
প্রবাসী শিমুল শেখের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছেন পরিবারের সদস্যরা।
পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে, সংসারে সচ্ছলতা আনতে প্রবাসের পথে পা বাড়িয়েছিলেন শিমুল শেখ (৩৫)। কিন্তু দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে সৌদি আরবে গিয়ে তার সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। কাজের ব্যবস্থা তো হয়নিই, উল্টো টাকা দিতে না পারায় এখন পুলিশের ভয়ে খেয়ে না খেয়ে লুকিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে নড়াইল সদর উপজেলার বিছালী গ্রামের এই যুবককে।
রোববার দুপুরে বিছালী গ্রামে শিমুলের বাড়ির উঠানে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ভিডিও কলে প্রবাসে থাকা শিমুলের সঙ্গে কথা বলছেন তার মা, বাবা ও স্ত্রী। পাশে খেলছে শিমুলের দুই শিশু সন্তান। ফোনের ওপার থেকে ছেলের দুঃখের কথা শুনে এপারে সবার চোখ ভিজে ওঠে।
শিমুলের পরিবার অভিযোগ করেছে, প্রতিবেশী খাইরুল ইসলাম (৩৩) ও শরিফুল ইসলাম (২৮) তাকে প্রলোভন দেখিয়েছিলেন যে, তাদের মাধ্যমে সৌদি আরবে গেলে শিমুলের ভালো বেতনের চাকরি ও কাজের অনুমতি (আকামা) হয়ে যাবে। এর বিনিময়ে তাদের দিতে হবে পাঁচ লাখ টাকা।
চুক্তি অনুযায়ী, শিমুলের পরিবার মোটরসাইকেল বিক্রি, জমি বন্ধক রাখা এবং সুদে টাকা ধার করে সেই অর্থ জোগাড় করে দালালদের হাতে তুলে দেয়। এরপর চলতি বছরের মে মাসে শিমুল সৌদি আরব যান।
কিন্তু সৌদিতে গিয়ে শিমুলের সব আশা ভেঙে যায়। কাজের ব্যবস্থা হয়নি, উল্টো নতুন করে টাকা দাবি করা হয়। শিমুল শেখ ভিডিও কলে জানান, তাকে বলা হয়েছিল কোম্পানির গাড়ি চালাতে হবে এবং বেতন হবে ৭০-৮০ হাজার টাকা। তিনি গাড়ি চালানো শিখেও গিয়েছিলেন। দালালরা বলেছিল, কোম্পানির পক্ষ থেকে লাইসেন্স করে দেওয়া হবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নতুন করে আরও দেড় লাখ টাকা লাইসেন্স করার জন্য দাবি করা হয়।
শিমুল বলেন, “এখন আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি, গতকাল পুলিশের দাবড় খেয়েছি। ঠিকমতো খাতিনতি পারতিছি নে। ভয়ে ভয়ে আছি।”
টাকা দিতে না পারায় তার আকামাও করা হয়নি। শিমুলের মা পারভীন বেগম বলেন, “ছোয়াল যাওয়ার পর আবার টাকা চাইলে আমরা দিতে পারিনি। এ কারণে ছোয়ালরে আটকায় রাইখে অপরিচিত একটা নম্বর থেকে একজন বলিছে, টাকা না দিলে ছোয়ালের বিপদ হবে। পরে সেখান থেকে আমার ছোয়াল পলাইছে। এর পর থেকে পলাই বেড়াচ্ছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।”
শিমুলের বাবা জাফর শেখ আক্ষেপ করে বলেন, “ওরা আমার ছোয়ালরে নিয়ে কাজকাম দিতি পারিনি, আকামা দিতি পারিনি। ছোয়াল আমার বনজঙ্গল দিয়ে পলাই বেড়াচ্ছে। মাতুব্বরদের নিয়ে সালিসি বইছিলাম, তারা মানে না। কাজ দেওয়ার জন্যি আরও টাকা চাইছে। আমরা কোহানতে টাকা দেব?”
অভিযুক্তদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, চুক্তি অনুযায়ী শিমুলকে গাড়ি চালানোর কাজ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি ড্রাইভিংয়ে ব্যর্থ হন। পরে তাকে অন্য কোম্পানিতে দেওয়া হয়। শরিফুলের ভাষ্য, শিমুল সেখান থেকে পালিয়ে তার এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে কাজ করছেন এবং তার আকামাও করা হয়েছে। নতুন করে টাকা দাবি বা হুমকির অভিযোগ মিথ্যা বলেও দাবি করেন শরিফুল। তবে আরেক অভিযুক্ত খাইরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগী শিমুলের মা পারভীন বেগম এই ঘটনায় গত ২২ সেপ্টেম্বর নড়াইল আদালতে দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য যশোর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যশোর পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, মামলার তদন্ত চলছে এবং তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে।
দালালদের প্রলোভনে পড়ে এভাবে হাজারো শ্রমিকের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে প্রবাসে। প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন শিমুল, আর গ্রামে পরিবার ঋণের বোঝায় জর্জরিত। এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।





























