শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
শাহরিয়ার বিপ্লব মতামত ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ৯:৫১ অপরাহ্ন
শেয়ার

গণতন্ত্রের আগাম পরীক্ষা: কেন উপদেষ্টাদের নিয়ে তিন দল একসুরে উদ্বিগ্ন


Biplob Shahriar

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনায় নতুন পারদ যোগ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেশ কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আনা ‘পক্ষপাতমূলক আচরণ’-এর অভিযোগ। যা নিশ্চিতভাবেই নতুন সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে অভিযোগের যে নতুন ‍রাজনীতি‍‍‍ শুরু করেছে তাকে রাজনৈতিক একটি ধাঁধা বলেই আপাতত মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে মনে করা যেতে পারে যে, এই ধাঁধাটি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যাশিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্ত করার হীনচেষ্টার একটা সূচনা হতে পারে।

অভিযোগের সারাংশ
এনসিপি-র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কিছু উপদেষ্টা ‘নিরাপদ বেরিয়ে যাওয়ার (safe exit)’ পরিকল্পনা করছেন, এবং অনেকেই রাজনৈতিক দল অথবা আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য জয়ী দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেছেন।
জামোয়াতে ইসলামীও তাদের বক্তব্য ব্যক্ত করেছে — তাদের মতে, ‘৭০-৮০ শতাংশ কর্মকর্তাই একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য রাখে’ এবং কিছু উপদেষ্টা ‍একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
বিএনপিও দাবি করেছে যে উপদেষ্টাদের নিয়োগ-স্থানান্তর, প্রশাসনিক পদোন্নতি ও প্রশাসনিক পরিচালনায় ‘দলগত প্রভাব’ কাজ করছে।
এই অভিযোগগুলো শুধুমাত্র কিছু উপদেষ্টা বা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমন নয়; তারা মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা-বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের ইঙ্গিত দিচ্ছে — যা নির্বাচনের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার যদি নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময় অন্য কোনো দল বা দলগুলোর প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ থাকে, তাহলে সাধারণ নির্বাচনকে সুষ্বঠু ও নিরপেক্ষ হিসেবে মেনে নেয়াটা কঠিন হয়ে পড়বে।

কেন এত উদ্বেগ?
এই অভিযোগের ঘটনায় হঠা‌ৎ করেই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এর বেশকিছু কারণও আছে।

নির্বাচন-প্রস্তুতির সময়কাল: প্রধান উপদেষ্টার দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে গোটা জাতি। সেদিক থেকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত সময়টুকু অত্যন্ত সংবেদনশীল। ঠিক এই সময়টিতে যদি সরকার এবং প্রশাসনের উপ থেকে বিশেষভাবে প্রশাসনিক নিয়োগ ও বদলিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সাধারণ মানুষের আস্থা সরে যায়, তবে আগামী নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক।

প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ: অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমুলক একটি নির্বাচন আয়োজনে শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, জেলা প্রশাসন, রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন—সবকিছুর নিরপেক্ষতা জরুরি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যে অভিযোগগুলো তুলে ধরছে, তার সুরাহা না হলে নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তেজনাতো বটেই, সংঘাত-সংঘর্ষেরও আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে।

আন্দোলনভিত্তিক সরকারের অধিকার ও সংস্কারচিন্তা: ২০২৪ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতির গুণ পরিবর্তনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে ৩০টির মতো রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের যে আপাত চেষ্টা, তাতেও খুব একটা সুফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ জুলাই সনদে গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম শরীক এনসিপি-ই এখনো স্বাক্ষর করেনি। সেটা নিয়ে আছে এক ধরনের ধোঁয়াশা, আছে খানিকটা শঙ্কাও। এসবের মধ্যেই উঠে এলো দলগুলোর এই অভিযোগের রাজনীতি। যা থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের সময়টিতে প্রত্যেকটি দলই প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের চরম কৌশল নিচ্ছে। যদিও প্রত্যেকটি দলই মুখে বলছে যে তারা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা চায়। আদতে তারা চাইছে নিজেদের প্রতি অনুগত একটি প্রশাসন। যখনই সেটা তারা পুরোপুরি নিশ্চিত, নিদেনপক্ষে আংশিকভাবে হলেও নিশ্চিত করতে পারছে না সম্ভবত তখনই তারা প্রশাসন এবং কিছু উপদেষ্টাকে তথাকথিত একটি রাজনৈতিক দল-এর প্রতি পক্ষপাত বলে অভিযোগ আনছে। কাজেই বলা যেতেই পারে যে, প্রশানসকে নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো করছে, সেটিই হতে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।

অভিযোগ-রাজনীতির পেছনের ছবি
রাজনৈতিক দলগুলো উপদেষ্টাদের নিয়োগ বা পরিচালনায় নিজেদের অংশীদারিত্ব দাবি করছে, কারণ নির্বাচনের আগে প্রশাসন রূপ নিয়েছে ‘ভবিষ্যতের ক্ষমতার ইমেজিং ইউনিট’ হিসেবে। অর্থাৎ—যে দল অথবা গোষ্ঠী প্রশাসনে থাকে, ভোটমুখী প্রচারণায় তার প্রভাব বেশি।
এনসিপি-র দৃষ্টিতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে উঠে আসা ‘নতুন শক্তি’ প্রশাসনের ভিতরে রূপান্তরিত হচ্ছে উৎস ও আদর্শবাহী ব্যাকরণ হিসেবে নয় বরং ক্ষমতার অংশ হিসেবে। তাই তারা উপদেষ্টাদের মধ্যকার রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে সরব।
জামোয়াত ও বিএনপির মধ্যকার প্রতিযোগিতাও গভীর। তারা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কারণ উভয়েরই নির্বাচনের আগে প্রশাসনকে তাদের ভোট মেশিন হিসেবে কাজ করাতে চাইছে বা চাইবে। এই কারণে তারা এক-এক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলে আধিপত্য খোঁজার চেষ্টা করছে।
এই সকল দৃষ্টিকোণ থেকে “যুক্তি” হতে পারে যে, শুধু একটি দলই রাষ্ট্র ও নির্বাচন-প্রস্তুতির নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে — এবং অন্যরা এটিকে প্রতিহিংসার খাতায় রাখছে।

আসন্ন পথ ও বিপদের সংকেত
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, নিচের তিনটি সম্ভাব্য দিক দেখা যাচ্ছে:

প্রাথমিকভাবে নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা
এটা সবারই জানা যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে গঠন হয়, তাতে বিএনপি, জামায়াত এবং আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা তখনকার ছাত্রদের (যাদের একটি অংশ পরবর্তীতে এনসিপি গঠন করে) পছন্দের তালিকা থেকেই উপদেষ্টা পরিষদ নিয়োগ হয়। যেসব উপদেষ্টা সরাসরিভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছিলেন, এখন তাদেরকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে নতুন কিছু উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। তাদের বর্তমান সরকারের নিরপেক্ষতা যেমন নিশ্চিত হবে, একইভাবে সাধারণ মানুষের আস্থাও ফিরিয়ে আনা যাবে। নয়তো এই অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা যদি চলতেই থাকে, তাতে আগামী সংসদ নির্বাচনেও দাগ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

বিভাজন বাড়লে— রাজনৈতিক অস্থিরতা গঠন হবে
যদি উপদেষ্টাদের নিয়োগ-বিচার অধিকাংশই দলভিত্তিক হিসেবে দেখা যায় এবং অভিযোগের তালিকা বড় হয়, তাহলে দলগুলো (বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি) রাজপথে চলে আসতে পারে। ভোটের আগে রাস্তায় আন্দোলন, এবং সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যদি আইনপ্রয়োগকারী সংস্আথাগুলোও দলেভেদে ভিন্ন ব্যবস্থা নেয়— তাহলে সেটিও নির্বাচনকে সংকটময় করবে।

নির্বাচনের মূল্য কমে যাবে
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হতে পারে, যদি সত্যিসত্যিই আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটি নির্বাচনের আয়োজন করা গেলো কিন্তু তাতে জনগণের উৎসাহ মিললো না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন পরিণত হতে পারে “প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিনয়”-এ। তেমনটি যদি হয়, তাহলে খাদের কিনারায় থাকা বাংলাদেশের গণতন্ত্র একেবারে খাদের ভেতরে পড়ে যাবে।

যদিও উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হওয়া অভিযোগগুলোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আসলে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী। কিন্তু তারা ভুল করছেন যদি তারা মনেই করেন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ করলেই নির্বাচন জয় নিশ্চিত হবে। প্রকৃত জয় আসে জনগণের আস্থা দিয়ে — এবং তা একের পর এক ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক কর্মসূ্চি ছাড়া সম্ভব না।

আরও বলতে চাই: যদি এখন উপদেষ্টাদের পক্ষপাত-আক্রান্ত নিয়োগ বা আলোচনা বন্ধ না হয়, তাহলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য নির্বাচন শুধুমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে যাবে, জনগণের পছন্দের নয়। এটি হবে বাংলাদশের গণতন্ত্রের জন্য বড় ধাক্কা। তাহলে “উত্তরণীয় গণতন্ত্র” বলতে যা বোঝায়—স্বাধীন নির্বাচন, শান্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া— তা দুরূহ হয়ে উঠবে।

বর্তমানে এই দৃশ্যপট স্পষ্ট: অন্তর্বর্তী সরকার, উপদেষ্টা পরিষদ, ও রাজনৈতিক দলগুলো এক-এক করে মঞ্চ ভাগাভাগি করছে। তাদের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সাধারণ ভোটার ও নির্বাচন-প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। কিন্তু এখনও সময় আছে বদলানোর। উপদেষ্টাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দখল থেকে মুক্ত করতে হবে; নির্বাচন কমিশনকে এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করার সময় এখনই। ২০২৬ সালের নির্বাচন হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র-উৎসের পরবর্তী মাইলস্টোন — যদি তা সুষ্ঠু হয়। কিন্তু যদি না হয়, তাহলে এই নির্বাচন হবে সংস্কারহীন ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশ, জন-আস্থাহীনতার স্বাক্ষর।
বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি সময়। উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধুই শব্দ নয়, এটি একটি সতর্কতা। যদি এই সতর্কতা উপেক্ষিত হয়—তাহলে আগামী নির্বাচনের প্রায়শ্চিত্ত হবে দীর্ঘ-দিন ধরে সংকটে থাকা গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা। তবে যদি এখনই নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক করা হয়—বাংলাদেশ আবার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

শাহরিয়ার বিপ্লব: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক।