রবিবার । ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক আন্তর্জাতিক ১৪ জানুয়ারী ২০১৪, ১১:৩৬ অপরাহ্ন
শেয়ার

প্রেরণার নাম লিজি ভেলাসকেজ


সিউল, ১৪ জানুয়ারী ২০১৪:

‘ডাইনী’, ‘দানবী’, ‘কিম্ভূতকিমাকার’ কিংবা ‘পৃথিবীর সবচেয়ে কদর্য নারী’ সব বিশেষণই পাওয়া হয়ে গেছে লিজি ভেলাসকেজের। ২৪ বছর বয়সী এই মার্কিন তরুণী ভুগছেন এক বিরল শারীরিক সমস্যায় যা এই বয়সেই তাঁর চেহারায় এনে দিয়েছে বৃদ্ধার ভাঁজ; অ্যাডিপোজ টিস্যুর অভাবে তাঁর শরীরে তৈরি হয় না কোন পেশী, সঞ্চিত হয় না শক্তি, বাড়ে না ওজন। ২৪ বছর বয়সেও তাই লিজির ওজন মাত্র ২৭ কেজি। চার বছর বয়স থেকেই একটি চোখে দৃষ্টিশক্তি নেই, কম দেখেন অপর চোখেও।

liz450হাইস্কুলে পড়ার সময় তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল “ওয়ার্ল্ড’স আগলিয়েস্ট ওমেন” নামের ৮ মিনিটের ইউটিউব ভিডিও যা তাঁকে বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়ে পরিণত করে। এটি দেখে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে, অনেকে নাক কুঁচকিয়েছে, এমনকি সরাসরি আত্মহত্যা করতে বলতেও ছাড়ে নি কেউ কেউ! তবে অসীম মানসিক শক্তির অধিকারী লিজি ভুলেও সে পথে হাঁটেন নি। বরং নিজের এই ‘কদর্যতা’কে ঈশ্বরের আশীর্বাদ জ্ঞান করেই টেক্সাসের অস্টিনে বেড়ে ওঠা তরুণী শুরু করলেন এক অন্য যুদ্ধ। নিজেই হয়ে উঠলেন আর দশজনের বেঁচে থাকার প্রেরণা।

টেক্সাস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি কমিউনিকেশন স্টাডিজে স্নাতক সম্পন্ন করা লিজি একজন অনুপ্রেরণামূলক বক্তা হিসেবে কাজ করছেন প্রায় আট বছর ধরে। কীভাবে অভিনবত্বকে স্বীকৃতি দিতে হয়, বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে কীভাবে জীবনকে গ্রহণ করতে হয়, ভালোবাসতে হয় এসব বিষয়ে তিনি এ যাবত দু’শর বেশী কর্মশালায় বক্তৃতা দিয়েছেন। হলভর্তি শ্রোতা গভীর মনোযোগে শুনছে তাঁর কথা।

গর্ভধারণের মাত্র চার সপ্তাহের মাথায় প্রিম্যাচিওর বেবী হিসেবে লিজির জন্ম দেন মা রিতা। এ সময় তাঁর ওজন ছিল ২ পাউন্ড ১০ আউন্স। মা জানান সেসময় তাঁকে পুতুলের জামা পড়াতে হতো। এই মেয়ে আদৌ বাঁচবে কিনা আর বাঁচলেও হাঁটাচলা করতে পারবে কিনা সে নিশ্চয়তা দিনে পারেন নি চিকিৎসকরা। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেসব আশংকা অমূলক প্রমাণ করে লিজির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, অস্থি ও মস্তিষ্কের গঠন অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মেই বিকশিত হতে থাকে। তবে চর্বিগ্রন্থির অনুপস্থিতি তাঁর শরীরে কোন খাদ্য জমাতে পারে না। ফলে তাঁকে খেতে হয় প্রতি ১৫-২০ মিনিট অন্তর অন্তর।

সারা দুনিয়ায় এই বিরল রোগে আক্রান্ত রোগী লিজিসহ এ পর্যন্ত মাত্র তিনজন পাওয়া গেছে। অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন আর চেহারা নিয়ে যারা প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে।
বক্তৃতা দেয়ার পাশাপাশি লিজি নিজেকে চিনিয়েছেন একজন লেখক হিসেবেও। আত্মবিশ্বাস ও আত্মোপলব্ধি বিষয়ে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘লিজি বিউটিফুল’। ২০১২ সালে বের করেন দ্বিতীয় বই ‘বি বিউটিফুল, বি ইউ’।

তাঁর তৃতীয় বইটিও প্রকাশের অপেক্ষায়। টেক্সাসের এক আলোচনায় লিজি বলেছিলেন, “আমি নিজেকে আমার স্বপ্ন আর অর্জন দিয়েই মূল্যায়ন করি, বাহ্যিক গঠন দিয়ে নয়।” রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মানুষের অদ্ভুত চোখে তাঁকে দেখার বিষয়টা কেমন লাগে এমন এক প্রশ্নের জবাবে গত বছর ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে লিজি জবাব বলেছিলেন, “আমার তখন ইচ্ছে হয় তাদের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলি, এই যে আমি লিজি। এভাবে আমাকে দেখে সময় নষ্ট না করে পারলে কিছু শেখার চেষ্টা করো!”

হয়তো চক্ষুলজ্জা থেকেই এমনটা তিনি কাউকে বলেন না। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর প্রবল আত্মবিশ্বাসের জোরে লিজি সন্দেহাতীতভাবেই গোটা দুনিয়ার চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক কিছু নতুন করে শিখিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো তথাকথিত সভ্য, সুন্দর, ভদ্র সমাজ সভ্যতা, সৌন্দর্য, ভদ্রতা এসব শব্দের সংজ্ঞাও একদিন নতুন করে লিখবে। স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয় লিজির মতো মানুষেরা অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, হতাশার মতো শব্দগুলো যাদুঘরে পাঠিয়ে দেবেন; সবধরনের বৈষম্যমুক্ত পৃথিবীর বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবে প্রতিটি মানবপ্রাণ।
লিজির নিজস্ব ওয়েবসাইটঃ www.aboutlizzie.com, ফেসবুক প্রোফাইলঃ facebook.com/aboutlizzie।