রবিবার । ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক জাতীয় ২২ নভেম্বর ২০২৫, ২:২৯ অপরাহ্ন
শেয়ার

‘জুলাই বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য সংবিধানকে উৎখাত করা নয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্ককে পরিশুদ্ধ করা’


প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, জুলাই বিপ্লবের লক্ষ্য সংবিধানকে উৎখাত করা ছিল না, বরং রাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্ককে পরিশুদ্ধ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

শনিবার (২২ নভেম্বর) ঢাকায় সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, এই নাগরিক অভ্যুত্থান ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা।

সংলাপে উপস্থিত কূটনীতিক, গবেষক ও আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই মাসের অভ্যুত্থান ছিল একটি সাংবিধানিক জাগরণ, যা আইনের শাসনকে জাতির নৈতিক ভিত্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।’ তিনি আরও বলেন, এই আন্দোলন সংবিধান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য নয়, বরং সব প্রতিষ্ঠানকে ন্যায় ও বৈধতার নীতির মধ্যে কাজ করতে বাধ্য করে এর সঙ্গে সম্পর্ককে পরিশুদ্ধ করার জন্য হয়েছে।

২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন মাসগুলোতে বিচার বিভাগের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি জানান, জাতীয় অনিশ্চয়তার সেই সময়ে বিচার বিভাগই ছিল একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর সাংবিধানিক অঙ্গ। আদালতগুলো তখন সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকেই নাগরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার রক্ষায় বিনয় এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেছে।

প্রধান বিচারপতি সেপ্টেম্বর ২০২৪-এর সংস্কার রূপরেখার অধীনে শুরু হওয়া প্রধান উদ্যোগগুলোর কথাও উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী বিচারিক রোড শো, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পুনরুজ্জীবন, সংবিধানের পঞ্চদশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিকৃতি দূরীকরণ এবং বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে একটি কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু করা।

বিশ্বজুড়ে বিচার বিভাগ যখন বৈধতার সংকট ও রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ছে, তখন বিচারিক কূটনীতির গুরুত্ব অপরিহার্য বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, গাজা, ইউক্রেন, সাহেল ও মিয়ানমারের সংকটের কারণে বিশ্ব সাম্প্রতিক দশকে সবচেয়ে উত্তাল সময় পার করছে, যা বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি অপতথ্য ও ডিপফেকের মাধ্যমে জ্ঞানের অস্ত্রায়ন গণতান্ত্রিক আলোচনাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলেছে।

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে জলবায়ুজনিত নিরাপত্তাহীনতা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ভূ-রাজনীতিকে নতুন রূপ দিচ্ছে। এটি সীমান্ত, অভিবাসন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। এই পরিবর্তিত কৌশলগত পরিবেশের মধ্যেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পুনর্গঠন নিয়ে চলমান আলোচনার মধ্যে তিনি বিচার বিভাগকে নীতির ওপর অবিচল থেকে জনগণের নির্বাচিত যেকোনো পথের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। ক্ষমতার পৃথকীকরণ, বিচারিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক শাসন, মৌলিক অধিকার এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি ‘মৌলিক কাঠামোর মতবাদ’-কে বিচার বিভাগের জন্য পথনির্দেশক নীতি হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘গত বছরের প্রতিটি রায়কে দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বীজ হিসেবে দেখতে হবে।’

বক্তব্যের শেষে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অস্থিরতার এই যুগে বিচার বিভাগের অবিচলতা, সংযম এবং সততাই হতে পারে দেশের স্থিতিশীলতার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী উৎস।’