
অক্টোবরের ১৭ তারিখ আপাত ঐতিহাসিক একটি মঞ্চে জাতীয় সংসদ ভবনের সান্নিধ্যে বাজলো জাতীয় সঙ্গীত। ‘জুলাই জাতীয় সনদ’–এর উপর একটা আনুষ্ঠানিক চিহ্ন দিল বাংলাদেশের ২৫টি রাজনৈতিক দল; প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত থেকে সনদে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস। সংবাদমাধ্যমগুলো এতে স্বাধীনতাবোধ, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেখেছে — তবে তা ছিল প্রতিশ্রুতিই, আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়। এই বাস্তবতা—অর্থাৎ সনদের অ-প্রতিবন্ধক প্রকৃতি—ই ২০২৪-এর অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের প্রধান শরীকদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস, এবং নতুনভাবে দলীয় কৌশলের সঙ্কটে ফেলা বিরোধের।
এই সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মূল কেন্দ্রে এখন জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী। গেলো প্রায় ১৫ মাস ধরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভর করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টায় দেখা গেছে এনসিপিকে। গুঞ্জন আছে, তাদের সেই চেষ্টায় নানা সময় নানাভাবে জনবল আর লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছে জামায়াত। ফলে অভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রকাশ্য অবস্থানে এই দুইটি শক্তির মধ্যে সহযোগিতার বিষয়টি একসময় নিশ্চিতভাবেই দৃশ্যমান ছিলো। শুধু এই ইস্যুতেই নয়, আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর অবশ্যম্ভাবী দেশের সবচাইতে বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি’র বিরোধী সম্ভাব্য একটি জোট হিসেবেও জামায়াত-এনসিপিকে ভাবতে শুরু করেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কিন্তু জুলাই সনদে জামায়াতের উপস্থিতি এবং এনসিপি’র অনুপস্থিতি রাজনীতির অঙ্গনে নতুন করে মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দল দুইটির সম্পর্ক এখন রূপান্তরিত হয়েছে ‘অভিযোগ আর প্রত্যাখ্যান’-এর কৌশলে। নাহিদ ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্টে জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে করা তির্যক মন্তব্যই এখন সরাসরি রাজনৈতিক বৈরিতার ছোটখাটো প্রকাশ্য রূপ।
নাহিদ কেন উদ্বেগ প্রকাশ করলেন? তাদের যুক্তি সরল। এনসিপি মনে করে, জুলাই সনদকে কাগজেই আটকে রাখলে তা হবে জনবিচ্ছিন্ন এক শোভাযাত্রা — বাস্তব সংস্কারের বদলে রাজনৈতিক ‘জনসংযোগ’। নাহিদ বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি জামায়াত। তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।
নাহিদ লিখেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীন সংস্কারের বিষয়ে দলটি (জামায়াত) আকস্মিক যে অনুমোদন দিয়েছে, সেটা সংস্কার আকাঙ্ক্ষার ফল নয়; বরং একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ। সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে এটি একটি রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত। নাহিদের এই বক্তব্যকে ‘ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেয় জামায়াত। ফল: রাজনৈতিক খণ্ডন, অনুকম্পার অভাব, এবং কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া।
এই সংঘাতের বিশ্লেষণে তিনটি পর্যায়গত বাস্তবতা দেখছি। প্রথমত, বিশ্বাসের অভাব— অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের গঠন করে দেওয়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং চুক্তি-খসড়া সম্পর্কে বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। ছাত্র-আন্দোলন থেকে জন্ম হওয়া রাজনৈতিক নতুন শক্তিগুলো মনে করে, জুলাই সনদকে আইনি ভিত না দিলে জনগণের আস্থা কাগজেই আটকে থাকবে। দ্বিতীয়ত, কৌশলগত স্বার্থের সংঘর্ষ—জামায়াতের মত বিতর্কিত (ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতে আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকা জন্য) দলগুলোর জন্য সনদে স্বাক্ষর মানে বৈধতার একটি সুযোগ; তাদের মনে হতে পারে, সম্মিলিত ছাঁচে ঢুকে রাজনীতির খেলায় নিজেদের অবস্থান মজবুত হচ্ছে। আর তৃতীয়ত, আস্থাভিত্তিক রাজনৈতিক সম্মিলনের অভাব—যদি সনদের অনুষঙ্গ আইনগতভাবে শক্ত না করা হয়, তাহলে শক্তিধর, বিশাল জমায়েত-সক্ষম দলগুলোই গোপনে শর্ত আরোপ করে জনমতকে প্রভাবিত করবে। আর এই জায়গাটিতেই এনসিপি’র যত ভয়। কারণ এখন পর্যন্ত দৃশ্যত তারা বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার কোনো বাস্তব ছাপ রাখতে পারেনি।
তাহলে ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? আমার কৌশলগত পূর্বাভাস — স্পষ্ট তিনটি সম্ভাব্য পথে বিভক্ত হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং রাজনীতির গতি: (ক) জুলাই সনদের আইনি রূপদান ও অংশীদারিত্ব, (খ) বিভাজন ও রাজপথের আন্দোলন পুনরুজ্জীবন, অথবা (গ) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তিগুলোর বিভেদে দীর্ঘকালীন অস্থিতিশীলতা।
প্রথম পথ: যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার এই জুলাই সনদকে কেবল কাগজে না রেখে আইনগতভাবে জোরদার করে—উদাহরণস্বরূপ সংসদে একটি বিল আনা, সংবিধান সংশোধন অথবা আদালতি গ্যারান্টি—তবে এনসিপি’র মতো পক্ষগুলোও অংশিদারিত্বের রাজনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারে। নাহিদের অভিযোগ যদি আইনগতভাবে মিটে যায়, জামায়াত-এনসিপি সমঝোতা সম্ভব হতে পারে। এতে আগামী নির্বাচনে (ফেব্রুয়ারি ২০২৬) কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
দ্বিতীয় পথ: যদি আইনগত নিশ্চয়তা না আসে, তবে এনসিপি’র মত ‘জুলাই-চেতনা’কে ধারণ করে গড়ে ওঠা নতুন দলগুলো আলোচনার টেবিল ছেড়ে রাজপথের কর্মসূ্চি বাড়াবে। তারা চেষ্টা করবে আরেকটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার। এতে জামায়াতও নিজেদের কৌশল পাল্টাতে পারে। এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আরও তীব্র হবে এবং রাজনীতিতে পুনরায় রাজপথকেন্দ্রিক উত্তেজনা ফিরে আসবে।
তৃতীয় পথটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ: যদি অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়তা চলতে থাকে, কয়েকটি অংশ সনদকে কেবল কাগজেই আটকে রাখে, আর জনসমর্থন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সরকার (এবং মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান) উদ্ভুত সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হতে পারে। এতে রাজনৈতিক গুমোট ভাবটি গাঢ় হয়ে উঠবে—নবগঠিত রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যপন্থা ছেড়ে অতিমাত্রায় ডান দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। আর বিএনপ’র মতো প্রতিষ্ঠিত দলগুলো পুরোনো কৌশলে ফেরার চেষ্টা করবে। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে আবারো রাস্তায় নামতে পারেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র-নেতারা। তারুণ্যের উদ্যোগ যদি প্রতারিত বোধ করে, তখন ‘দেশ সংস্কারের’ আকাঙ্খায় শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুত পুনরায় অনিশ্চয়তায় পরিণত হতে পারে।
বিশেষ করে জামায়াত-এনসিপি দ্বন্দ্বের সামনে রয়েছে একটি বাস্তব রাজনৈতিক ধাঁধা; জামায়াত জুলাই সনদে স্বাক্ষরের যথাযথ ব্যাখ্যা না দিলেও তা রাজনৈতিক লেজিটিমেসি অর্জন করে ফেলতে পারে। অন্যদিকে, পুরোনো দলগুলোর অভিজ্ঞতা আর কৌশলের কাছে মার খেয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এনসিপি।
শাহরিয়ার বিপ্লব: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক।



























