্যক্তি, যাতে কোনো উসকানি নেই। এমন কিছুর জন্য গ্রেপ্তার করা ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডের পরিপন্থী।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের কাজ মানুষের অধিকার রক্ষা করা, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করা নয়। সংবিধান মানা কোনো বিকল্প নয়—এটি সরকারের আইনি বাধ্যবাধকতা।
প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ
২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও সহিংসতা বাড়ছে। নথিভুক্ত ঘৃণামূলক বক্তব্যের সংখ্যা ২০২৩ সালে ৬৬৮ থেকে বেড়ে ১,১৬৫-এ পৌঁছেছে—যা প্রায় ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি। এর বড় অংশই বিজেপি শাসিত রাজ্যে ঘটেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, ভারতে এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে মুসলমানদের যে কোনো ধর্মীয় প্রকাশকেই সহজে ‘উস্কানিমূলক’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। একটি স্থানীয় বিষয় মুহূর্তেই জাতীয় ইস্যু হয়ে যাচ্ছে।
কানপুর ঘটনার পর বিজেপি নেতা-কর্মীরা মোদির নিজ এলাকা বারাণসীতে “I Love Bulldozer” লেখা পোস্টার টাঙিয়েছে—যা অভিযুক্ত মুসলমানদের ঘরবাড়ি ভাঙার ঘটনাকে ঠাট্টা করে দেখানোর প্রতীক বলে মনে করা হচ্ছে।
তরুণ প্রজন্মে ক্ষোভ
এই অভিযানের ফলে মুসলমান তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা দেখা দিয়েছে। এপিসিআর জানায়, “I Love Muhammad” লেখা পোস্ট বা পোশাকের কারণে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেই তরুণ মুসলমান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলির মতে, এই দমনপীড়ন মুসলমান তরুণদের আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এখন এমন অবস্থা যে, শুধু মুসলমান পরিচয়ই যেন অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আল জাজিরা থেকে




























