
আগুনে নিঃস্ব শত শত পরিবার, চলছে হাহাকার
কড়াইল বস্তির নীলুফা ইয়াসমিনের চোখে এখন শুধু কান্না। সাত বছর ধরে স্বামী-সন্তান নিয়ে যে ঘরটিতে কাটিয়েছেন, মুহূর্তের আগুনে সেই ঘরের সবকিছুই ছাই হয়ে গেছে। কিছুই বাঁচাতে পারেননি তিনি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন।
পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে তার আট বছরের ছেলে ইয়ামিন— “মা তুমি কাইন্দো না, আমাগো সব হবে। আমি চাকরি কইরা আবার সব কিইনা দিমু।”
নীলুফা বলেন, “যখন এই বস্তিতে আসি, তেমন কিছুই ছিল না। আমি গার্মেন্টসে কাজ করি, পোলার বাপ রিকশা চালায়। কিস্তি দিয়া ফ্রিজ, টিভি, আলমারি কিনছিলাম। চাল-ডাল, জামাকাপড়—একটা সংসারের যা যা লাগে, সবই ছিল ঘরে। সব পুড়ে শেষ। এতো কিছু আবার কই থাইক্কা কিনুম?”
নীলুফার মতোই পুড়ে গেছে আরও অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন। দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে, কষ্টে-কষ্টে সংগৃহীত ঘরের সব সম্বল মুহূর্তেই হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব।
জাকির নামে এক বাসিন্দা জানান, “আগুনে কয়েকশো ঘর পুড়ে গেছে। যেদিক দিয়ে আগুন গেছে, কোনো কিছুই অবশিষ্ট নাই।”
জমিরুন নেছা বারবার কান্নায় মূর্ছা যাচ্ছেন। পাশে থাকা তার মেয়ে জিনিয়াও কাঁদছে। তিনি বলেন, “আমাগো এখন কী হবে জানি না। কী খামু, কী পরুম—শেষ সম্বলটুকু কেন পুড়ে গেলো আল্লাহ জানে।”
মাহবুব হোসেন বলেন, “জীবন নিয়ে বের হইছি। পকেটে এক টাকাও ছিল না। তিন বছরের বাচ্চাটা শীতে-ক্ষুধায় কাঁদতেছে। খাবার কোথায় পাবো? যার যার ঘর পুড়ছে, কেউ আর কাউরে সাহায্য করতে পারতেছে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমাগো চারপাশে ধনী মানুষের বাস। তাদের সহযোগিতা না পেলে শীত আর ক্ষুধায় টিকতে পারবো না।”
রিকশা গ্যারেজকর্মী জামাল হোসেন জানান, আগুনে তার বাসা-গ্যারেজ দুটোই পুড়ে গেছে। স্ত্রী দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করতে শহরে গিয়েছিলেন। ঘরে তালা থাকায় তিনি কিছুই বাঁচাতে পারেননি। এখন পরিবার নিয়ে রাস্তায়। “বাচ্চার শীতে খুব কষ্ট হইতেছে। আমাগো ক্ষুধাও লাগছে। খাবার কেনার টাকা নাই।”—বলেন তিনি।
এদিকে অক্ষত ঘরগুলোর বাসিন্দাদেরও দেখা গেছে মাথায়, কাঁধে আর হাতে জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদে সরানোর চেষ্টা করতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বউবাজার এলাকার কুমিল্লা পট্টি, বরিশাল পট্টি ও ক-ব্লকেই মূল আগুনের তাণ্ডব ছিল। আগুন দাউদাউ করে জ্বললো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট প্রথমে কাজ শুরু করে, পরে আরও ৮টি ইউনিট যোগ দেয়। মোট ১৯টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় ৫ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঘর হারানো মানুষগুলো এখন খামারবাড়ি মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন—কারও হাতে আর কিছু নেই, চোখে শুধু অশ্রু আর ভবিষ্যৎ কী হবে সেই শঙ্কা।