
রতন টাটার মৃত্যুর এক বছর পরই ভারতের ‘লবণ থেকে ইস্পাত’—এমন বিস্তৃত শিল্প সাম্রাজ্য টাটা গ্রুপ আবারও এক গভীর সংকটে পড়েছে। রতন টাটার হাতে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর এক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠা এই ‘কনগ্লোমারেট’ এখন বোর্ডরুম দ্বন্দ্ব, নেতৃত্ব সংকট এবং ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জে জর্জরিত।
জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (JLR), টেটলি টি’র মতো বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের মালিক এবং ভারতে অ্যাপলের আইফোন নির্মাতা টাটা গ্রুপ আবারও বিভক্ত ঘরে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে ট্রাস্টিদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভারত সরকারকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে—যাতে ২০১৬ সালের মতো আরেকটি প্রকাশ্য আইনি লড়াইয়ে প্রতিষ্ঠানটি জড়িয়ে না পড়ে। সে সময় তৎকালীন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রিকে বরখাস্ত করা হলে টাটা গ্রুপ তীব্র সংকটে পড়ে।
দিল্লির মন্ত্রীরা কয়েক সপ্তাহ আগে একটি আপাত সমঝোতা করিয়ে দিলেও, সর্বশেষ খবরে জানা গেছে—রতন টাটার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং টাটা ট্রাস্টসের ট্রাস্টি মেহলি মিস্ত্রিকে বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এ তথ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিরচা রায়ানু, যিনি টাটা গ্রুপের ইতিহাস নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘এই সংঘাত আসলে পুরনো এক অমীমাংসিত প্রশ্নের পুনরুত্থান—টাটা গ্রুপে সিদ্ধান্ত নেয় কারা, এবং টাটা সন্সের ওপর টাটা ট্রাস্টস কতটা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে পারে।’
টাটা গ্রুপের কাঠামো বিশ্বের অন্যতম অনন্য—প্রধান হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সন্স-এর ৬৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে একটি দাতব্য সংস্থা টাটা ট্রাস্টস-এর হাতে। এই বিন্যাস প্রতিষ্ঠানটিকে কর সুবিধা ও নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা দিলেও, লাভজনক ব্যবসা ও দাতব্য কর্মকাণ্ডের দ্বৈত চরিত্রের কারণে পরিচালনাগত জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
এই অভ্যন্তরীণ সংকট এমন সময় সামনে এলো, যখন টাটারা নতুন ব্যবসায়িক খাতে—বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর ও বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে—বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি ২০২১ সালে সরকারের কাছ থেকে কেনা ক্ষতিগ্রস্ত এয়ার ইন্ডিয়া পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করছে। যদিও কিছুদিন আগে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা পুরো উদ্যোগে বড় ধরণের ধাক্কা দিয়েছে।
২০১৬ সালের সংঘাতের মতো এবারও দ্বন্দ্বের মূল কারণ বোর্ডে নিয়োগ, অর্থায়ন অনুমোদন এবং টাটা সন্সকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা নিয়ে মতভেদ। বর্তমানে টাটা সন্স ২৬টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূল হোল্ডিং প্রতিষ্ঠান, যার সম্মিলিত বাজারমূল্য প্রায় ৩২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
টাটা গ্রুপের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, কিছু ট্রাস্টি এখন টাটা সন্সের বোর্ডে নিয়োগ ও কৌশলগত সিদ্ধান্তে বেশি প্রভাব রাখতে চান। যদিও ট্রাস্টিদের ভূমিকা মূলত তদারকিমূলক, কিন্তু এখন তারা সরাসরি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তে অংশ নিতে চাইছেন।
সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয় হলো এসপি গ্রুপ—যারা টাটা সন্সের ১৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক—তারা কোম্পানিটিকে পাবলিক করতে চান। কিন্তু অধিকাংশ টাটা ট্রাস্টি এ প্রস্তাবের বিপক্ষে।
সূত্রের ভাষায়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে টাটা ট্রাস্টসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যাবে, দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কোম্পানি ত্রৈমাসিক মুনাফার চাপে পড়বে। বিশেষ করে যখন নতুন বিনিয়োগগুলোর অনেকই এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।”
অন্যদিকে এসপি গ্রুপের দাবি, টাটা সন্সের পাবলিক লিস্টিং “নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব”, যা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মূল্য বৃদ্ধি করবে এবং প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে।
টাটা সন্স ও টাটা ট্রাস্টস কেউই এ বিষয়ে মুখ খোলেনি। তবে অধ্যাপক রায়ানুর মতে, এ দ্বন্দ্ব টাটা গ্রুপের এক বাস্তব সংকটকে সামনে এনেছে—একদিকে কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করলে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি, অন্যদিকে বন্ধ গোষ্ঠী হিসেবেই থাকলে স্বচ্ছতার অভাব।
‘মজার বিষয় হলো, ইউরোপ ও আমেরিকার বড় কনগ্লোমারেটগুলো এখন স্থিতিশীলতা ও টেকসইতার জন্য টাটাদের মতো ফাউন্ডেশন-মালিকানাধীন কাঠামোর দিকেই ঝুঁকছে,’ বলেন তিনি। ‘তবে একই সঙ্গে, সীমিত পর্যবেক্ষণই অনেক সময় অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও ভাবমূর্তি ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
এদিকে, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনা এবং যুক্তরাজ্যে টাটা মালিকানাধীন জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (JLR)-এ সাইবার হামলার কারণে ব্রিটেনের গাড়ি উৎপাদন ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এসব ঘটনায় ব্র্যান্ডটির ভাবমূর্তি আগেই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ দিলীপ চেরিয়ান, যিনি একসময় সাইরাস মিস্ত্রির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এই দ্বন্দ্ব টাটাদের সাম্প্রতিক ধারাবাহিক সংকটের তালিকায় নতুন সংযোজন। এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনা, জেএলআরের সাইবার আক্রমণ—সব মিলিয়ে ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
এ ছাড়া টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস—যা গ্রুপের মোট আয়ের প্রায় অর্ধেক—সম্প্রতি ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই ও ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের সঙ্গে চুক্তি হারানোর মতো চ্যালেঞ্জে পড়েছে।
টাটা গ্রুপের ইতিহাসে সংকট নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকে রতন টাটা দায়িত্ব নেওয়ার পর আধুনিকীকরণে এগোতে গিয়ে বড় ধরনের বিরোধের মুখে পড়েছিলেন। আবার সাইরাস মিস্ত্রির অপসারণের পর যে লড়াই শুরু হয়, তা এখনো অনেকের মনে তাজা।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন বলে মনে করেন অধ্যাপক রায়ানু। তাঁর মতে, ‘অতীতে টাটা স্টিল বা পরে টিসিএস পুরো গ্রুপের জন্য আর্থিক ভরসা হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু এখন টিসিএস নিজেও ব্যবসায়িক পরিবর্তনের মুখে, ফলে এমন একটি শক্তিশালী ‘অ্যাঙ্কর’ অনুপস্থিত।’
‘এই সংঘাত স্বল্পমেয়াদে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে, তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে ওঠার সুযোগও এনে দিতে পারে,’ বলেন অধ্যাপক রায়ানু।ৎ
বিবিসি অবলম্বনে





























