
কাঠমান্ডুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ঘিরে ব্যাপক বিক্ষোভে টালমাটাল নেপাল। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন।
৭৩ বছর বয়সী নেপালি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অলি মাত্র এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভে অন্তত ২২ জন নিহত ও ৩৫০ জনের বেশি আহত হওয়ার পর তার মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য পদত্যাগ করেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
বিক্ষোভকারীরা অলির ব্যক্তিগত বাসভবনসহ সংসদ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেপালি সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা সংস্থা ও বেসামরিক প্রশাসন যৌথ বিবৃতিতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানায় এবং সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজার অনুরোধ করে।
রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেল ইতোমধ্যেই নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যদিও পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৭ সালে। নেপালের সংসদে ২৭৫ আসনের মধ্যে ১৬৫ সরাসরি নির্বাচিত এবং ১১০ অনুপাতিক ভিত্তিতে বরাদ্দ থাকে।
কীভাবে শুরু হলো বিক্ষোভ?
গত মাসে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে। আদালতের মতে, এসব প্ল্যাটফর্ম ভুল তথ্য ছড়ানোর পাশাপাশি আদালতের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে এবং জনআস্থা নষ্ট করছে।
এই রায় অনুযায়ী সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে সাত দিনের সময়সীমা দিয়েছিল। সময় শেষ হলেও নিবন্ধন না করায় ৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), রেডডিট ও লিংকডইনসহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ব্লক করে দেওয়া হয়।
শুধু টিকটক এই বাধ্যবাধকতা পূরণ করায় সেটি চালু থাকে।
এই সিদ্ধান্তে দেশটির তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ লাখো নেপালি প্রবাসী শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এসব প্ল্যাটফর্মে, পাশাপাশি অনেক তরুণ কনটেন্ট তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
“মানুষ দুর্নীতি আর ভঙ্গুর সরকারের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ কেবলমাত্র একটি ট্রিগার,” জানান Nepal Diplomat–এর সম্পাদক জগদীশ্বর পাণ্ডে।
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ আর দুর্নীতি
নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রধানত তিন দল ক্ষমতায় থেকেছে: নেপালি কংগ্রেস, অলি নেতৃত্বাধীন সিপিএন (ইউএমএল), আর নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)।
কাঠমান্ডুভিত্তিক আন্দোলনকর্মী সুশীল খাঁডকা বলেন, “দেশের অস্থিরতার পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে— রাজনৈতিক অনিয়ম, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, আর দুর্নীতি।”
তার মতে, “এটি অনেকদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ।”
নেতৃত্বহীন আন্দোলন ও বৈধতার প্রশ্ন
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গবেষক বিষ্ণু পোখরেল সতর্ক করে বলেছেন, এটি “নেতৃত্বহীন আন্দোলন,” তাই এর পরিণতি এখনই বলা কঠিন।
তিনি বলেন, “অলি সময়মতো জনগণের ক্ষোভ শোনেননি। সঠিক পদক্ষেপ নিলে এত রক্তপাত ও ভাঙচুর হতো না।”
তার মতে, রাজতন্ত্র বিলোপের পরও সাধারণ মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আসেনি। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু ‘শাসন পরিবর্তন’ দেখেছে, কিন্তু উন্নতি হয়নি।
নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় ২০০৮ সালে, যখন দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে ঘোষিত হয়।
এখন প্রশ্ন উঠছে নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে। অনেক সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছেন, ফলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান ছাড়া উপায় নেই।
সামনে কী?
প্রতিবাদকারীরা সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। নিরাপত্তা বাহিনীও এ প্রক্রিয়ায় সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ–এর নাম সম্ভাব্য নতুন নেতৃত্ব হিসেবে আলোচনায় আসছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় এবং এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন।



























