শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ৪:১১ অপরাহ্ন
শেয়ার

কেন আমেরিকা ও ইসরায়েল হরিহর আত্মা?


US Israel Cover

বিশ্ব রাজনীতিতে কিছু সম্পর্ক আছে যেগুলো ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির এতগুলো স্তরে জড়িয়ে গেছে যে, সেগুলোকে আলাদা করে দেখা প্রায় অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক এমনই একটি উদাহরণ। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই আমেরিকা তার পাশে দাঁড়িয়েছে, এবং আজও বিশ্বে যত সমালোচনা আসুক না কেন, আমেরিকা ইসরায়েলকে রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত। প্রশ্ন হলো—কেন এই সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ? কেন ইসরায়েল আমেরিকার কাছে এক অনন্য মিত্র?

ইসরায়েলের জন্ম ও আমেরিকার স্বীকৃতি
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাব (রেজুলেশন ১৮১) অনুযায়ী ব্রিটিশ ম্যান্ডেটভুক্ত ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। ইহুদিরা প্রস্তাব মেনে নেয়, কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো তীব্র আপত্তি জানায়।

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর মাত্র ১১ মিনিটের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন। এটি ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার, কারণ এত দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দিয়েছিল—এই নতুন রাষ্ট্রের পাশে তারা দীর্ঘদিন থাকবে।

শীতল যুদ্ধ: ইসরায়েল আমেরিকার কৌশলগত মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব বিভক্ত হয় দুটি শক্তিতে—যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। মধ্যপ্রাচ্য ছিল এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল মঞ্চ, কারণ এ অঞ্চল তেল ও গ্যাসে সমৃদ্ধ।

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ: ইসরায়েল মাত্র ছয় দিনে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধ আমেরিকাকে দেখিয়ে দেয় যে ইসরায়েল সামরিকভাবে কতটা শক্তিশালী।

১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধ: আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। যুক্তরাষ্ট্র তখন বিশাল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়ে ইসরায়েলকে রক্ষা করে। এর ফলে আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়, যদিও এর কারণে আমেরিকা আরব বিশ্বের তেল নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে।

এই দুই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চিত করে—মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে ইসরায়েলই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার।

US Israel inner 2

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন (ডানে), যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আবা ইবান (মাঝে) ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান (বামে) ।। ছবি: সংগৃহীত

সামরিক সহযোগিতা: বিশ্বের অন্যতম ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা জোট
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সাহায্য পায়। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়া হয়, যা মূলত প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয়।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় অংশ যেমন আয়রন ডোম (রকেট প্রতিরক্ষা), ডেভিড’স স্লিং, এরো মিসাইল সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় গড়ে উঠেছে।

দুই দেশ একসঙ্গে সামরিক মহড়া করে, অস্ত্র প্রযুক্তি বিনিময় করে এবং গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করে।

অন্যদিকে ইসরায়েলও যুক্তরাষ্ট্রকে উপকৃত করে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, সাইবার নিরাপত্তা, এবং নতুন অস্ত্র প্রযুক্তি উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।

US Israel inner 1

আমেরিকা ও ইসরায়েলের পতাকা ।। ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতি ও প্রযুক্তি: দ্বিপাক্ষিক পারস্পরিকতা
১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (Free Trade Agreement) হয়— যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।

আজ ইসরায়েল আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। ইসরায়েলের হাই-টেক শিল্পকে বলা হয় “সিলিকন ওয়াদি”, যেখানে গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, ইন্টেলসহ মার্কিন কোম্পানিগুলো বড় গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছে।

ইসরায়েলি প্রযুক্তি—বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, কৃষি প্রযুক্তি—যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল হারে রপ্তানি হয়।

অন্যদিকে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় অস্ত্র ক্রেতা। আমেরিকান কোম্পানিগুলোও ইসরায়েল থেকে ড্রোন ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি আমদানি করে।
ফলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক শুধু সাহায্যনির্ভর নয়, বরং পারস্পরিক লাভজনক।

US Israel inner 3

AIPAC এ ভাষণরত নেতানিয়াহু ।। ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকার ভেতরে ইসরায়েলপন্থী লবি
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রো-ইসরায়েল লবির প্রভাব ব্যাপক। AIPAC (American Israel Public Affairs Committee) নামের সংগঠনটি কংগ্রেস ও হোয়াইট হাউসের নীতিনির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

আমেরিকান ইহুদিরা জনসংখ্যার মাত্র ২% হলেও তারা অর্থনীতি, মিডিয়া, শিক্ষা ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে।

নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—দুই দলই ইহুদি জনগোষ্ঠীর সমর্থন ও অনুদান পেতে আগ্রহী থাকে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে ইসরায়েলপন্থী অবস্থান প্রায় স্থায়ী হয়ে গেছে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
আমেরিকার বহু খ্রিস্টান, বিশেষ করে ইভানজেলিক্যালরা বিশ্বাস করেন, বাইবেল অনুযায়ী ইসরায়েলের ভূমি ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরপ্রদত্ত। তাদের মতে, ইসরায়েলের শক্তি ও টিকে থাকা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ। ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে সবসময় ইসরায়েলের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলকে প্রায়শই “মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এর ফলে সাধারণ আমেরিকানদের চোখে ইসরায়েলকে “বন্ধুত্বপূর্ণ” ও “আমাদের মতো রাষ্ট্র” হিসেবে দেখা হয়।

সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ সময় ইসরায়েলকে “ফ্রন্টলাইন পার্টনার” বলা হয়।

হামাস, হিজবুল্লাহ, আল-কায়েদা প্রভৃতি সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসরায়েল গোয়েন্দা তথ্য ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ইসরায়েলের অভিজ্ঞতা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে।

জাতিসংঘে কূটনৈতিক সুরক্ষা
জাতিসংঘে ইসরায়েল প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়ে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে অসংখ্য প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রায় প্রতিবারই ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

১৯৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ বারের বেশি ইসরায়েলবিরোধী প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। এর ফলে ইসরায়েল আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি, বরং আমেরিকার কূটনৈতিক ছত্রছায়ায় টিকে আছে।

সমালোচনা ও বিতর্ক
এই সম্পর্ক যতটা শক্তিশালী, ততটাই বিতর্কিত। আরব ও মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে দেখা হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন দেওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়েছে।

US Israel inner 4

আমেরিকায় ফিলিস্তিনের পক্ষে সমাবেশ ।। ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকার ভেতরে ভিন্নমত ও প্রগতিশীল রাজনীতি
যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, দেশটির ভেতরে ভিন্নমতও ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও প্রগতিশীল রাজনীতিকদের মধ্যে ইসরায়েল নীতির সমালোচনা বেড়েছে।

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ
গাজা যুদ্ধ বা ফিলিস্তিনি হত্যাযজ্ঞের সময় আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বড় বড় বিক্ষোভ হয়েছে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ প্রায় সব বড় শহরেই প্রো-প্যালেস্টাইন মিছিল দেখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলন করে, এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। হার্ভার্ড, কলাম্বিয়া, ইউসি বার্কলে, এমআইটি—এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলে।

প্রগতিশীল রাজনীতি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশ—যাদের “The Squad” বলা হয় (আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ, ইলহান ওমর, রাশিদা তালিব, আয়ান্না প্রেসলি প্রমুখ)—তারা খোলাখুলি ইসরায়েলের নীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থনের সমালোচনা করেন।

তারা কংগ্রেসে ইসরায়েলের সামরিক সহায়তা শর্তসাপেক্ষ করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন এখনো পাননি।

জরিপে দেখা যায়, তরুণ আমেরিকান ডেমোক্র্যাটরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল, যেখানে বয়স্ক ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনশীল।

জনমতের পরিবর্তন
গ্যালাপ ও পিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকান জনগণের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমছে, বিশেষ করে ১৮–৩৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, অন্তত ৫৩ শতাংশ আমেরিকান ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন করেন না।

অনেকেই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলকে অন্ধভাবে সমর্থন না করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা।

এই ভিন্নমতগুলো এখনো মূলধারার নীতিকে পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারেনি, কারণ রিপাবলিকানরা এককাট্টা ইসরায়েলপন্থী এবং ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বও মধ্যপন্থী অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্ম ও প্রগতিশীলদের প্রভাব বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের ধরন কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

আমেরিকার ভেতরেও তরুণ প্রজন্ম ও প্রগতিশীল গোষ্ঠী ক্রমশ ইসরায়েল সমর্থনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

শেষকথা
সব দিক মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। এটি কেবল ইতিহাসের সহানুভূতি বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নয়; বরং সামরিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক পারস্পরিকতা, রাজনৈতিক লবি, কৌশলগত অবস্থান, এবং সন্ত্রাসবিরোধী জোট—সব মিলিয়ে সম্পর্কটি আজ এতটা দৃঢ় হয়েছে।

যদিও সমালোচনা ক্রমশ বাড়ছে, তথাপি বাস্তবতা হলো—যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কেন্দ্রে ইসরায়েলই থাকবে। তাদের সম্পর্ক সত্যিই এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, অনেক বিশ্লেষক এদের “হরিহর আত্মা” বলে আখ্যা দেন।