আশির দশকে জাংক বন্ড বাজারের অগ্রদূত মাইকেল মিলকেন গত মাসে সিঙ্গাপুরে তার মিলকেন ইনস্টিটিউটের এশিয়া শাখার প্রথম সম্মেলনের আয়োজন করেন। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্তটি ছিল বেশ চমকপ্রদ। চীনের কাছাকাছি হওয়ায় এবং একটি সুসংবদ্ধ আর্থিক বাজার থাকা সত্ত্বেও তিনি হংকংকে বেছে নেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সিঙ্গাপুরকে বেছে নিয়েছি, আর্থিক, হিসাববিজ্ঞান, আইনি বা অবকাঠামো— যে বিষয়টিই বলেন না কেন আমরা মনে করি, সিঙ্গাপুর গোটা এশিয়ার এক অনন্য গন্তব্য।’
পাঁচ বছর আগেও সিঙ্গাপুর মিলকেনের হিসাবের ধারেকাছেও ছিল না। এ কয়েক বছরে শহরটি পণ্য ও বৈদেশিক মুদ্রার ট্রেডিং এক্সচেঞ্জ হিসেবে এশিয়ার বৃহত্তম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি তৈরি করেছে একটি শক্তিশালী সম্পদ ব্যবস্থাপনা কাঠামো যার ওপর তীক্ষ নজর রাখছেন পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা।
কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের ডিন গ্লেন হাবার্ড বলেন, ‘হংকংয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সিঙ্গাপুর আসলেই নিজেকে বেশ ভালোভাবে প্রস্তুত করে তুলেছে। আপনি যদি স্বচ্ছতা, উন্মুক্ততা ও ব্যবসায় বিশুদ্ধতা নিয়ে বলেন, তবে আমি বলব এসবই সিঙ্গাপুরের আছে।’
হংকং ও সিঙ্গাপুরের দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিফলিত হচ্ছে, ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দার পর থেকে এশিয়ার আর্থিক কেন্দ্রগুলো ক্রমেই বিশ্বের মধ্যে তাদের অবস্থান উন্নত করার এক অলিখিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। মন্দার পরে লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতো পশ্চিমা আর্থিক কেন্দ্রগুলো আবার মাথা তুলে দাঁড়ালেও এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান সম্পদ বৃদ্ধি এ প্রশ্নই ছুঁড়ে দিচ্ছে, বিশ্বের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অঞ্চলে কোন শহরটি সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে।
ষাটের দশক থেকেই এশিয়ার প্রভাবশালী আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে হংকং বেশ প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে ইকুইটি ও আইপিওর হিসাবে এ কেন্দ্রটি এশিয়ায় একপ্রকার চ্যালেঞ্জহীন। চলতি বছর ১৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে ৬৭টি নতুন তালিকাভুক্তি নিয়ে নিউইয়র্ক ও লন্ডনের পরেই এটি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান করছে। অন্যদিকে মাত্র ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে আটটি নতুন তালিকাভুক্তি নিয়ে ১৯তম অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেফারিজের ইকুইটি স্ট্র্যাটেজি বিভাগের বৈশ্বিক প্রধান শন ডার্বি বলেন, শুধু ইকুইটির কেন্দ্র হিসেবে হংকংকে দেখা ঠিক হবে না। এটিকে চীনের আর্থিক সম্পদে প্রবেশাধিকারের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবেও দেখতে হবে।
কিন্তু বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পণ্য লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করে সিঙ্গাপুর এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেল লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান গানভর গত নয় মাসে তাদের মোট কর্মীর ২০ শতাংশই নিয়োগ দিয়েছে সিঙ্গাপুরে। আকর্ষণের আরেকটি কারণে এ শহরে করপোরেট করের হার হংকংয়ের ১৬ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় কম।
এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে গত বছরই টোকিওকে টপকে এশিয়ার শীর্ষ ফরেক্স এক্সচেঞ্জে পরিণত হয়েছে সিঙ্গাপুর। এক্ষেত্রে শুধু লন্ডন ও নিউইয়র্কই আছে তার চেয়ে এগিয়ে। নগররাষ্ট্রটির মোট জিডিপির ১২ শতাংশ অবদান রাখছে আর্থিক সেবা খাতটি, বিপরীতে হংকংয়ের ক্ষেত্রে তা ১৬ শতাংশ।
তার পরও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর থেকে ঢের এগিয়ে হংকং। এছাড়া বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যার দিক দিয়েও এগিয়ে আছে হংকং (৮২:৩২)। তবে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ বলছে, এ দুই কেন্দ্রের সম্মিলিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা ২০১৫ সালে বৈশ্বিক শীর্ষ কেন্দ্র সুইজারল্যান্ডকে ছাড়িয়ে যাবে। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৩ সালের শেষে সুইজারল্যান্ডে ১ দশমিক ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বিপরীতে হংকংয়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতের আওতায় ছিল ১ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ। ৮২০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল সিঙ্গাপুর।
মূলত জীবনযাত্রার কারণেই সিঙ্গাপুরের প্রতি ব্যাংকারদের আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। হংকংয়ের তুলনায় এ শহরটি বেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত। এছাড়া আবাসন খরচও তুলনামূলক কম। এ শহরে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া সপ্তাহে ১ হাজার ৭১১ ডলারের কম, বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হংকংয়ে তা ২ হাজার ৪৪৬ ডলার।
এ দুই শহরই ব্রিটেনের সাবেক উপনিবেশ হওয়ায় ইংল্যান্ডের সাধারণত আইনের ভিত্তিতে তাদের আইনি কাঠামো পরিচালিত হয়। কিন্তু কয়েকজন আইনজীবী মনে করেন, বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে হংকংয়ে চলমান বিতর্কের কারণে সুবিধাভোগী হতে পারে সিঙ্গাপুর। বিচার বিভাগটিই হংকংয়ের সাফল্যের মূল ভিত্তি। আইনি প্রতিষ্ঠান ক্লাইড অ্যান্ড কোম্পানির অংশীদার প্রকাশ পিল্লাই বলেন, ‘আমি মনে করি, ভবিষ্যতে এশিয়ার নিরপেক্ষ ভেনু হবে সিঙ্গাপুর। এমনকি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকট বাদ দিলেও হংকংয়ের সে সম্ভাবনা নেই।’
তবে স্বল্পমেয়াদে কোন শহরটি প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এখনো কেউ দিতে পারেনি। গত জুলাইয়ের এ আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে দুটি শহরের ওপর তুলনামূলক পর্যালোচনা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাতে জানানো হয়, ‘উত্তর এশিয়া ও চীনের জন্য হংকং এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য সিঙ্গাপুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি আপাত বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে ভূমিকার কারণে হংকং ও সিঙ্গাপুর ক্রমেই পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে। বণিকবার্তার সৌজন্যে।




























