
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক অধ্যাপক যতীন সরকার আজ ১৩ আগস্ট বুধবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরলোকগমন করেছেন। গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
অধ্যাপক যতীন সরকার ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অধ্যাপক যতীন স্যারের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন দার্শনিক, পণ্ডিত এবং শিক্ষকদেরও শিক্ষক। তিনি গভীরবোধের শক্তকথা উচ্চারণ করেন খুব সহজ শব্দমালায়। যতীন স্যারের বহুমাত্রিকতা বিশেষণ দিয়ে নির্ধারণ করা দুরূহ। এসব পরিচয় নিহিত রয়েছে তাঁর লেখায় ও সৃজনকর্মে। তিনি শিক্ষক, এটা স্যারের পেশা। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়- রাজনীতিবিদ হিসেবে, কখনো তিনি মুক্তচিন্তার সাহিত্যিক হিসেবে, কখনো তিনি প্রাবন্ধিক, কখনো তিনি কবি, আবার কখনো বা তিনি সমালোচক ও গবেষক! উননব্বই বছর পার করে নব্বইয়ে পা দেওয়ার কথা ছিল আর মাত্র পাঁচ দিন পরে। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন চিরতরে।
একজীবনে অধ্যাপক যতীন সরকার কত কিছু যে দেখেছেন, শিখেছেন, লিখেছেন, বলেছেন এবং শিখিয়েছেন তা সবই শিল্পসম্মত একেকটি বিস্ময়।
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই
অধ্যাপক যতীন সরকার স্যারের সাথে আমার পরিচয় লাভের সুযোগ আসে ২০১১ সালে । পরিচয়ের পরপরই ২০১২ সালে অধ্যাপক যতীন স্যারের জীবনী নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘আমার চোখে আমি’ নির্মাণের জন্য নেত্রকোনা জেলার সাতপাই এলাকায় অবস্থিত স্যারের বাড়ি ‘বানপ্রস্থে’ যাই। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য তিন দিন ছিলাম নেত্রকোনায়, খুব অল্পসময়ে তিনি আমাকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন। সে সময় থেকে স্যারের সান্নিধ্যে লাভের সুযোগ ঘটেছে। তারপর থেকে স্যারের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা হতো। প্রতিবার কথা বলেই মনে হতো কত কিছু শিখলাম! চিন্তায় শান দেয়া যাকে বলে! আসলে প্রকৃত শিক্ষার জীবন্ত বই ছিলেন তিনি।
প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
অধ্যাপক যতীন স্যারের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও সমাজ চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভুত ভবিষ্যত’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ’সত্য যে কঠিন’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’।
বানপ্রস্থ জ্ঞানচর্চার একটা যাদুর বাক্স
‘বানপ্রস্থ’ স্যারের বাড়ীর নাম। এই বাড়ীর নামকরণের মধ্যেও রয়েছে দার্শনিক জীবনবোধ। ‘বানপ্রস্থ’ এর আক্ষরিক অর্থ হল, ‘বনের মধ্যে অবসর যাপন করা’। প্রাচীন ভারতের জীবনচর্যার অঙ্গরূপ চারটি। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চার প্রকার আশ্রমক চতুরাশ্রম বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র মতে সমগ্র মানবজীবনের সময়কালকে চারটি সমান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য। আশ্রম বলতে মূলত কোন আশ্রয় স্থলকে বোঝায়, যেমন- ব্রহ্মচারীর আশ্রয় গুরুগৃহ, গার্হস্থ্য জীবনের গৃহীর আশ্রয় গৃহ, বানপ্রস্থীর জন্য আশ্রয় বন এবং সন্ন্যাসীর আশ্রয় বন, মঠ, মন্দির বা সর্বত্র। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকে অধ্যাপক যতীন স্যার নেত্রকোনায় সাতপাই এলাকায় ‘বানপ্রস্থে’ দিনযাপন করতেন। স্যারের বাসগৃহ ‘বানপ্রস্থ’কে আমার মনে হয় জ্ঞানের একটা যাদুর বাক্স!
সৃস্টিশীলতার মধ্যে বেঁচে থাকা
মানুষ জীবিত থাকে, কিন্তু বেঁচে থাকে খুব কম মানুষ। যিনি সৃস্টিশীলতার মধ্যে বেঁচে থাকেন, প্রতিনিয়ত নিজেকে সৃষ্টি করে যান যিনি, তিনিই বেঁচে থাকেন। অধ্যাপক যতীন সরকার তেমনই একজন।
স্যার, আপনি বেঁচে থাকবেন আপনার সৃজনকর্মে, চিন্তায় ও প্রজ্ঞায়।
ড. ইসলাম শফিক: টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, শিল্প সমালোচক ও শিক্ষক।



























