শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
জেরেমি বোয়েন মতামত ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১:০১ অপরাহ্ন
শেয়ার

এক্সপ্লেইনার

গাজার যুদ্ধবিরতি ‘সবচেয়ে বড় চুক্তি’ নাকি ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস?


Gaza peace

গাজার বর্তমান চিত্র ।। ছবি: বিবিসি থেকে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ভূমিকা গাজার যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি-বন্দি বিনিময় চুক্তিতে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সূচনা বলা কঠিন।

যে কেউ জেরুজালেম ও শারম আল শেখে ট্রাম্পের বক্তৃতাগুলো শুনলে বুঝতে পারবেন—তিনি ক্ষমতার আলোয় স্নান করছেন। ইসরায়েলের সংসদে করতালির ঝড়ে যেমন তিনি উজ্জীবিত, তেমনি মিশরে বিশ্বনেতাদের সমাবেশে নিজের উপস্থিতিকে উপভোগ করছিলেন।

সেখানে উপস্থিত এক অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মন্তব্য, ‘মনে হচ্ছিল যেন ট্রাম্পের ছবিতে উপস্থিত বিশ্বনেতারা শুধু পার্শ্বচরিত্র।’

শারম আল শেখে ট্রাম্পের বার্তা ছিল স্পষ্ট—তিনি যেন ইতিহাসের এক বাঁকবদল ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জীবনে আমি সবসময় চুক্তি করেছি। সেরা চুক্তিগুলো নিজে থেকেই ঘটে যায়। এখানেও তাই ঘটেছে। হয়তো এটিই হবে আমার জীবনের সেরা চুক্তি।’

কিন্তু পর্যবেক্ষকরা জানেন, কাজটি এখানেই শেষ নয়।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি: কী হয়েছে, কী হয়নি
ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি-বন্দি বিনিময় চুক্তির কৃতিত্ব দেওয়া যায়। কাতার, তুরস্ক ও মিশর হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের রাজি করায়। এটি যৌথ প্রচেষ্টা হলেও ট্রাম্পের তাগিদ ছিল নির্ণায়ক।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তিনি এমন শর্তে রাজি করান যা এর আগে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

তবে চুক্তির ধরন বোঝা জরুরি। এটি কেবল যুদ্ধবিরতি ও বন্দি-বিনিময়ের সমঝোতা—কোনো স্থায়ী শান্তিচুক্তি নয়, এমনকি শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনাও নয়।

ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ, সুরক্ষিত রাখা এবং ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রশাসনিক কমিটি গঠনের কথা রয়েছে। এই কমিটি রিপোর্ট করবে ‘বোর্ড অব পিস’-এ, যার সভাপতিত্ব করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে। কিন্তু এই কাঠামো বাস্তবায়নে এখনো অনেক কাজ বাকি।

ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি
ওয়াশিংটনে ফিরে এসে ট্রাম্প প্রশাসন বুঝেছে, এই চুক্তির সূক্ষ্ম দিকগুলো স্পষ্ট করা জরুরি। কিন্তু সময় কম। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় সব যুদ্ধবিরতিই ভঙ্গ হয়। স্থায়ী যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে হলে উভয় পক্ষের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।

ইতিমধ্যে, গাজার যুদ্ধবিরতিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। হামাস এখনো তাদের হাতে নিহত ২৮ জিম্মির মধ্যে মাত্র আটজনের মরদেহ ফিরিয়েছে। তাদের দাবি, ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃতদেহগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইসরায়েল এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে এবং রাফাহ সীমান্ত খুলবে না বলে জানিয়েছে।

ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘শুধু সামরিক চাপই জিম্মিদের ফেরাতে পারে।’

উত্তেজনা বজায়
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখনো গাজার ৫৫ শতাংশ এলাকায় অবস্থান করছে। মঙ্গলবার ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে নয়জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বলা হচ্ছে, তারা নাকি সৈন্যদের অবস্থানের দিকে এগোচ্ছিলেন।

অন্যদিকে, হামাস পুনরায় রাস্তায় ফিরে এসেছে—সশস্ত্র, মুখোশধারী অবস্থায়। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং সহযোগিতার অভিযোগে কয়েকজনকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে।

এই দৃশ্যগুলো গাজায় নতুন করে ভয় এবং নিয়ন্ত্রণের বার্তা দিচ্ছে।

ট্রাম্প পরিকল্পনা ও বাস্তবতা
ট্রাম্পের পরিকল্পনার ১৫ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আরব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলে একটি ‘আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী’ গঠন করবে, যা গাজায় মোতায়েন হবে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি অস্থির থাকলে এমন বাহিনী পাঠানো অসম্ভব।

হামাস ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা কিছু ভারী অস্ত্র ছাড়তে পারে, কিন্তু পুরোপুরি নিরস্ত্র হবে না। কারণ তাদের বিশ্বাস—অস্ত্র ছাড়া তারা প্রতিশোধের শিকার হবে। অন্যদিকে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘হামাসের অস্ত্র শেষ করতে হবে—সহজ উপায়ে বা কঠিন উপায়ে।’

‘সবচেয়ে বড় চুক্তি’ নাকি ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস?
ট্রাম্প দাবি করেছেন, তার গাজা চুক্তিই আরব-ইসরায়েল সংঘাতের প্রজন্মব্যাপী বিরোধের অবসান ঘটাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর শান্তি বয়ে আনবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শান্তি কোনো প্রেসিডেন্টের ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি মনোযোগ, কূটনৈতিক শ্রম, এবং উভয় পক্ষের কঠিন আপোসের সিদ্ধান্ত। অতীতেও বহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেছিলেন তারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনবেন। ট্রাম্পও শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করবেন—শান্তি শুধু ইচ্ছার জোরে নয়, পারস্পরিক আত্মত্যাগের মাধ্যমেই সম্ভব।

বিবিসি’র ইন্টারন্যাশনাল এডিটর জেরেমি বোয়েন-এর লেখা ইংরেজি থেকে অনূদিত