
৭০০০০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ ।। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলের প্যালিও-আগুলহাস সমভূমিতে বরফযুগের সময়কার জীবনযাত্রার চিত্র আজও বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করে। নতুন গবেষণাগুলো ক্রমেই ইঙ্গিত দিচ্ছে—মানবজাতির উৎপত্তি হয়তো শুরু হয়েছিল সমুদ্রতীরেই, আজ থেকে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে।
এই ধারণা প্রচলিত সেই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে, যেখানে বলা হয়—আধুনিক মানুষ প্রথমে পূর্ব আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকা: মানুষের যাত্রার সূচনা বিন্দু
সম্প্রতি প্রকাশিত এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা যুক্তি দিয়েছেন যে, বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ কেপ অঞ্চলই সম্ভবত ছিল হোমো সেপিয়েন্স-এর বৈশ্বিক অভিযাত্রার সূচনাস্থল।
গবেষকদের মতে, এখানকার জনগোষ্ঠী প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৪০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা ত্যাগের আগে পূর্ব উপকূল বরাবর ধীরে ধীরে উত্তরের দিকে অগ্রসর হয়।
এই গবেষণার ভিত্তি গঠিত হয়েছে নানা তথ্যসূত্র থেকে—ফসিল বা জীবাশ্ম রেকর্ড, জিনগত প্রমাণ, জলবায়ুর ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন—সব মিলিয়ে এক সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন করে মানুষকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্যালিও-আগুলহাস সমভূমির মানুষ ।। ছবি: সংগৃহীত
কেন এই অঞ্চল ছিল টিকে থাকার আশ্রয়
গবেষক কার্টিস মারিয়ান জানান, দক্ষিণ কেপ অঞ্চলের উপকূল মানুষকে দিয়েছিল অনন্য এক বেঁচে থাকার সুবিধা।
সমুদ্রের ঝিনুক ও শামুকজাতীয় প্রাণী ছিল তাদের নির্ভরযোগ্য খাদ্য। বরফযুগের প্রচণ্ড ঠান্ডা ও খরার সময় যখন স্থলভাগের অন্যসব দল টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন এই উপকূলীয় জনগোষ্ঠী টিকে ছিল সাগরের দানে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নও তাদের এগিয়ে দেয়—তারা ধনুক-বাণের মতো অস্ত্র উদ্ভাবন করে, যা তাদের অন্য প্রজাতির হোমিনিনদের থেকে আলাদা করেছিল। এই উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সঙ্গে সাংস্কৃতিক অভিযোজনের দক্ষতা, তাদের ক্রমশ শক্তিশালী ও গতিশীল করে তোলে।
এরই ধারাবাহিকতায় তারা আফ্রিকার সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের পথে যাত্রা শুরু করে।
বরফযুগে সমুদ্রের ভূমিকা
বরফযুগে যখন সমুদ্রের পানি নেমে যাচ্ছিল, তখন লোহিত সাগর সরু হয়ে পড়েছিল। এর ফলে আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপে পারাপার তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়।
একই সময়ে দক্ষিণ কেপ উপকূলে বিশাল এক সমভূমি গঠিত হয়, যা মানুষের জন্য নতুন আবাসস্থল ও খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে কাজ করেছিল।

তৎকালীন মানুষের সংগ্রামী জীবন ।। ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্রের ধারে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই উপকূলীয় জনগোষ্ঠী চাঁদের আবর্তন বা লুনার সাইকেল বুঝতে পারত—যা তাদেরকে নির্দিষ্ট সময়ে সাগরে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহে সাহায্য করত।
তবে সমুদ্রের এই সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ায় কিছু দল হয়তো উত্তরমুখী অভিবাসনে বাধ্য হয়েছিল।
তখন পৃথিবী ভয়াবহ জলবায়ুগত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল—১,৯০,০০০ থেকে ১,৩০,০০০ বছর আগে ছিল দীর্ঘ শৈত্যকাল, আর প্রায় ৭৪,০০০ বছর আগে ঘটে টোবা আগ্নেয়গিরির মহাবিস্ফোরণ।
তবুও দক্ষিণ কেপের মানুষ টিকে থাকে, এবং সেই সময়েই তারা তৈরি করে শিল্প ও প্রতীকী নিদর্শন—যেমন পিনাকল পয়েন্ট, ব্লম্বস, ও ক্লাসিজ নদীর তীরে পাওয়া গেছে চিত্র, অলঙ্কার, ও উন্নত পাথরের হাতিয়ার।
নতুন সভ্যতার বার্তাবাহক
এই জনগোষ্ঠীগুলো যখন উত্তর দিকে অগ্রসর হয়, তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায় তাদের উন্নত প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বীজ।
তারা যেসব জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি হয়, তাদের তুলনায় এদের সরঞ্জাম ও বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা ছিল অনেক এগিয়ে।
এইসব প্রমাণ একত্রে ইঙ্গিত দেয়—দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল শুধু টিকে থাকার স্থানই ছিল না, বরং এখান থেকেই শুরু হয়েছিল আধুনিক মানুষের দীর্ঘ অভিযাত্রা—যার গন্তব্য ছিল সমগ্র বিশ্ব।




























