
অক্টোবর মাসের নাম উঠলেই অনেকের মনে একটাই উৎসব ভেসে ওঠে—হ্যালোইন। এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে শিহরণ জাগানো গল্প, মিষ্টি-চকোলেট, আর সাহসী পোশাকের রাত; এক রাত, যেদিন সারা বিশ্ব জুড়ে চলে ভূতের সিনেমা, ভয়ানক বাড়ি ঘুরে দেখা, আর অবশ্যই হাইডি ক্লুমের কিংবদন্তি পোশাকের প্রদর্শনী।
তবে আজকের হাসিখুশি, ক্যান্ডি-ভরা, কস্টিউম-পার্টির হ্যালোইন শুরু থেকেই এমন ছিল না। আসলে, হ্যালোইনের ইতিহাস বহু পুরোনো ও জটিল—যার শিকড় ছড়িয়ে আছে নানা মহাদেশ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ভেতর। ঋতু পরিবর্তনের তাৎপর্য, আত্মিক বিশ্বাস, আর মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চিন্তা—সবকিছু মিলেমিশে তৈরি করেছে এই উৎসবের অনন্য রূপ।
চলুন, জানা যাক কীভাবে জন্ম নিয়েছিল হ্যালোইন—পৌত্তলিক যুগের উৎসব থেকে আজকের ক্যান্ডির রাতে পৌঁছানো পর্যন্ত এর যাত্রাপথ।
হ্যালোইনের সূচনা কোথায়?
হ্যালোইনের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছর পুরোনো। এর সূচনা হয়েছিল কেল্টিকদের পৌত্তলিক উৎসব স্যামহেইন (উচ্চারণ: “সাও-ইন”) থেকে। আইরিশ ভাষায় স্যামহেইন মানে “নভেম্বর”; এই উৎসব শুরু হতো অক্টোবরের শেষ রাতে—৩১ অক্টোবর। সেদিন মানুষ আগুন জ্বালিয়ে নাচত, গান গাইত, ও ফসল তোলার আনন্দে ভোজ করত।
শুনে মজার মনে হলেও এই উৎসবের মূল ভাবনা ছিল গভীর। স্যামহেইন ছিল গ্রীষ্মের সমাপ্তি ও শীতের সূচনার সময়—অর্থাৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা এক সময়। ইতিহাসবেত্তা ড্যান মরিস বলেন, “এটা এমন একটা সময়, যখন অন্ধকার সূর্যকে পরাস্ত করে, দিন ছোট হতে থাকে। তখনই বিশ্বাস করা হতো, জীবিত ও মৃতের মাঝের পর্দা সবচেয়ে পাতলা হয়ে যায়, আর মৃত আত্মারা ফিরে আসে তাদের প্রিয়জনদের দেখতে।”

হ্যালোইনের রাতে তিন তরুণী ।। ছবি: সংগৃহীত
যদিও শুনতে ভয়ানক, আধুনিক যুগের অনেক পৌত্তলিক বা “উইক্কান” ধর্মাবলম্বীর কাছে এটা মোটেও ভয়ের বিষয় নয়। ম্যাসাচুসেটসের সেলেম শহরের ক্যাবট কেন্ট হারমেটিক টেম্পল-এর পুরোহিত জেসন মায়ার্সের মতে, “এই উৎসব মৃত্যুকে নয়, বরং জীবনের চক্রকে উদযাপন করে। যেমন শীতের পর বসন্ত আসে, তেমনি মৃত্যুর পরও আত্মা নতুনভাবে জন্ম নেয়—নতুন শিক্ষার সাথে।” স্যামহেইনের রাতে অনেকে আগামীর আশীর্বাদ কামনায় ইতিবাচক সংকল্প স্থির করেন।
আত্মার ঋতু
শুধু কেল্টিকরাই নয়, পৃথিবীর অনেক সংস্কৃতিই শরতের এই সময়টিকে জীবিত ও মৃতের মিলনের মুহূর্ত হিসেবে দেখেছে। জ্যোতিষী চানী নিকোলাস বলেন, “বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই সময়টিকে এমন এক সময় মনে করা হয়, যখন দুই জগতের মাঝের পর্দা পাতলা হয়ে যায়।”
তিনি আরও জানান, ৩১ অক্টোবর হলো বছরের একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিদ্যাগত মুহূর্ত—যা সেপ্টেম্বরের বিষুব ও ডিসেম্বরের অয়নান্তের মাঝামাঝি পড়ে। “আলো ও অন্ধকারের ভারসাম্য বদলের এই সময় আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পরিবর্তনই জীবনের প্রকৃতি,” বলেন নিকোলাস।
এ কারণেই মেক্সিকোর বিখ্যাত দিয়া দে লস মুয়ের্তোস বা মৃতদের দিবস পালিত হয় নভেম্বরের ১ তারিখে—প্রাচীন মেসোআমেরিকান ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। এই উৎসবও মৃত আত্মাদের স্মরণ করে। নিকোলাস বলেন, “এই সময় আমরা অন্ধকার ও মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হই, যাতে বুঝতে পারি মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়, বরং এক নতুন রূপান্তর।”

১৯৭০ এর দশকে আমেরিকায় হ্যালোইন উদযাপন, ছবি: সংগৃহীত
পোশাক আর সোল কেক
প্রাচীন কেল্টিকরা বিশ্বাস করত, স্যামহেইনের রাতে ভালো ও মন্দ—দু’ধরনের আত্মাই ঘুরে বেড়ায়। মন্দ আত্মাদের থেকে লুকোতে এবং ভালো আত্মাদের সন্তুষ্ট করতে তারা পশুর চামড়া ও মাথা পরে ছদ্মবেশ নিত। এই প্রথা থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় মুখোশ ও কস্টিউম পরার রীতি।
সেই সময় আত্মাদের উদ্দেশে খাদ্য ও পানীয়ও উৎসর্গ করা হতো। পরবর্তীকালে মানুষ আত্মাদের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গাইত বা কবিতা শুনিয়ে খাবার চাইত। মধ্যযুগ পর্যন্ত এই প্রথা টিকে ছিল, এবং তখন “সোল কেক” নামে ছোট গোলাকার মিষ্টি কেক—দারচিনি ও জয়ফল মেশানো—দেওয়া হতো পুরস্কার হিসেবে।
হ্যালোইন ও ‘অল সেইন্টস ডে’
খ্রিস্টধর্ম ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর চার্চ অনেক পৌত্তলিক রীতিকে নিজেদের উৎসবের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। অষ্টম শতকে পোপ গ্রেগরি তৃতীয় অল সেইন্টস ডে—বা অল হ্যালোজ ডে—এর তারিখ মে মাস থেকে সরিয়ে নভেম্বরের ১ তারিখে নির্ধারণ করেন। ফলে অক্টোবরের ৩১ তারিখ হয়ে ওঠে অল হ্যালোজ ইভ, যা পরবর্তীতে সংক্ষেপে “হ্যালোইন” নামে পরিচিত হয়।
প্রকাশক নিক ওয়েলস বলেন, “খ্রিস্টীয় ‘অল হ্যালোজ ইভ’ আসলে পুরোনো কেল্টিক রীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল—যেমন ইউরোপের প্রায় সব প্রাচীন ধর্মীয় উৎসবই স্থানীয় ঐতিহ্যের রূপান্তর।”
আমেরিকায় হ্যালোইনের আগমন
আধুনিক হ্যালোইন আমেরিকায় এসেছে মূলত আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষের সময়, ১৮৪০-এর দশকে। সেই সময় প্রায় দেড় মিলিয়ন আইরিশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁদের আত্মিক বিশ্বাস ও পৌরাণিক ঐতিহ্য।
প্রথমে এটি ছিল গ্রামীণ উৎসব, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ধীরে ধীরে শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শিল্পকলা ও পোশাক-নকশা বিশেষজ্ঞ চেলসি লরেন বলেন, “১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে হ্যালোইন পরিণত হয় পারিবারিক উৎসবে—যেখানে ভয় নয়, বরং মজা, কস্টিউম ও কমিউনিটি গ্যাদারিং ছিল মূল আকর্ষণ।”

বর্তমানে হ্যালোইন হয়েছে ফ্যাশন ও সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ ।। ছবি: সংগৃহীত
‘ট্রিক অর ট্রিট’-এর জন্ম
তবে সেই সময়ের হ্যালোইন একেবারেই নিরীহ ছিল না। ২০ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত হ্যালোইন ছিল দুষ্টুমি আর বিশৃঙ্খলার রাত। কিশোররা আগুন জ্বালাত, সম্পত্তি নষ্ট করত, এমনকি প্রতিবেশীর পশু পর্যন্ত ছেড়ে দিত। তখন এটি ছিল একপ্রকার ‘জুভেনাইল ডেলিনকোয়েন্সি’।
চকলেট বা ক্যান্ডি দেওয়া শুরু হয় একধরনের ঘুষ হিসেবে—যাতে শিশুরা বাড়িঘর নষ্ট না করে। কোনো বাড়ি যদি ‘ট্রিট’ না দিত, তাহলে তারা ময়দা ছুড়ে মারত বা জানালা ভাঙত। সেই থেকেই কথাটা জনপ্রিয় হয়—Trick or Treat!
এই বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে ১৯২০ ও ’৩০-এর দশকে সমাজে আয়োজন শুরু হয় প্যারেড, মুখোশ উৎসব ও তত্ত্বাবধানে ট্রিক-অর-ট্রিটিংয়ের। একই সময়ে প্রকাশিত হয় The Book of Hallowe’en ও Dennison’s Bogie Book—যেখানে ঘর সাজানোর আইডিয়া, গেমস ও পার্টির টিপস দেওয়া ছিল। ইতিহাসবিদ স্টিভেন ইন্টারমিল বলেন, “এসব বই হ্যালোইনকে পরিবার-বান্ধব ও সৃজনশীল উৎসবে পরিণত করেছিল।”

আধুনিক রূপ: কুমড়ার প্রদীপ থেকে কার্টুন ভূত
১৯৫০-এর দশক নাগাদ হ্যালোইন পুরোপুরি বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়। ওয়ার্নার ব্রাদার্স, ডিজনি, হান্না-বারবেরা প্রমুখ স্টুডিও তৈরি করে ভূত, জাদুকরী ও কঙ্কালকে কেন্দ্র করে শিশুদের জন্য মজার কার্টুন। ১৯৫০ সালে আসে Casper the Friendly Ghost, আর ১৯৬৬-তে জনপ্রিয় টিভি স্পেশাল Charlie Brown and the Great Pumpkin।
এ সময় থেকেই স্কুলগুলোতে শুরু হয় কুমড়া কেটে প্রদীপ বানানোর প্রতিযোগিতা—‘জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন’ কনটেস্ট। বিজয়ীরা পেতেন ক্যান্ডি কর্ন—যা হ্যালোইনের প্রতীক হয়ে ওঠে।
তবে আসলে এই রীতি এসেছে প্রাচীন স্যামহেইন থেকে। আইরিশরা তখন কুমড়া নয়, বরং শালগম কেটে প্রদীপ বানাত। কিংবদন্তি অনুসারে “স্টিঞ্জি জ্যাক” নামে এক ব্যক্তি কূটকৌশল করে শয়তানকে নরক থেকে বের করে, আর পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় এক জ্বলন্ত কয়লা হাতে—যেটি সে শালগমে রেখে প্রদীপ বানায়। এই গল্প থেকেই মানুষ বিশ্বাস করত, ঘরে শালগম বা কুমড়া কেটে মুখ বানালে খারাপ আত্মা দূরে থাকে।
আজকের রঙিন, ক্যান্ডি-পূর্ণ হ্যালোইনের ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রাচীন আচার, অন্ধকারের দর্শন, আর মৃত্যুর পর জীবনের প্রতি এক নিঃশব্দ শ্রদ্ধা। তাই পরেরবার যখন আপনি কুমড়া কেটে মুখ বানাবেন বা বাচ্চাদের ক্যান্ডি দেবেন, মনে রাখবেন—আপনি আসলে অংশ নিচ্ছেন হাজার বছরের পুরোনো এক আধ্যাত্মিক যাত্রায়, যা মানুষকে শিখিয়েছে ভয়কে নয়, পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতে।