শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় মতামত ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ৬:০১ অপরাহ্ন
শেয়ার

মওলানা ভাসানীর সমাজতন্ত্র: বাম রাজনীতি, ইসলাম ও স্বনির্ভরতার নতুন ব্যাখ্যা


Vasani

আবদুল হামিদ খান ভাসানী

তাঁকে বলা হতো- ‘লাল মওলানা।’ আমেরিকা তাঁকে বলেছিল, ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স।’ কিন্তু মওলানা ভাসানী আসলে কে বা কী? ভাসানী সমাজতন্ত্রী, কিন্তু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ও তাঁর লেবাসে স্পষ্ট।
তিনি ‘মওলানা’, একইসঙ্গে মার্কস কিংবা মাও-য়ে আস্থাশীল।

এর কারণ, তিনি আজীবন চেয়েছেন কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি। দেশের রাজনীতির নিয়ন্তা হবে গণমানুষ, দেশের অর্থনীতি হবে উৎপাদনমুখী; দেশের থাকবে শক্তিশালী নিজস্ব অর্থনীতি- ভাসানী এটাই চাইতেন।

আবদুল হামিদ খান থেকে ভাসানচরের কৃষকদের জন্য আন্দোলন করে, তাদের একজন হয়ে পেয়েছিলেন ‘ভাসানী’ নাম৷ আমৃত্যু সেই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি৷

মুসলিম লীগ থেকে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তিনি সভাপতি থাকা অবস্থাতেই এর নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘আওয়ামী লীগ।’ আবার, মার্কিন বনাম সোভিয়েত দ্বন্দ্বে ১৯৫৭ সালে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তোলেন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ বা ন্যাপ। এর আগে কাগমারীতে সাংস্কৃতিক সম্মেলন করে তিনিই প্রথম পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে দিয়েছিলেন।

ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সময় ১৯৫৭ সালের ন্যাপ গঠন থেকেই শুরু। সমগ্র পাকিস্তানে বাম রাজনীতির এক বৃহত্তর সংযোগস্থলে পরিণত হয় ন্যাপ৷ পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে সে সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল এটি।

সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাম আন্দোলনের সব রথী-মহারথীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ন্যাপে যোগ দিতে থাকেন। তবে ১৯৬৭ এর নির্বাচনের সময় ভাসানী আইয়ুব খানের প্র‍তি নমনীয় ছিলেন। এই ঘটনা ন্যাপকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল।

সে বছরই ন্যাপ বড় ধাক্কাটা খায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোভিয়েত-চীন দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে ন্যাপও দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভাসানী চীন অভিমুখী হন, আর সোভিয়েতপন্থীরা থেকে যায় মোজাফফর আহমদের সাথে।

এরপর ভাসানী বিশেষভাবে স্মরণীয় একটি কাজ করেন ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে৷ তাঁর নেতৃত্বেই মূলত আইয়ুব খানের পতন ঘটে। তবে চীনের ইচ্ছায় ১৯৭০ এর নির্বাচন বর্জন তাঁর দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।

এই সুযোগে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ উত্থান ঘটে। বাংলার আপামর কৃষক-শ্রমিকের জন্য যে আস্থার জায়গা মওলানা ভাসানী তৈরি করেছিলেন, সে জায়গাটি নিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ।

এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভাসানী তত্ত্বকথা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। বই পড়ে রাজনীতি করা ব্যক্তি ছিলেন না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও এ নিয়ে মতাদর্শিক লড়াই তার কাছে মুখ্য ছিলো না। তিনি চাইতেন কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি৷ আর মঞ্চে দাঁড়িয়েও কথা বলতেন তাঁদেরই ভাষায়। পাকিস্তান সরকারকে উদ্দেশ্য করে যেমন বলেছিলেন, ‘লুঙ্গি উঁচা কইরা দেখানো লাগবে আমরা মুসলমান?’

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে চীন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকলেও ভাসানী মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেন, ভারতে যান। সেখানে একরকম গৃহবন্দী হয়েই থাকতে হয় তাঁকে।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। ‘৭২ এর সংবিধানের ব্যাপারেই তাঁর মত ছিল, ‘এখানে জনগণের আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়নাই।’

১৯৭৩ এর নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ কোনো আসন জেতেনি৷ অশীতিপর বৃদ্ধ ভাসানী নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেন। সাপ্তাহিক ‘হক কথা’ পত্রিকা প্রকাশ করে সরকারের অন্যায়-অপকর্ম তুলে ধরতে থাকেন।

সরকার এই পত্রিকার প্রকাশে বাধা আরোপ করে এবং ভাসানী একপর্যায়ে অলিখিতভাবে গৃহবন্দীও থাকেন। যদিও পরে তা প্রত্যাহার হয়৷

১৯৭৪ এ দুর্ভিক্ষ হলে ভাসানীর নেতৃত্ব ও উদ্যোগে সারা দেশে ‘ভুখা মিছিল’ হয়। সে সময় ন্যাপ থেকে অনেকেই চলে গেছেন। পার্টির অবস্থা ভঙ্গুর। তবে ভাসানী তার জায়গা থেকে চেষ্টা করেছেন তখনও।

তবে এ সময় থেকে তিনি আর বাম দল হিসেবে না রেখে নিজ দলকে সুফীবাদ ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে অন্য রূপ দিতে চেয়েছিলেন৷ ঠিক করেছিলেন ‘হুকুমাতে রাব্বানীয়া’ নামে দল করবেন। সমাজতন্ত্রে যেরকম শোষণহীন-বৈষম্যমুক্ত সমাজের কথা বলা হয়, ভাসানী একে ইসলামি আদর্শের সঙ্গে এভাবে সম্পৃক্ত করেন- জগতের সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, যে ধর্মেরই হোক না কেন, পৃথিবীতে আল্লাহ সবাইকেই তার নির্ধারিত রিযিক দেবেন। সেক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে অন্য সব মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে দেখে তাদের জন্য সমতাভিত্তিক, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব বলে ভাসানী মনে করতেন।

১৯৭৬ সালে তিনি তাঁর সর্বশেষ বড় আকারের রাজনৈতিক কর্মসূচি নেন। ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে ‘লং মার্চ’ করেন তিনি। প্রায় দশ লক্ষ লোকের সমাগমে এই লং মার্চ পুরো দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। এটি ভারতের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। ১৯৭৭-৮১ কালপর্বে পানিচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ঠিকঠাক পানি পেয়েছিল৷ এক্ষেত্রে ১৯৭৭-এ ভারতের সরকার পরিবর্তনের ভূমিকা যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো ভাসানীর এই লংমার্চের ভূমিকা।

১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর। প্রায় ৯৬ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী মৃত্যুবরণ করেন।

ভাসানী তাঁর জীবনে সবসময়ই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করে গেছেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশে কখনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলে তা অন্য কোনো দেশের অনুকরণে নয়, বরং পুরোপুরি এ দেশের মতো করেই হবে। এদেশের মানুষই এ দেশ গড়বে, অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভর করে বিদেশমুখী হয়ে নয়, বরং স্বনির্ভর অর্থনীতি দিয়েই সমতাভিত্তিক সমাজ ও দেশ গড়ে উঠবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ধর্মবোধ, সমাজতন্ত্র ও সংস্কৃতি চর্চাকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হবে না, বরং এই তিনের ভেতর সহাবস্থানের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে কাঙ্খিত সেই সমতাভিত্তিক সমাজ ও দেশ। এটাই ভাসানীর সমাজতন্ত্র।