
ড. মোঃ শরীফুল ইসলাম দুলু
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই ধরনের প্রবণতা স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে—একদিকে অযৌক্তিক রাজনৈতিক ক্রুসেড, অন্যদিকে ধর্মীয় হিপোক্রেসি। এই দুই শক্তি মিলে জনজীবনকে বিভ্রান্ত করে, গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পশ্চাৎমুখী করে। দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যে জটিলতা, অনিশ্চয়তা আর বিভক্তির মধ্যে পড়ে, তার পেছনের মূল জ্বালানি হিসেবে অনেক সময় এই দুই প্রবণতা করাজ করে। তাই প্রশ্নটা এখন খুব সরল- বাংলাদেশ কি সত্যিই মুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে এগোবে, নাকি রয়ে যাবে এসব বিরোধাভাসে বন্দী?
বিষয়টা একটু খোলাসা করা যাক।
প্রথমত, রাজনৈতিক ক্রুসেড বলতে আমরা বুঝি—যে কোনো রাজনৈতিক মতকে ধর্মীয় যুদ্ধের মতো পবিত্র করে তোলা। যেন কোনো দলের সমালোচনা করলে ধর্মভ্রষ্ট হওয়ার মতো অপরাধ হয়েছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে দলীয় রাজনীতিকে ধর্মীয় উন্মাদনার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা শক্তিশালী হয়েছে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নিজেদের অবস্থানকে ‘ন্যায়’, ‘পাবলিক ম্যান্ডেট’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’ বা ‘রাষ্ট্ররক্ষা’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দলগুলো নিজেদের ভুল, বৈপরীত্য বা ব্যর্থতার কোনো জায়গাই রাখতে চায় না।
এর ফলে বিরোধী মতকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘দেশবিরোধী’ বা ‘ধর্মবিরোধী’ তকমা লাগানো এখন খুব সাধারন। রাজনৈতিক মতের বৈচিত্র্যকে শত্রুতা হিসেবে দেখা এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যেখানে যুক্তির জায়গা সংকুচিত হয়েছে, আর আবেগ—বিশেষত ধর্মীয় ও দেশপ্রেমের অপব্যবহার—রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
এবার ধর্মীয় হিপোক্রেসির বিষয়ে আসা যাক।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম-প্রধান দেশ, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষের জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত। কিন্তু এই মূল্যবোধকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা নতুন নয়। যেটা নতুন, সেটা হলো—ধর্মকে একদিকে বলিষ্ঠ নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা, আর অন্যদিকে রাজনৈতিক স্বার্থে সেই নৈতিকতারই সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা। এই দ্বৈততা বা হিপোক্রেসি রাজনীতিকে এক ভয়ংকর রূপ দিয়েছে।
কিছু দল দেশব্যাপী শান্তি, সহমর্মিতা এবং সাম্যতার কথা বলে; আবার ভিন্ন প্রসঙ্গে তারা সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালায়। কেউ উন্নত ইসলামী মূল্যবোধের কথা তুলে ধরে; কিন্তু ক্ষমতার জন্য যে কোনো আপস, যে কোনো কৌশল এবং যে কোনো অসত্যকে বৈধ করে তোলে। ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা একসময় কৌশল ছিল, এখন সেটা পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতে বড় ক্ষতি হয় দেশের সামাজিক সাম্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতির। কারণ যখন ধর্মীয় মূল্যবোধের নামে রাজনৈতিক লড়াই হয়, তখন সাধারণ মানুষ বিভক্ত হয়, ঘৃণা জন্মায়, আর রাষ্ট্রের নৈতিকতা ভেঙে পড়ে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো—এই ধর্মীয় হিপোক্রেসি অনেক সময় চিহ্নিত করাও কঠিন, কারণ তা প্রায়ই নৈতিকতার মুখোশ পরে থাকে।
এবার মূল প্রশ্নে আসা যাক—বাংলাদেশের রাজনীতি কীভাবে এর থেকে মুক্ত হবে?
প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বীকার করতে হবে যে রাজনীতি হলো জনগণের সেবা, যুদ্ধ নয়। প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার মানসিকতা দূর করতে হবে। ক্ষমতা দখল নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতাই হওয়া উচিত তাদের মূল প্রতিযোগিতা। আজকের রাজনৈতিক ক্রুসেডের সংস্কৃতি মূলত সৃষ্টি হয়েছে প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করার মনোভাব থেকে। এই মনোভাব বদলাতে না পারলে অগ্রগতি সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, ধর্মকে সম্মান করা এবং ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করার মধ্যে বড় পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যটি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বুঝতে হবে। ধর্ম সামাজিক শক্তি, আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, আর মানবিক মূল্যবোধের উৎস—কিন্তু রাজনৈতিক লড়াইয়ের অস্ত্র নয়। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা মানে সেটা মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। এটা বন্ধ হওয়া জরুরি।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং তরুণদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। রাজনৈতিক কথাবার্তায় যুক্তি থাকা দরকার, তথ্য থাকা দরকার, আর সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধ থাকা দরকার। যখন সমাজে অন্ধ সমর্থন কমে যুক্তিনির্ভর সমর্থন বাড়ে, তখন রাজনৈতিক ক্রুসেড বা ধর্মীয় হিপোক্রেসি টিকতে পারে না।
চতুর্থত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। আইনের শাসন যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে রাজনৈতিক ক্রুসেড বাড়বেই, আর ধর্মীয় হিপোক্রেসি আরও শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্র তখন কাগজে থাকবে, বাস্তবে থাকবে না।
এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতারা যেমন দায়িত্বশীল আচরণ করেন না, তেমনই অনেক সময় সাধারণ মানুষও তা দাবি করে না। আমরা নেতাদের কাছে জবাবদিহি চাই না, আমরা নৈতিকতার কথা বলি, কিন্তু সঠিক মূল্যবোধের আমল চর্চা করি না। এই দ্বিচারিতার সংস্কৃতি ভাঙতে হলে নাগরিকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
তা না হলে, বাংলাদেশের রাজনীতি যতদিন রাজনৈতিক ক্রুসেড এবং ধর্মীয় হিপোক্রেসির দাপটে চলবে, ততদিন উন্নত, আধুনিক, মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পথ বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের শক্তি আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, ইতিহাস আছে। স্বাধীনতার চেতনা কোনো দলীয় সম্পত্তি নয়; এটা জনগণের। সেই জনগণ চাইলে রাজনীতির গতিপথ বদলে যেতে পারে।
এখন সময় এসেছে দলীয় স্বার্থ, আবেগী স্লোগান আর ধর্মীয় দুমুখো আচরণের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের আলোচনার। রাষ্ট্রকে এগোতে হলে রাজনীতিকে সৎ হতে হবে—নিজের কাছে, জনগণের কাছে, এবং দেশের ভবিষ্যতের কাছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি মুক্ত হোক—অন্ধ ক্রুসেড থেকে, হিপোক্রেসি থেকে, আর বিভাজনের অভিশাপ থেকে।
ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা