শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
ড. মোঃ শরীফুল ইসলাম দুলু মতামত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০২ অপরাহ্ন
শেয়ার

বিদেশে দলীয় শাখা: রাজনীতির সীমা কোথায়?


Soriful islam DULU

বাংলাদেশের রাজনীতি সবসময়ই প্রাণবন্ত। দেশের ভেতরে যেমন রাজনৈতিক কার্যক্রম সরগরম, বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝেও দলীয় কার্যক্রম দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য—যেখানেই প্রবাসী বাঙালি আছে, সেখানেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শাখা সক্রিয়। প্রশ্ন হলো, এগুলো আসলে কতটা প্রয়োজনীয়? নাকি এসব কার্যক্রম দেশের সুনাম এবং প্রবাসী সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে?

বিদেশে দলীয় শাখার জন্ম ও উদ্দেশ্য
১৯৭০-এর দশকের পর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। তারা দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে অর্থ, লবি এবং জনমত তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিদেশের সংগঠনগুলো অর্থ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। সেই ইতিহাস থেকেই বিদেশে রাজনৈতিক শাখার ধারণা আসে।

দলীয় নেতৃত্বও বুঝেছিল, প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা গেলে অর্থনৈতিক রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রাজনৈতিক সমর্থনও পাওয়া যাবে। ফলে বিদেশে শাখা কমিটি গঠন শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল—দলের ভাবমূর্তি প্রচার, প্রবাসীদের সমস্যা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং দেশের উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করা।

বাস্তবতা—উদ্দেশ্যের বাইরে রাজনীতি
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই শাখাগুলো অনেক জায়গায় দলীয় কোন্দলের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বিদেশের মাটিতে যারা মূলত কর্মজীবী বা পেশাজীবী হিসেবে দিন কাটান, তারা বিভক্ত হয়ে পড়েন রাজনৈতিক লাইনে। এক পক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাসী সমাজে এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়।

এমনকি বিদেশে দূতাবাসের সামনে রাজনৈতিক মিছিল, সমাবেশ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া—এসব বিদেশিদের চোখে বাংলাদেশের নেতিবাচক ছবি আঁকে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমেও নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হয়। ফলাফল—বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি
বিদেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে। অনেকে বলেন, যেসব দেশে বাংলাদেশের প্রবাসী কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ, সেখানে তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সম্মানিত হয় এবং তাদের দাবিদাওয়া দ্রুত পূরণ হয়। কিন্তু যেখানে তারা দলীয় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, সেখানে তাদের গুরুত্ব কমে যায়।

সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক উৎসব—সব জায়গায় দলীয় বিভাজন ঢুকে পড়ে। ঈদ পুনর্মিলনী বা জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানও আলাদা করে আয়োজন হয়। নতুন প্রজন্ম যারা বিদেশেই বড় হচ্ছে, তারা দেখে রাজনৈতিক বিভক্তি এবং এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় দেশের প্রতি।

কূটনৈতিক প্রভাব
কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি আরও জটিল। অনেক সময় বিদেশের রাজনৈতিক শাখা থেকে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া হয়, যা কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি করে। হোস্ট দেশের কাছে বার্তা যায়—বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়ে যায়।

প্রয়োজনীয় নাকি পুনর্বিবেচনা জরুরি
এখানে মূল প্রশ্ন—বিদেশে দলীয় শাখা রাখা আদৌ কতটা প্রয়োজনীয়? দলীয় সমর্থক থাকা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। বিদেশের মাটিতে দেশের ইমেজ তৈরি করা, প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান করা, সরকারের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছানো—এসব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা কি দলীয় শাখার মাধ্যমে করতেই হবে?

একটি বিকল্প হতে পারে—অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। যেখানে সবাই একসঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করবে। যেমন—দেশের পক্ষে লবি করা, বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, সংস্কৃতি প্রচার করা। রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও সেটা যেন ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে।

জাতীয় ইমেজ গঠনের সুযোগ
প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশ একটি আবেগের জায়গা। যদি তারা একসঙ্গে দেশের জন্য কাজ করে, বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম বহুগুণে বাড়বে। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা, নতুন বাজার খুলে দেওয়া—এসব কাজ রাজনৈতিক বিভাজন ছাড়াই করা যায়।

নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে
সরকার এবং বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাবতে হবে—বিদেশে শাখা কমিটি করা কি দলীয় লাভের চেয়ে দেশের ক্ষতি বেশি করছে? প্রবাসীদের একত্রে রাখার জন্য অরাজনৈতিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠনকে উৎসাহ দেওয়া জরুরি। রাজনৈতিক কার্যক্রম যদি করতেই হয়, তা হোক নীতিগত আলোচনা, সেমিনার বা ওয়েবিনারের মাধ্যমে—যা জ্ঞান বাড়াবে, বিভাজন নয়।

শেষকথা
বিদেশে রাজনৈতিক শাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। উদ্দেশ্য যদি হয় দেশের সুনাম বৃদ্ধি এবং প্রবাসীদের কল্যাণ, তবে সেটা হওয়া উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে। বিদেশের মাটিতে দলীয় বিরোধ নয়, বরং বাংলাদেশের উন্নয়ন, শিক্ষা, ব্যবসা ও সংস্কৃতির প্রচারে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। প্রবাসী সমাজ যত ঐক্যবদ্ধ হবে, তত দেশের সুনাম বাড়বে। আর রাজনীতিকে যদি সীমার মধ্যে না আনা যায়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ভাবমূর্তি, সৌহার্দ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দেশপ্রেম।

ড. মোঃ শরীফুল ইসলাম দুলু: স্পেশালিষ্ট, সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ইনোভেশন এন্ড ট্রান্সফরমেশন [সিপিআইটি]