
ছবি: সংগৃহীত
রোমের এক শীতল সকালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিমানবন্দরের কার্গো গেটে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কয়েকজন বাংলাদেশি। কারো হাতে ফুলের মালা, কেউ আঁকড়ে ধরে আছেন ছোট্ট একটি ব্যাগ—ভেতরে মৃত প্রবাসী স্বজনের কাপড়চোপড়। এ দৃশ্য এখন যেন নিয়মিত হয়ে উঠেছে ইতালির বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবনে।
গত দুই মাসে দেশটির বিভিন্ন শহরে ২৬ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বাকিরা সড়ক দুর্ঘটনা, সহিংসতা বা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছেন।
রোম, নাপোলি, বলোনিয়া, পেরুজিয়া, পিসা ও মনফালকোনে—প্রায় প্রতিটি শহরেই শোকের খবর এসেছে। কেউ ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন, কেউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়, কেউবা কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় বা সহিংস ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
নাপোলির সান জুসেপ্পে এলাকার আব্দুল কাশেম মিয়া প্রতিদিন দুই পালা কাজ করতেন পরিবারে টাকা পাঠাতে। এক রাতে হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে পড়ে যান; স্থানীয় চিকিৎসক জানান, হৃদরোগে মৃত্যু। বলোনিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ঢাকার মো. ফারুক আহমেদ। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে লামপেদুসা উপকূলে প্রাণ হারিয়েছেন ২৯ বছর বয়সী নবীন হোসাইন।
রাজধানী রোমের তিবুরতিনা এলাকার ব্যবসায়ী মো. জুয়েল স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই সপ্তাহে সড়ক দুর্ঘটনায় মাদারীপুরের সাইফুদ্দিন বেপারী ও কাজল নামের আরও দুই বাংলাদেশির মৃত্যু হয়।
ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় শহর মনফালকোনে মারা গেছেন শরীয়তপুরের রায়হান মাঝি। নাপোলির উমবেরতো প্রিমো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন ফেনীর হারুন মাঝি। এ ছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুরের মন্টু মিয়া, সজিব মুন্সী, নয়ন হাওলাদার, সালেহ আহমেদ, আব্দুল দাইয়ান, সুজন বেপারী এবং ফেনির জাকির হোসেন চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে।
পেরুজিয়া শহরে সহিংস ঘটনার শিকার হন মাদারীপুরের রাজৈরের তরুণ সাগর বালা অভি (২১)। পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে একটি বস্তার ভেতর থেকে। তদন্তে জানা যায়, মাত্র একশ ইউরোর জন্য এক ইউক্রেনীয় নাগরিক তাকে হত্যা করেছে।
রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেন, “সেপ্টেম্বর মাসে ৬ জন এবং অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে আরও ৮ জনের লাশ দেশে পাঠানো হয়েছে। আরও দুটি এখন প্রক্রিয়াধীন।” মিলান কনস্যুলেট থেকেও ৭টি লাশ দেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কনসাল জেনারেল রফিকুল আলম।
স্থানীয় প্রবাসী সংগঠনগুলোর দাবি, অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা, অনিয়মিত জীবনযাপন ও চিকিৎসা সুবিধার অভাবই এসব মৃত্যুর মূল কারণ। তারা বলেন, “অনেকে অনিয়মিতভাবে কাজ করেন, ফলে দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার পর সঠিক চিকিৎসা পান না।”
ইতালিতে কর্মরত অধিকাংশ বাংলাদেশি দৈনিক ১০–১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন, অনেকে একাধিক চাকরি করেন টাকার অভাবে। নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা বা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ নেই তাদের জীবনে। চিকিৎসা সুবিধার জটিলতা ও আইনি কাগজের ঝামেলায় অনেকেই হাসপাতালে যেতে চান না সময়মতো।
বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, প্রতিটি মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে এবং লাশ দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া সমন্বয় করা হচ্ছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
ইতালির ছোট ছোট শহরতলিতে এখন প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে নীরব শোক। দূরদেশের ভোরবেলায় ফেসবুকে ভেসে আসে—‘ভাই চলে গেলেন’ বা ‘আজ দেশে পাঠানো হলো’—এমন স্ট্যাটাস। ওপারে বাজে পরিবারের ফোন, কান্না মেশানো কণ্ঠে পৌঁছায় মৃত্যুর খবরটি।