
কথিত ফ্রি ভিসাতে এসে দেখা যায় কোনো চাকরি নেই বা কোনো কাজ থাকে না, তখন রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না প্রবাসীদের।
একটি পরিবারের স্বপ্ন, একটি গ্রামের আশা, কিংবা এক মায়ের বুকভরা আকাঙ্ক্ষার নাম ‘বিদেশ যাওয়া’। গ্রামীণ জীবনে এই দুটি শব্দ যেন এক মায়াময় মোহের প্রতীক। মা ভাবে ছেলেটা বিদেশে গেলে সংসারের অভাব ঘুচবে, ভাই ভাবে টেলিভিশন আসবে ঘরে, আর বৃদ্ধ পিতা আশা করেন—জীবনের শেষ বয়সে অন্তত অভাবমুক্ত নিশ্বাস নিতে পারবেন। কিন্তু এই স্বপ্নের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ প্রতারণার গল্প—‘ফ্রি ভিসা’র ফাঁদ।
প্রতিদিন অগণিত তরুণ পাড়ি জমায় বিদেশে, কেউ এজেন্সির দালালের আশ্বাসে, কেউ আত্মীয়ের সহায়তায়, কেউ বা নিঃস্বতার তাড়নায়। তারা ভাবে, কয়েক বছরের কষ্টে পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে, সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়া হবে, ঘরটা হবে পাকা। কিন্তু বিদেশে গিয়ে অনেকেই বুঝতে পারেন, ‘ফ্রি ভিসা’ আসলে মুক্তির নয়, বন্দিত্বের নাম। কাজের নিশ্চয়তা নেই, বৈধ অবস্থান নেই, শুরু হয় অনিশ্চয়তার জীবন, অবৈধভাবে ঘুরে বেড়ানো, এমনকি কারাগার বা দেশে ফেরত আসার করুণ পরিণতি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ‘ফ্রি ভিসা’ বলে কোনো বৈধ ব্যবস্থা নেই। এটি এক ধরনের অবৈধ লেনদেন, যেখানে কোনো স্পনসর কেবল দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়, কিন্তু চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। আর এই সুযোগেই সক্রিয় দালালচক্র। তারা গ্রামীণ সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়—‘ফ্রি ভিসা’, ‘সহজ চাকরি’, ‘কম সময়ে যাত্রা’।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)-এর এক জরিপে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত খরচের তুলনায় গড়ে পাঁচ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করছেন বিদেশগামী শ্রমিকরা। এর বড় অংশই চলে যায় দালাল ও অসাধু এজেন্সির পকেটে। ৭২ শতাংশ কর্মী ঋণ নিয়ে, ১১ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে, আর ৬ শতাংশ পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে যান। কিন্তু এত ত্যাগের পরও প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি কর্মী গন্তব্যে গিয়ে কাজ পান না।
এই দালালচক্র মূলত এক অবৈধ বাজার তৈরি করেছে, যেখানে বিক্রি হয় মানুষের স্বপ্ন, নিলামে ওঠে জীবনের নিরাপত্তা। যদিও আইন অনুযায়ী বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই কর্মী পাঠানোর কথা, বাস্তবে মাত্র ৭ শতাংশ কর্মী তা অনুসরণ করেন। ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গড়ে উঠেছে এক বিশাল অবৈধ অর্থনীতি।
সরকার নানা সময়ে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ, রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা—এসব উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা, প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ ও দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে ফল আসেনি। এখন সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। এজন্য যা করতে হবে:
১️) অবৈধ দালাল ও প্রতারণামূলক এজেন্সির বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
২️) সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি রাখা।
৩️) তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে মানুষ বুঝতে পারে ‘ফ্রি ভিসা’ কোনো সুযোগ নয়, বরং এক ভয়াবহ ফাঁদ।
৪️) দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন কার্যক্রম জোরদার করা।
দক্ষ কর্মী মানেই বেশি আয়, নিরাপদ পরিবেশ ও প্রতারণার ঝুঁকি কম। তাই বিদেশে শুধু মানুষ পাঠানো নয়, বরং মানসম্পন্ন শ্রমশক্তি তৈরি করাই এখন সময়ের দাবি। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ, বিদেশের শ্রম আইন ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের ওপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে প্রতিটি কর্মীকে।
‘ফ্রি ভিসা’ শব্দটি যতটা মুক্তির প্রতীক মনে হয়, বাস্তবে এটি এক নিঃশব্দ শৃঙ্খল। এটি তরুণদের ঘাম, শ্রম ও স্বপ্নকে বেঁধে ফেলে শোষণের জালে; কেড়ে নেয় তাদের মর্যাদা, কেড়ে নেয় পরিবারের হাসি। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়, আইন দুর্বল থাকে, আর সমাজ নীরব দর্শক হয়—তবে প্রতারণা যে বাড়বেই, তা নিশ্চিত।
তাই এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর আইনি প্রয়োগ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক তৎপরতা। নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকা হতে পারে এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার আলো।
একজন প্রবাসী প্রতারণার শিকার হলে ক্ষতি কেবল তার নয়—তার পরিবারের, সমাজের, এমনকি দেশের অর্থনীতিরও। তাই এখন সময় এসেছে ‘ফ্রি ভিসা’র মিথ ভাঙার। প্রবাস যাত্রা যেন হয় বৈধ, স্বচ্ছ ও মানবিক প্রক্রিয়া—এটাই রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব।