
ছানামুখী ।। ছবি: সংগৃহীত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছেন আর ছানামুখীর স্বাদ নেননি- এমন উদাহরণ হয়ত খুব বেশি পাওয়া যাবে না। জিআই পণ্য (ভৌগলিক নির্দেশক) হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই মিষ্টিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক ঐতিহ্য, যা এখনো সমানভাবেই জনপ্রিয়। এই ছোটখাটো, খুরমার মতো দেখতে ঘনক আকৃতির মিষ্টিটিতে রয়েছে আলতো চিনির আবরণ। আর ভেতরে পুরোটা জুড়ে ছানার পুর। ১৮০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম উজ্জ্বল করছে এই মিষ্টি।
মহাদেব পাঁড়ে থেকে দুলালচন্দ্র পাল
ছানামুখীর ইতিহাসের শুরুটা হয়েছিল মহাদেব পাঁড়ের হাত ধরে। ১৮০ বছর আগে শহরের মহাদেবপট্টিতে (তার নামেই জায়গাটির এই নাম) তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। তিনিই এই বিখ্যাত মিষ্টিটি সর্বপ্রথম তৈরি করেছিলেন। তার আদি নিবাস ছিলো কাশীধামে। কাশী থেকে বড় ভাই দূর্গাপ্রসাদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন মহাদেব। সেখানে ভাইয়ের মিষ্টির দোকানে কাজ করতে করতেই মিষ্টি তৈরিতে হাত পাকান তিনি৷
ভাইয়ের মৃত্যুর পর মহাদেব নিরুদ্দেশ হন। তিনি ব্রাক্ষ্মণ ছিলেন। স্বপাক আহার করতেন। ঘর-সংসার ছিলো না। একসময় কাজের খোঁজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসেন। সেখানে তিনি আশ্রয় পান শিবরাম মোদকের মিষ্টির দোকানে। মহাদেব আসার পর থেকে এ দোকানের সুনাম দিন দিন বাড়তে থাকে।

শহরের মেড্ডায় (বর্তমানে মহাদেবপট্টি) অবস্থিত মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ।। ছবি: সংগৃহীত
শিবরামের ছেলে ছিল না। তাই মারা যাওয়ার আগে শিবরাম এই দোকানটি মহাদেবের নামেই লিখে দিয়ে যান। আর মৃত্যুর আগে মহাদেব দোকানটি অর্পণ দিয়ে যান পার্শ্ববর্তী একটি মন্দিরের হাতে। সেই থেকে চার প্রজন্ম ধরে চলার পর, বর্তমানে এই দোকানটির দায়িত্বে আছেন নারায়ণ মোদক। তিনি সুচারুরূপে চালিয়ে যাচ্ছেন এই ঐতিহ্যবাহী দোকানটি। তার দোকানে ২৫ বছর ধরে কারিগর হিসেবে আছেন গোপাল দাস। তার তত্ত্ববধানে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে মহাদেবের ছানামুখী।
তবে বর্তমানে শহরে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘আদর্শ মাতৃভাণ্ডার’ এর ছানামুখী। এই দোকানে প্রায় ৫০ বছর ধরে ছানামুখী তৈরি করে চলেছেন দুলালচন্দ্র পাল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্যপাড়া এলাকায় দুলালচন্দ্র পালের বাড়ি। তার বাবা প্রয়াত ধীরেন্দ্রচন্দ্র পাল ছিলেন মিষ্টি ব্যবসায়ী। শহরের ডাক্তার ফরিদুল হুদা সড়কে তার অংশীদারি মিষ্টির ব্যবসা ছিল। তাদের প্রতিষ্ঠানটির নাম তখন ছিল ‘জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। ছোটবেলা থেকেই মিষ্টির কারিগরদের কাজ দেখে দেখে মিষ্টি তৈরির কাজ শিখে নেন দুলাল।

বর্তমানে শহরে সবচেয়ে জনপ্রিয় আদর্শ মাতৃভাণ্ডারের ছানামুখী ।। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৬ সালে তাদের দোকানটি বিক্রি হয়ে যায়। কেনেন রাখাল মোদক নামে এক ব্যবসায়ী। তখন দুলালের বয়স মাত্র ১৪ বছর। লেখাপড়া ভালো না লাগায় ততদিনে পড়া ছেড়েছেন। তিনি দোকানে থাকলেন। ছানামুখী বানাতে থাকলেন। তার ছানামুখী আশির দশকের পর থেকে বিখ্যাত হতে লাগলো। এখনো সেই দোকানেই আছেন। তার কাছে এখন পর্যন্ত শতাধিক কারিগর ছানামুখী তৈরির কাজ শিখেছেন।
একসময়ে ৩২ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া ছানামুখীর কেজি বর্তমানে ৭০০ টাকা। দাম বাড়লেও জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। শহরে আদর্শ মাতৃভাণ্ডার, মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশাপাশি ভোলাগিরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছানামুখীরও বেশ খ্যাতি আছে।

ভোলাগিরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছানামুখী ।। ছবি: সংগৃহীত
যেভাবে বানানো হয় ছানামুখী
এক কেজি ছানামুখী তৈরি করতে দুধ লাগবে প্রায় ছয়-সাত লিটার। প্রথমে গরুর দুধ জ্বাল দিতে হবে। এরপর গরম দুধ ঠান্ডা করে ছানা করে নিতে হবে। ছানা আলাদা করতে টুকরিতে রাখতে হয়, এতে পানি ঝরে যায়। পরে পানি ঝরার জন্য ওই ছানা কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এভাবে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখলে ছানা শক্ত হয়। অনেক সময় রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়, এতে ছানা বেশি শক্ত হয়। শক্ত ছানাকে চাকু দিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে কাটতে হবে। এরপর চুলায় একটি কড়াই বসিয়ে তাতে পানি, চিনি ও সাদা এলাচ (গোটা/ গুঁড়ো) দিয়ে ফুটিয়ে শিরা তৈরি করতে হবে। ছানার টুকরাগুলো চিনির শিরায় ছেড়ে নাড়তে হবে। সব শেষে চিনির শিরা থেকে ছানার টুকরাগুলো তুলে একটি বড় পাত্রে রাখতে হবে। ওই পাত্র খোলা জায়গা বা পাখার নিচে রেখে শুকাতে হবে। এভাবে তৈরি হয় ছানামুখী।