
১৩ নভেম্বর বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন
বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ এমন এক লেখক, যিনি রাজনীতিকে কখনো মঞ্চে আনেননি, কিন্তু তাঁর চরিত্র, সংলাপ ও পরিবেশ—সবকিছুতেই রাজনীতি নীরবে উপস্থিত।
তিনি ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক প্রচারক, বরং এক গভীর সামাজিক পর্যবেক্ষক। তাঁর লেখায় দেখা যায় ক্ষমতার নির্মমতা, রাষ্ট্রের তৈরি ভয় এবং সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের সূক্ষ্ম চিত্র।
‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’, ‘হিমু রিমান্ডে’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘দেয়াল’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’, কিংবা ‘প্রিয়তমেষু’—এই সব উপন্যাসই তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতার ভিন্ন ভিন্ন দিক উন্মোচন করে।

“ন্যায়বিচার মানে কি ভয় দেখানো?” এই সংলাপ ও প্রতিবাদই হুমায়ূনের রাজনৈতিক ভাষা
হিমু: নৈরাজ্যের ভেতর নীরব প্রতিবাদ
হুমায়ূনের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় প্রতীকী চরিত্র হিমু আসলে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রতি এক আত্মিক বিদ্রোহের প্রতীক।
সে চাকরি করে না, টাকা চায় না, কর্তৃত্ব মানে না—বরং নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে হাঁটে।
‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’-এ এই হিমু রাষ্ট্রীয় দমনযন্ত্রের মুখোমুখি হয়।
র্যাব—যে সংস্থার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলার নামে কখনো কখনো নাগরিক স্বাধীনতার ওপর ভয় ও দমন চালানোর অভিযোগ ওঠে—তার কালো পোশাকের বিপরীতে হিমুর হলুদ জামা হয়ে ওঠে প্রতীকী প্রতিরোধের রঙ।
‘হিমু রিমান্ডে’-তে এই প্রতিরোধ আরও স্পষ্ট। রিমান্ডের নামে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও ভয়ের সংস্কৃতি নিয়ে হুমায়ূন লিখেছেন সাহসের সঙ্গে।
হিমু এখানে শুধু চরিত্র নয়, বরং এক প্রশ্নচিহ্ন—যেন কোনো নাগরিকের মুখ থেকে রাষ্ট্রের দিকে ছোড়া নীরব প্রশ্ন:
“ন্যায়বিচার মানে কি ভয় দেখানো?” এই সংলাপ ও প্রতিবাদই হুমায়ূনের রাজনৈতিক ভাষা।

এখানে হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন—রাজনীতি কেবল শাসকদের নয়, নাগরিকদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে
‘কোথাও কেউ নেই’: জনমত, বিচার ও মিডিয়া রাজনীতি
‘কোথাও কেউ নেই’-এর গল্প প্রথমে প্রেমের মতো মনে হলেও এর ভেতর লুকিয়ে আছে বিচার ও ক্ষমতার রাজনীতি।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেবল এক অপরাধীর বিচার নয়; বরং ক্ষমতা প্রদর্শনীর প্রতীক—যেখানে জনমতও একাত্ম হয়ে যায় অন্যায়ের প্রতিবাদে।
উপন্যাসটিতে কুত্তাওয়ালী ও তার খদ্দেররা যেভাবে সমাজে ভদ্রজন সেজে থাকেন আর বাকের ভাইয়ের মতো মানুষকে যেভাবে সমাজ দেখে- তা আসলে এক ভয়ংকর সামাজিক মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করে। এখানে হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন—রাজনীতি কেবল শাসকদের নয়, নাগরিকদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে।
মানুষ ভয় ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার পাবার আশা করে—যেন এটিই কাম্য, কিন্তু এর বাইরের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি তারা হতে চায় না।

‘দেয়াল’ তাই হয়ে ওঠে ক্ষমতা ও মানবতার সংঘাতের এক অন্তর্গত দলিল
‘দেয়াল’: ইতিহাসের রক্তাক্ত পর্দা
‘দেয়াল’ হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা এবং সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্ট রাজনৈতিক উপন্যাস।
এখানে তিনি ১৯৭২-৮১ সালের বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, বাকশাল কায়েম, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখেছেন এমন সময়ে, যখন বিষয়টি ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল।
‘দেয়াল’-এ তিনি ইতিহাসকে বিচার করেননি, বরং প্রশ্ন করেছেন—একটি দেশের ইতিহাস কতবার হত্যা ও ক্ষমতার মাধ্যমে লেখা যায়?
তাঁর ভাষা সংযত, কিন্তু তাতে ইতিহাসের নৈতিক বেদনা স্পষ্ট। তিনি দেখিয়েছেন, রাজনীতি যদি মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তবে সেটি কেবল সহিংসতার আয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
‘দেয়াল’ তাই হয়ে ওঠে ক্ষমতা ও মানবতার সংঘাতের এক অন্তর্গত দলিল।

এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অন্ধকার আয়না
‘মাতাল হাওয়া’: গুন্ডা রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা
‘মাতাল হাওয়া’ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ রাজনীতির এক ভয়ংকর বাস্তবতা দেখিয়েছেন—গুন্ডা রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতির দখলদারিত্ব।
এখানে খোকা ও পাঁচপাত্তুর নামের বাস্তব দুই চরিত্র এনএসএফ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স)-এর অংশ, যারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুন্ডামি চালায়।
তাদের হাতে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, এমনকি শিক্ষকরাও নিরাপদ নয়।
এই উপন্যাসের পটভূমিতে ৬০-এর দশকের রাজনৈতিক সহিংসতা এবং একনায়কতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।
হুমায়ূন দেখিয়েছেন, রাজনীতি যখন নৈতিকতার বদলে ক্ষমতার যন্ত্র হয়ে ওঠে, তখন মানুষ নিজের দেশেই বন্দি হয়ে পড়ে। ‘মাতাল হাওয়া’ তাই কেবল ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অন্ধকার আয়না।

এই উপন্যাসে তিনি ক্ষমতার নতুন সমীকরণ খুলে দিয়েছেন
‘পেন্সিলে আঁকা পরী’: পুঁজিবাদ, চলচ্চিত্র ও নতুন ক্ষমতার রূপ
‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ মূলত মিতু নামে এক নারীর গল্প। কিন্তু এর অন্তর্লীন স্রোত সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।
এখানে টাকার শক্তি শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে, শিল্পকে বানিয়ে ফেলে নিজেদের চাহিদা পূরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পণ্য।
হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন প্রজন্মের রাজনীতি আর গুলি-লাঠির নয়—এটি পুঁজিবাদের রাজনীতি, যেখানে মিডিয়া ও কর্পোরেট অর্থ সমাজচিন্তাকে দখল করে নেয়। এর সাথে দখল করে নেয় মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও।
এই উপন্যাসে তিনি ক্ষমতার নতুন সমীকরণ খুলে দিয়েছেন—যেখানে ধনবানরা সংস্কৃতি দখল করে নেয়, আর সাধারণ মানুষ দর্শক হয়ে পড়ে।

এই উপন্যাস শুধু নারীর গল্প নয়; এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অন্যায়ের দলিল
‘প্রিয়তমেষু’: নারী, ন্যায় ও রাষ্ট্রের নীরবতা
‘প্রিয়তমেষু’ উপন্যাসে ধর্ষণের শিকার এক নারীর ন্যায়বিচারহীনতা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ভয়হীনভাবে লিখেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, সমাজ—সবাই মিলে কীভাবে এক নারীর মর্যাদা কেড়ে নেয়, অথচ অপরাধীরা বেঁচে যায়।
এই উপন্যাস শুধু নারীর গল্প নয়; এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অন্যায়ের দলিল। এখানে হুমায়ূনের রাজনৈতিক সচেতনতা একেবারে স্পষ্ট—তিনি নীরবে বলেন, ন্যায়বিচার যদি কেবল প্রভাবশালীর জন্য হয়, তবে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নামের এই নিপীড়নযন্ত্র- নিজেই অপরাধী।
‘প্রিয়তমেষু’-তে তিনি নারী স্বাধীনতার প্রশ্নকে ব্যক্তিগত না রেখে, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে তুলেছেন—যা তাঁর সময়ের সাহিত্যে বিরল সাহসিকতা।
মানুষের রাজনীতি বনাম দলীয় রাজনীতি
এই সব উপন্যাস মিলিয়ে দেখা যায়, হুমায়ূন আহমেদের রাজনীতি আসলে মানুষের রাজনীতি। তিনি কখনো দলীয় পতাকা তোলেননি, কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর দায় ছিল গভীর।
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বা ‘আগুনের পরশমণি’-তে তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধের মানবিক দিক দেখিয়েছেন, ‘হিমু’ সিরিজে তিনি রাষ্ট্রীয় ভয় দেখানোর বিপরীতে ব্যক্তির স্বাধীনতার স্বপ্ন এঁকেছেন।
তাঁর লেখায় রাজনীতি মানে ক্ষমতা নয়; এটি ন্যায়ের অনুভব, বিবেকের দায় এবং মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এমন এক লেখক, যিনি রাজনীতিকে উচ্চারণের নয়, অনুভবের স্তরে এনেছেন।
‘হলুদ হিমু’ রাষ্ট্রকে ভয় পায় না, ‘দেয়াল’ ইতিহাসের দায় স্বীকার বিচার দাবি করে, ‘মাতাল হাওয়া’-র এনএসএফ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতীক,
‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ পুঁজিবাদ ও দাসত্বের নতুন সাম্রাজ্য উন্মোচন করে আর ‘প্রিয়তমেষু’ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের শূন্যতা প্রকাশ করে।
এই সবকিছু মিলিয়ে হুমায়ূনের সাহিত্য আমাদের শেখায়—রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতার খেলা নয়, এটি মানুষের নৈতিক সত্ত্বার লড়াই।
তাঁর চরিত্ররা হয়তো দলীয় পতাকা তোলে না; কিন্তু তাদের হাঁটাচলা, নীরবতা, প্রতিবাদে এক অদৃশ্য রাজনীতি কাজ করে।
সেই রাজনীতি সরাসরি প্রতিক্রিয়ার নয়, সেই রাজনীতি মৃদু কিন্তু গভীর—যেখানে হিমুর হলুদ জামাও হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রতীক।





























