
‘পাষাণপুরী গুমরে কাঁদে অশ্রুজমা চোখে/ ইতিহাস দরজা খুলে তাকালো আলোকে/ যেন হাজার বছর পরে/ নির্জনতার ঘুম ভাঙাতে এলো, এলো যে, এলো যে/ এক রাজকুমারী…’
লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা এই গানটির সুর ও কণ্ঠ ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। এই গানটির কথাগুলোর মতোই এক ছাইচাপা রহস্য লুকিয়ে আছে এই ঢাকা শহরের বুকে। ঠিক রাজকুমারী না হলেও এই রহস্যের সাথে জড়িয়ে আছে এক অজ্ঞাতপরিচয় সুবেদার কন্যার নাম।
যদি কখনো রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার তিন রাস্তার মোড় থেকে বাঁশবাড়ীর দিকে যান, তবে যাওয়ার পথে চোখে পড়বে একটি পুরনো স্থাপনা। যা এলাকায় অজানা সমাধি নামে পরিচিত। অনেক রাতে এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়লে হতে পারে শিহরণ জাগানো অনুভূতি। এটা কার কবর তা স্পষ্ট জানা যায় না। এদিকটা কবরের পেছন দিক। সামনাসামনি দেখতে হলে যেতে হবে ঐতিহাসিক সাত মসজিদের কাছে। এটি পড়েছে মোহাম্মদপুরের চানমিয়া হাউজিং এলাকায়। স্থানীয় যে কাউকে বললেই অবস্থান জানতে পারবেন।

রহস্যে ঘেরা সেই সমাধিসৌধ ।। ছবি: সংগৃহীত
ইতিহাস বলছে, ১৬৮০ সালের দিকে নবাব শায়েস্তা খাঁ’র পুত্র উমিদ খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ রাজত্ব করে গেছেন।
মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের কিছু এলাকায় মসজিদটির ইতিহাস ঘিরে আছে নানা রকম গল্প। কারও কারও ধারণা, ‘মসজিদটি গায়েবি’। প্রচলিত আছে, এক সময় এখানে কোনো মসজিদ ছিল না। এক রাতের মধ্যে গায়েবিভাবে মসজিদটি জেগে ওঠে। এমন রটনাও আছে যে, উমিদ খাঁ ‘জ্বীন’-দের দিয়ে একরাতে মসজিদটি নির্মাণ করেন! তবে এসব কথার কোনো প্রমাণ নেই। এমন কথাও লোকমুখে প্রচলিত আছে, গায়েবি হওয়ায় এতে কোনো ধরণের রং করা সম্ভব হয় না।

সাত গম্বুজ মসজিদ ।। ছবি: সংগৃহীত
যদিও এর ব্যাখ্যা আছে। ইতিহাসবিদদের মতে, মসজিদটি সিরামিক বা চুনামাটি দিয়ে তৈরি। ফলে এতে কোনো ধরণের রং ধরা সম্ভব নয়। মোগল শাসনামল ও তার কাছাকাছি সময়ের অন্যান্য স্থাপনা দেখলেও দেখা যায়, সাত গম্বুজ মসজিদসহ সকল স্থাপনার নির্মাণ কৌশল প্রায় একই রকম।
মসজিদের অদূরেই নবাবি কায়দায় নির্মিত সমাধির তোরণ। কথিত আছে, নবাব শায়েস্তা খাঁর কোনো এক মেয়ের কবর এটি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। সাইনবোর্ডে লেখা: অজানা সমাধি। সেখানে আরও লেখা রয়েছে: ‘এই সমাধি ভবনটি খুব সম্ভবত সাত গম্বুজ মসজিদের একটি অচ্ছেদ্য স্থাপনা। স্থানীয়ভাবে পরিচালিত।’
সমাধির উত্তর-পূর্ব কোণে আরও দুটি কবর রয়েছে। এর মধ্যে একটি খাদেম ইউসুফ শাহ-এর। আরেকটি তার স্ত্রী সোনাভানু বেগমের।
তবে বংশপরম্পরায় সমাধির তদারককারী শাহজাহান সাজু মনে করেন, শায়েস্তা খাঁর মেয়ে নয়; বরং সাত গম্বুজ মসজিদের অন্যতম নির্মাতা ফয়জুদ্দীন শাহ সুলতানের কবর এটি।

কবরের বর্তমান অবস্থা ।। ছবি: সংগৃহীত
কবরটি দেখার জন্য ভেতরে প্রবেশে তেমন একটা বাধা নেই। কবরটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘বিবির মাজার’ নামে, তবে একে ঘিরে কোনো মাজার আগেও ছিল না, পরেও গড়ে তোলা হয়নি। এটি সাধারণ কবর। কবরটি লাল কাপড়ে ঢাকা। উপরের দিকটার চারপাশজুড়ে লাল ও সবুজ কাপড়ের সামিয়ানা।
এখানে তেমন ভিড় কখনোই থাকে না। রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কঠোরতা নেই। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি এক অজানা সমাধি নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, ১৬৮৪ সালে শায়েস্তা খাঁ’র কন্যা ইরান দুখতের (পরীবিবি) মৃত্যু হয়। তবে কাছাকাছি সময়ে তার অন্য কোনো কন্যারই মৃত্যুর কোনো স্পষ্ট বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তাই এটি শায়েস্তা খাঁ’র কন্যার সমাধি, এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। আবার ফয়জুদ্দীন শাহ সুলতান কবে মারা গেলেন বা কীভাবে মারা গেলেন তারও কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাই এই সমাধিটি কার সেটি এখনো অজানা। হয়ত এই রহস্য কখনোই ভেদ হবে না। না হলেও ক্ষতি নেই, সব রহস্য ভেদ হলে পৃথিবী তার সৌন্দর্য হারাবে।