
বেগম খালেদা জিয়া ।। বাংলা টেলিগ্রাফ গ্রাফিক্স ।। ছবি: সংগৃহীত
বেগম খালেদা জিয়া—এই নামটা শুধু একজন রাজনীতিবিদের পরিচয় নিয়ে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি এক অনন্য অধ্যায়, যা সাহস, দৃঢ়তা, আত্মসম্মান, আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক দীর্ঘ পথচলায় গড়া। আজ তিনি গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালের সাদা দেয়াল ঘিরে তার চারপাশে থাকা নীরবতা যেন দেশের কোটি মানুষের বুকের ভেতরের অজস্র আঘাত, উদ্বেগ, আর অপেক্ষাকে প্রতিফলিত করে। প্রশ্নটা এখন আর শুধু একজন মানুষের সুস্থতার নয়—এটা সেই নেত্রীর ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা, যিনি এই জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন।
এমন মুহূর্তে দেশের মানুষ খুব সহজ একটি সত্য অনুভব করছে—রাজনীতি যত বিভক্ত হোক, আবেগের জায়গা কখনও ভাঙে না। খালেদা জিয়ার সুস্থতা নিয়ে আজ যে উদ্বেগ, সেটি দলীয় নয়; এটি ভালোবাসার। কারণ তিনি এমন এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নারীদের একজন হিসেবে উঠে এসেছেন, যখন নারীর নেতৃত্ব শুধু প্রশ্নবিদ্ধই ছিল না, প্রায় অসম্ভব বলে ধরা হতো।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে শুরু হয়নি, বরং অকল্পনীয় ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। জিয়াউর রহমানের হত্যার পর তিনি অসহায় অবস্থায় থেকেও সাহস হারাননি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, কারাবরণ, ষড়যন্ত্র—সবকিছু পেরিয়ে তিনি গণতন্ত্র ও বহুদলীয় রাজনীতির প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আত্মসম্মান। তিনি কারও কাছে নতি স্বীকার করতে শেখেননি। যে কোনও চাপ, যে কোনও অস্থিরতার সামনে মাথা উঁচু রাখার দৃঢ় অবস্থানই মানুষকে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করেছে।
আর এ কারণেই আজ তার অসুস্থতা আমাদের মাঝে গভীর শূন্যতা তৈরি করে। আমরা জানি, এই নারী চাইলেই ক্ষমতার বিনিময়ে আপস করতে পারতেন, সুবিধা নিতে পারতেন, নিজের জন্য ভিন্ন পথ বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনও তা করেননি। নিজের ভাগ্য, নিজের রাজনীতি, নিজের সংগ্রাম—সবই তিনি বাংলাদেশের মানুষের উপর আস্থা রেখে গড়েছেন।
আজ তিনি যখন শয্যাশায়ী, তখন বহু মানুষের চোখে জল আসে শুধু স্মৃতির কারণে নয়—বরং সেই দৃঢ়চেতা নেত্রীকে এভাবে দুর্বল অবস্থায় দেখা যায় না বলেই। মানুষের অনুভূতি কখনও মিথ্যা হয় না, আর এই অনুভূতি আজ দেশকে একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
দেশজুড়ে নানা মতের মানুষ একটাই প্রার্থনা করছে—তিনি যেন দ্রুত সুস্থ হন। এই প্রার্থনার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, এটি সম্পূর্ণ মানবিক। যে নারী দুবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ণ মেয়াদে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় নারী নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, যিনি দুর্বলের পাশে দাঁড়ানোকে নিজের দায়িত্ব মনে করেছেন—তাঁর জন্য মানুষের হৃদয়ে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসা জাগবে।
রাজনীতি বিরোধিতা শেখায়, কিন্তু মানবিকতা একসঙ্গে দাঁড়াতে শেখায়। আজ বাংলাদেশের মানুষ সেই মানবিকতার জায়গায় দাঁড়িয়ে বেগম জিয়ার সুস্থতার কামনা করছে।
কারণ তিনি শুধু একটি দলের নেতা নন—তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতীক। তাঁর সুস্থতা দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্যও অপরিহার্য। তার অনুপস্থিতি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে শূন্যতা তৈরি করেছে, যা শুধু একজন নেতা নয়, একজন অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের শূন্যতা।
তাঁর জীবন সংগ্রামের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি বারবার দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছেন। কখনও কারাগার, কখনও গৃহবন্দি অবস্থা, কখনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র—কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। অসংখ্য দেশের নেত্রী ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে পিছিয়ে গেছেন, কিন্তু খালেদা জিয়া প্রতিবারই নতুন শক্তি নিয়ে ফিরেছেন। এই শক্তিই তাকে আলাদা করে। এই শক্তিই তাকে দেশের মানুষের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু করেছে।
এখন তিনি হাসপাতালে, চিকিৎসাধীন। বাইরে অপেক্ষা করছে কোটি মানুষের প্রার্থনা। মানুষ বিশ্বাস করে, তিনি আবার ফিরে দাঁড়াবেন, কারণ তিনি কখনও সহজে হার মানেননি। তার রাজনীতি যেমন ছিল আত্মসম্মান আর অটল বিশ্বাসের, তার ব্যক্তিজীবনও তেমনই দৃঢ়তার প্রতীক। আর এ কারণেই মানুষ মনে করে—বেগম জিয়া মানেই শক্তি। মানেই সাহস।
তাঁর সুস্থতা নিয়ে যত উদ্বেগ, ততটাই শক্ত অনুভূতি হলো—আশা। মানুষ বিশ্বাস করে, তার সুস্থতা কেবল একটি পরিবারের স্বস্তি নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের একটি প্রয়োজন। তিনি ফিরলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সেই ভারসাম্য ফিরে আসবে, যেটি দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।
একটা কথা স্পষ্ট—তিনি কেবল একটি নাম নন, তিনি একটি অনুভূতি। তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পাঠ শেখানো এক নেত্রীর প্রতিচ্ছবি। আর তাই তার সুস্থতা প্রত্যাশী মানুষের প্রার্থনা অসংখ্য, গভীর, সত্যিকারের।
দেশ আজ সত্যিই এক হৃদয়ে, এক প্রার্থনায় বলছে—
যে নেত্রী মাথা উঁচু রাখার শক্তি শিখিয়েছেন,
তার সুস্থতা চাই আজ এক হৃদয়ে, এক প্রার্থনায়।
ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা