শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:১১ অপরাহ্ন
শেয়ার

IQ নয়, EQ বদলে দিচ্ছে সফলতার সমীকরণ


IQ EQ cover

যা আজ আর ‘সফট স্কিল’ নয়, বরং ‘সারভাইভাল স্কিল’

আজকের দুনিয়ায় সফলতা কি শুধু কোনো মানুষের আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে? ডিগ্রি, উপাধি, সমস্যা সমাধানের গতি—এসবই কি সাফল্যের চূড়ান্ত পরিচয়? নাকি আবেগ মানুষকে দুর্বল করে, তাই সেগুলো কর্মক্ষেত্রে দূরে রাখাই ভালো?

বর্তমান বাস্তবতা বলছে, এগুলোর কোনোটি আর একাই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে যখন আমাদের কাজের বড় অংশটাই এখন নির্ভর করছে রিমোট টিম, ভার্চুয়াল মিটিং, মেসেজিং অ্যাপ আর ডিজিটাল সহযোগিতার ওপর। এই পরিবেশে সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন সেই মানুষটিই, যিনি চাপের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারেন, সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন এবং নিজের ও অন্যের আবেগ বুঝে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন।

মানুষের এই ক্ষমতাকেই বলা হয় ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা EQ—যা আজ আর ‘সফট স্কিল’ নয়, বরং ‘সারভাইভাল স্কিল’।

ব্যক্তিত্ব-বিকাশ ও আবেগ-ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা এক্সপার্ট অঙ্কিতা কৌল মনে করেন—আজকের কর্মক্ষেত্রে EQ এর গুরুত্ব বহুগুণ বেড়েছে। কারণ প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, মেশিন যত বেশি কাজ করে দিচ্ছে, ততই মানুষের মূল্যায়ন হচ্ছে একটি জায়গায়—আপনি মানুষকে কীভাবে সামলান।

IQ EQ Inner 4

জ্ঞান বনাম প্রয়োগ—IQ আর EQ-এর পার্থক্য
IQ (intelligence quotient) বলে আপনি কী জানেন। EQ (Emotional Quotient) বলে আপনি সেই জ্ঞান মানুষ ও পরিস্থিতির মাঝে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।

আপনি যতই মেধাবী হন না কেন, যদি আপনি রাগে সিদ্ধান্ত নেন, সহকর্মীর কথা না শুনে নিজের মত চাপিয়ে দেন, ছোট ভুলে হুড়মুড় করে প্রতিক্রিয়া দেখান—তাহলে দল আপনাকে দীর্ঘমেয়াদে ভরসা করতে পারবে না।

অন্যদিকে, EQ-উচ্চ মানুষরা চাপের মধ্যেও স্থির থাকতে পারেন, সঠিক সময়ে কথা বলেন, কাউকে দোষারোপ না করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন। ফলে তারা শুধু কাজেই দক্ষ হন না—দল তাদের শক্তি হিসেবেই দেখে।

IQ EQ Inner 2

কেন আজ EQ আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ
গত এক দশকে কাজের ধরণ আমূল বদলে গেছে। একসময় কাজ মানে ছিল দক্ষতা আর কাজ শেষ করার গতি। এখন কাজ মানে—মানুষকে বোঝা, মানিয়ে নেওয়া, দূরত্বের ভেতরও সংযোগ তৈরি করা।
আমরা এখন কাজ করি দেশ-বিদেশের টিমের সঙ্গে। সময়-অঞ্চল ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, যোগাযোগের ধরন ভিন্ন।
ম্যাসেজ আর স্ক্রিনের আড়ালে ভয়েস টোন বুঝতে হয়, বিরোধ সমাধান করতে হয়, ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে হয়।

এমন ডিজিটাল পরিবেশে EQ-ই মানুষকে সফল করে। কারণ—অটোমেশন দক্ষতা নকল করতে পারে, EQ নকল করতে পারে না।

AI যত উন্নত হচ্ছে, মানুষের আসল শক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—আবেগ সামলানোর ক্ষমতা, সহমর্মিতা, ধৈর্য ও দৃষ্টিভঙ্গি।

‌‘আবেগ বাইরে রেখে কাজ করো’—এটা কি বাস্তবসম্মত?
সনাতন কর্মসংস্কৃতির একটি বড় ভুল ধারণা ছিল যে কাজ মানেই আবেগহীন থাকা। কিন্তু মানুষ তো কোনো সুইচ নয় যে অফিসের দরজায় ঢুকে হঠাৎ ‘ইমোশন অফ’ করে ফেলবে। আবেগ আমাদের সঙ্গেই থাকে—ভালো বা খারাপ। সেখানেই EQ কাজে লাগে।
EQ মানে আবেগ দমন করা নয় — বরং নিজের আবেগ বুঝে নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে সিদ্ধান্ত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

অতিরিক্ত সহমর্মিতা কি আপনাকে দুর্বল করে দেয়?
অনেক সময় ভাবা হয় যে বেশি সহমর্মিতা মানেই দুর্বলতা। কিন্তু EQ বলে—সহমর্মী হওয়া ঠিক, তবে সীমানা বজায় রেখে।

আপনি মানুষের কথা মন দিয়ে শুনতে পারেন, সহানুভূতি দেখাতে পারেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সবার দুঃখ-কষ্ট নিজের ওপর নিয়ে সেটাকে চাপ হয়ে উঠতে দেবেন। EQ এখানে শেখায়—কোন অনুভূতি আপনার, আর কোনটা অন্যের।

IQ EQ Inner 3

নিম্নমানের EQ’র কিছু ক্লাসিক লক্ষণ
বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি হলেও আবেগিক বুদ্ধিমত্তা কম হলে কিছু আচরণে তা স্পষ্ট ধরা পড়ে। যেমন:

• কথা বলার সুযোগ পেলেই বলছেন, তবে অন্যের কথা শুনছেন না।
• প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন ঝটপট, কিন্তু ভাবনা-চিন্তা করে উত্তর দিচ্ছেন না।
• সামান্য ফিডব্যাক পেলে ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে হয়।
• একা কাজ করলে সফল হন, কিন্তু টিম আপনাকে এড়িয়ে চলে।

কাজের ফলাফল যতই ভালো হোক—মানুষের ওপর আপনার প্রভাব যদি নেতিবাচক হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে কাজের পরিবেশ ভেঙে ফেলে।

Gen Z কীভাবে EQ গড়ে তুলতে পারে?
ডিজিটাল যোগাযোগের যুগে EQ শেখা নতুন চ্যালেঞ্জ। তবু কিছু সহজ অভ্যাস EQ বাড়াতে দারুণ কার্যকর—

• প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগে এক মুহূর্ত থামুন।
• শুধু লিখিত ম্যাসেজ নয়, তার টোন বোঝার চেষ্টা করুন।
• চ্যাট বা ম্যাসেজিং এর সময় কেউ উত্তেজিত হয়ে উঠলে কল করে নিন—লাইভ কথোপকথন আবেগ বোঝাতে সাহায্য করে।
• নিজের অনুভূতি খেয়াল করুন—খারাপ লাগছে? রাগ হচ্ছেন? ক্লান্ত?—জানলে সামলানো সহজ হয়।

EQ বাড়ে উপস্থিতি থেকে; শুধু যোগাযোগ থেকে নয়।

কোম্পানিগুলো কি এখন EQ কে গুরুত্ব দিচ্ছে?
অনেক উন্নত প্রতিষ্ঠান বুঝে গেছে—লো EQ-র খরচ প্রচণ্ড বেশি, কারণ: টিম ব্রেকডাউন, বার্নআউট, কনফ্লিক্ট, হাই টার্নওভার সামলাতে হয়।

যেখানে কাজ শুধু ডেলিভারির ওপর চলে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠান। এজন্যই এখন ভালো নেতার প্রথম শর্ত—উচ্চ EQ।

IQ EQ Inner 3

সমালোচনার বা অন্যায়ের মুহূর্তে EQ কীভাবে সাহায্য করে
কেউ ক্রেডিট নিয়ে নিল, সহকর্মীরা দায়িত্ব এড়িয়ে গেল—এগুলো যে কারও স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। কিন্তু EQ শেখায়—
• ঘটনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে না করে আলাদা করে দেখুন।
• রাগের মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবেন না।
• আগে শ্বাস নিন, নিজেকে শান্ত করুন।

যে মানুষ আবেগের ঢেউ থামিয়ে দৃশ্যপট পরিষ্কার করে তারপর কথা বলে—সেই মানুষই কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে স্থির, পরিণত এবং নির্ভরযোগ্য।

শেষ কথা
এই সময়টি আইকিউ বা মেধার প্রতিযোগিতা নয়—এটি স্থিরতা, মানিয়ে নেওয়া, এবং মানুষের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সময়। যেখানে পৃথিবী বদলাচ্ছে দ্রুত, সেখানে আবেগিক বুদ্ধিমত্তাই আপনাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করবে।