শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
ড. মোঃ শরীফুল ইসলাম দুলু মতামত ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩১ অপরাহ্ন
শেয়ার

ব্যক্তি স্বার্থ, অর্থ ও ক্ষমতা: দলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনষ্টের চুম্বক আকর্ষণ


Dulu

বাংলাদেশের রাজনীতি একসময় ছিল ত্যাগ, নীতি ও জনগণের কল্যাণের মঞ্চ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই মঞ্চ ধীরে ধীরে ব্যক্তিস্বার্থ, টাকার প্রভাব ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দলীয় রাজনীতির মূল চরিত্র বদলে গেছে—দর্শন থেকে দখলে, নীতি থেকে নেটওয়ার্কে, এবং জনগণের স্বার্থ থেকে ব্যক্তিগত সুবিধায়।

রাজনীতির নৈতিক কেন্দ্রচ্যুতি
এক সময় রাজনৈতিক দলগুলো মানুষকে একত্রিত করত কোনো আদর্শিক প্রতিশ্রুতিতে—স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, বা উন্নয়ন। কিন্তু বর্তমানে দলীয় আনুগত্য গড়ে উঠছে মূলত স্বার্থ ও সম্পর্কের ভিত্তিতে। দল মানে এখন অনেকের কাছে ‌‌‘সুযোগের প্ল্যাটফর্ম’, যেখানে আদর্শ নয়, বরং প্রাপ্তি-প্রত্যাশাই চালিকাশক্তি।
রাজনীতিতে প্রবেশের প্রাথমিক অনুপ্রেরণায়ও এসেছে পরিবর্তন। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মের অনেক তরুণ সমাজ পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছে না, বরং ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে। ‘দলে ঢুকলে কিছু পাওয়া যায়’—এই মানসিকতা রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ক্ষত।

অর্থের প্রভাব ও রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ
রাজনীতিতে অর্থ এখন শুধু সহায়ক নয়, নির্ধারক শক্তি। নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে শুরু করে দলীয় পদ—সব জায়গায় টাকার ছাপ স্পষ্ট। স্থানীয় পর্যায়ে যে নেতা সংগঠনের কাজে নিবেদিত থেকেও পিছিয়ে পড়েন, তিনিই বাদ পড়েন কারণ তার হাতে ‘রিসোর্স’ নেই। অর্থাৎ যোগ্যতা নয়, পৃষ্ঠপোষকতাই হয়ে উঠেছে মূল্যায়নের মানদণ্ড।
এখানেই রাজনীতির এক গভীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে—যেখানে জনসেবা নয়, ব্যবসায়িক বিনিয়োগের মতো রাজনীতি পরিচালিত হয়। কেউ পদ পেলে সেটিকে লাভের উৎস হিসেবে দেখে, বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার সুযোগ হিসেবে। এই প্রবণতা শুধু দুর্নীতি নয়, দলীয় সংস্কৃতির ভিত ধ্বংসের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া।

ক্ষমতার রাজনীতি ও সংগঠনগত দখল
অর্থের পর রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি কলুষিত করেছে ক্ষমতার লালসা। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা এখন আর আদর্শিক নয়, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ। দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রায় বিলুপ্ত—উর্ধ্বতন নেতা যা বলেন, সেটাই নীতি। মতভেদ মানেই ‘অবাধ্যতা’।
ক্ষমতা যখন উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন সংগঠন হয়ে পড়ে অনুগতদের ক্লাব। এতে দলীয় অভ্যন্তরীণ আলোচনার জায়গা সংকুচিত হয়, তৃণমূলের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়, আর নেতৃত্বের প্রতি একধরনের অন্ধ আনুগত্য গড়ে ওঠে। এই অন্ধ আনুগত্যই পরিণত হয় ‘দলই রাষ্ট্র’ মানসিকতায়, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা এই চক্রটা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। প্রতিটি দল ক্ষমতায় গেলে নিজেদের মানুষকে সুযোগ দেয়, প্রশাসন দখল করে, আর বিরোধীদলকে প্রতিপক্ষ নয়—শত্রু হিসেবে দেখে। এই প্রতিহিংসার রাজনীতি ক্রমে পুরো রাজনৈতিক সমাজকে বিভক্ত করে ফেলে।

দলীয় সংস্কৃতি: আদর্শ থেকে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে
দলীয় রাজনীতির স্বাস্থ্য নির্ভর করে তার সংস্কৃতির ওপর—যেখানে আলোচনা, মতবিনিময়, এবং অংশগ্রহণ থাকে মুক্ত। কিন্তু বর্তমানে দলগুলো নীতিনির্ভর সংগঠন নয়, বরং নিয়ন্ত্রণভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসে, সবাই অনুসরণ করে। এতে রাজনৈতিক চর্চা রূপ নেয় আমলাতান্ত্রিক অনুকরণে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই অবক্ষয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। দলীয় প্রভাব প্রশাসনের সিদ্ধান্তে ঢুকে গেলে মেধা ও দক্ষতা হারিয়ে ফেলে স্বাধীনতা। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রও ক্রমে হয়ে যায় দলীয় স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার।

সংস্কৃতি বিনির্মাণের পথে ফিরে দেখা
তবু হতাশ হওয়ার সময় নয়। সমাজ ও রাজনীতির এই চক্র ভাঙতে হলে প্রথমে প্রয়োজন রাজনৈতিক শিক্ষার পুনর্গঠন। তরুণদের শেখাতে হবে—রাজনীতি মানে শুধু পদ নয়, জনগণের সেবা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। দলীয় কাঠামোর ভেতরে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র জোরদার করতে হবে। মতভেদকে বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বিকল্প চিন্তা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দলগুলোর জন্য প্রয়োজন ‘অর্থনৈতিক নৈতিকতা’ গঠন। নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, প্রার্থীর আর্থিক স্বচ্ছতা, এবং দলীয় অর্থায়নে জনগণের অংশগ্রহণ—এই বিষয়গুলোকে আইন ও প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করা জরুরি।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় পদ ও প্রশাসনিক নিয়োগে দলীয় বিবেচনা নয়, যোগ্যতাই হওয়া উচিত একমাত্র মানদণ্ড। নচেৎ রাজনৈতিক আনুগত্যই হয়ে উঠবে মেধার বিকল্প, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় অগ্রগতিকে থামিয়ে দেবে।

রাজনীতি মানে ক্ষমতা, কিন্তু সেই ক্ষমতা হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত শক্তি, ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার নয়। যখন অর্থ ও ক্ষমতা রাজনীতির একমাত্র আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সংস্কৃতি ধীরে ধীরে পচে যায়। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতি এখন সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে—যেখানে পুনর্জাগরণের সুযোগও আছে, আবার স্থায়ী ক্ষয়ের আশঙ্কাও প্রবল।

এখন প্রশ্ন একটাই, আমরা কি রাজনীতিকে আবার আদর্শ ও মূল্যবোধের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারব? নাকি দলীয় আনুগত্যের নামে ব্যক্তি স্বার্থ, অর্থ ও ক্ষমতার এই চুম্বক আকর্ষণই হয়ে উঠবে আমাদের গণতন্ত্রের চূড়ান্ত ফাঁদ?

ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

[এই বিভাগের মতামত লেখকের নিজস্ব]