শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
ড. মোঃ শরীফুল ইসলাম দুলু মতামত ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

শিক্ষকতা পেশা: আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্যের এক অবর্ণনীয় গল্প


Dulu

শিক্ষক জাতির পথপ্রদর্শক, কিন্তু তাঁর পথ আজ কণ্টকাকীর্ণ। বাংলাদেশে শিক্ষককে বলা হয় “দ্বিতীয় জন্মদাতা”—যিনি জ্ঞানের আলোয় ছাত্রের জীবন আলোকিত করেন, চরিত্র গঠন করেন, সমাজকে পথ দেখান। কিন্তু এই মহান পেশার মানুষ এখন আর্থিক অনিশ্চয়তা, প্রাতিষ্ঠানিক অবমূল্যায়ন ও সামাজিক অসম্মানের বাস্তবতায় নীরবে সংগ্রাম করছেন।

মর্যাদা বনাম বাস্তবতা
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড শিক্ষক সমাজ, অথচ তাঁদের জীবনমান এখনও শোচনীয়। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ন্যূনতম সুবিধা পেলেও, বেসরকারি স্কুলে একজন শিক্ষককে মাসে পাচ থেকে দশ হাজার টাকায় পড়াতে হয়—যা দিয়ে পরিবারের প্রাথমিক চাহিদাও পূরণ করা অসম্ভব।
ফলে শিক্ষকতা আজ ‌‌‘অবস্থার চাকরি’—মর্যাদার পেশা নয়। মেধাবীরা পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন, কারণ এই পেশায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ফলাফল, শিক্ষকতার মান ও শিক্ষার গভীরতা—দুটোই হ্রাস পাচ্ছে।

সম্মান কমেছে কেন?
এক সময় শিক্ষক ছিলেন সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। এখন অনেক জায়গায় দেখা যায়, ছাত্র বা অভিভাবক পর্যন্ত শিক্ষককে যথাযথ সম্মান দেন না।
এটার পেছনে তিনটি বড় কারণ—
শিক্ষকের আর্থিক অনিশ্চয়তা
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
সমাজে অর্থ ও প্রভাবকে মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে দেখা।

আজ সমাজে সম্মান মাপা হয় সম্পদ দিয়ে, জ্ঞানে নয়। তাই শিক্ষক, যিনি জ্ঞানের পথপ্রদর্শক, তিনি সমাজের চোখে আর কেন্দ্রীয় চরিত্র নন।

শিক্ষা পেশায় মেধার অনাগ্রহ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা এখন শিক্ষকতা নয়, বিসিএস, ব্যাংক, কর্পোরেট বা বিদেশে যাওয়াকে বেছে নিচ্ছেন। শিক্ষকতা হয়ে গেছে ‘লাস্ট অপশন’।
একজন তরুণ যদি দেখে, বেসরকারি কলেজে শিক্ষক হয়ে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকায় টিকে থাকতে হবে—কিন্তু একই যোগ্যতায় কর্পোরেটে ৭০ হাজার টাকা পাওয়া যায়—তাহলে সে কোনটা বেছে নেবে? এই বৈষম্যই শিক্ষা খাত থেকে মেধা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

শিক্ষকের মনোযোগে প্রভাব
যে শিক্ষক নিজের জীবনযাত্রা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন, তাঁর পক্ষে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক চাপ শিক্ষককে সৃজনশীলতা ও আত্মসম্মান থেকে বঞ্চিত করে। ফলাফল, শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি ও মূল্যবোধে ঘাটতি।
এ কারণেই আজ প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে—শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে ক্লাসের বাইরে উপার্জনের পথ খুঁজছেন। এর ফলে শিক্ষা বাণিজ্যিক হচ্ছে, আর শিক্ষকতার মূল নৈতিক অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য
সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের জীবনযাত্রায় তফাৎ এখন স্পষ্ট। সরকারি শিক্ষকেরা কিছুটা নিরাপদ—কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকরা প্রায় শ্রমিকের সমতুল্য অবস্থায়।
দেশের প্রায় ৭০% শিক্ষক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই ন্যূনতম বেতন, কোনও পেনশন বা চিকিৎসা সুবিধা ছাড়াই কাজ করছেন। “জাতি গঠনের কারিগর” যদি নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীন থাকেন, তবে সমাজে শিক্ষা কতটা স্থায়ী প্রভাব ফেলবে?

পুনর্গঠনের সময় এখনই
শিক্ষকতা কেবল একটি চাকরি নয়—এটি জাতি নির্মাণের পেশা। তাই এই পেশায় আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা পুনর্গঠন জরুরি। কয়েকটি দিক বিবেচনায় আনা যেতে পারে—
১. ন্যায্য বেতন কাঠামো: সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি ন্যূনতম জাতীয় স্কেল নির্ধারণ।
২. পেশাগত উন্নয়ন: শিক্ষক যেন নিয়মিত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পদোন্নতির সুযোগ পান।
৩. সামাজিক স্বীকৃতি: জাতীয় পর্যায়ে ‘সেরা শিক্ষক’ পুরস্কার, গণমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার ও সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি।
৪. রাজনীতি মুক্ত শিক্ষা পরিবেশ: যোগ্যতা ও নৈতিকতাকে শিক্ষকতার মূল শর্ত করতে হবে।

শিক্ষক মর্যাদা ফিরলে জাতিও মর্যাদাবান হবে
শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না, তিনি সমাজের নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করেন। জাতি গঠনের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তাই যদি আমরা সত্যিকার অর্থে ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ চাই, তাহলে শিক্ষকদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে।
যে সমাজে শিক্ষক সম্মান হারান, সেই সমাজে ছাত্রদের নৈতিকতা টেকে না—জ্ঞান অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
এখনই সময়—রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক সবাই মিলে শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে আনার।
কারণ, শিক্ষক শুধু মানুষ গড়েন না, তিনি জাতি গড়েন।

ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

[এই বিভাগের মতামত লেখকের নিজস্ব]