শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ৩:০৩ অপরাহ্ন
শেয়ার

হিটলারের এক ‌‘অণ্ডকোষ’ বিতর্ক আবারও আলোচনায়


Hitlar

অ্যাডলফ হিটলার

নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার ভেবেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সব রহস্যই চিরতরে মাটিচাপা পড়বে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে বার্লিনের বাঙ্কারে আত্মহত্যার পর তাঁর নির্দেশে দেহে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যাতে শত্রুরা দেহ উদ্ধার করতে না পারে। কিন্তু ডিএনএর গঠন আবিষ্কার (১৯৫৩) এবং আধুনিক ফরেনসিক গবেষণার অগ্রগতির ফলে হিটলারর মৃত্যুর আট দশক পর সেই রহস্যের কিছুটা উন্মোচন করেছে চ্যানেল ৪–এর দু-পর্বের তথ্যচিত্র Hitler’s DNA: Blueprint of a Dictator।

তথ্যচিত্রটির সবচেয়ে আলোচিত ফল হলো—হিটলারের ডিএনএতে এমন একটি ‘ডিলিশন’ বা জিনগত ঘাটতি চিহ্নিত হয়েছে, যা যৌনাঙ্গের স্বাভাবিক বিকাশে জড়িত প্রোটিনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। গবেষক প্রফেসর তুরি কিং জানান, এই ঘাটতি PROK2 নামের একটি জিনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা Kallmann syndrome–এর কারণ হতে পারে। এই রোগে সাধারণত এক বা উভয় অণ্ডকোষ স্বাভাবিকভাবে নেমে আসে না।

২০১৫ সালে পাওয়া ১৯২৩ সালের এক চিকিৎসা নথিতে হিটলারের একটি অণ্ডকোষ থাকার দাবি করা হয়েছিল। নতুন ডিএনএ বিশ্লেষণ সেই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে। ব্রিটিশ যুদ্ধকালীন প্রচারগীত “Hitler Has Only Got One Ball”–এর জনপ্রিয় লাইনটিও হয়তো সত্যের ওপরই দাঁড়িয়েছিল—এমনটাই মনে করেন গবেষকরা।

ইতিহাসবিদ ড. অ্যালেক্স জে কে বলেন, “ব্রিটিশরা কীভাবে এটি জানত, তা এখনো পরিষ্কার নয়। হয়তো হতে পারে নিছক এক আশ্চর্য কাকতাল, অথবা হিটলারের অন্যান্য নেতাদের মতো স্ত্রী–সন্তান বা উপপত্নী না থাকার কারণেই গুজবটি জন্মেছিল।”

যৌনক্ষমতা হ্রাস, মাইক্রোপেনিস—সম্ভাব্য আরও জটিলতা
ক্যালম্যান সিন্ড্রোম-এর সঙ্গে কম টেস্টোস্টেরন, যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস এবং অনেক ক্ষেত্রে মাইক্রোপেনিস থাকার সম্পর্ক রয়েছে। তথ্যচিত্রে হিটলারের যৌন আচরণ, তাঁর ভাগ্নি গিলি রাউবালের প্রতি আসক্তি এবং শয্যাপত্রে ‘যৌনচিহ্ন না থাকা’ বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
গবেষকরা তাঁর ডিএনএ থেকে বিভিন্ন polygenic score নির্ধারণ করেন। একটি স্কোরে দেখা গেছে, হিটলারের জিনগত প্রবণতা ছিল ‘অ্যান্টিসোশ্যাল বিহেভিয়ার’ বা সাইকোপ্যাথির দিকে।

ইহুদি বংশোদ্ভূত হওয়ার গুজব নাকচ
ড. কে–এর মতে, তথ্যচিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো—হিটলারের ইহুদি বংশোদ্ভূত হওয়ার দীর্ঘদিনের গুজব পুরোপুরি বাতিল হয়েছে। তাঁর পরিবারের এক পুরুষ আত্মীয়ের সংগৃহীত লালার নমুনার সঙ্গে হিটলারের রক্তের ডিএনএ–র ‘হুবহু মিল’ পাওয়া গেছে। ফলে ১৯২০-এর দশকের সেই গুজব বাতিল হলো, যা ২০২২ সালে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভও পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।

ছিল অটিজমও
আইরিশ সাইকিয়াট্রিস্ট মাইকেল ফিটজজেরাল্ড জানান, তাঁর গবেষণায় হিটলারের ADHD–র স্কোর গড়ের চেয়ে বেশি এবং অটিজম স্কোর জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশে। তবে ড. কে জোর দিয়ে বলেন, ডিএনএ অনেক তথ্য দিলেও মানুষের মানসিক গঠন বা চিন্তাভাবনা নির্ধারণ করে না।

হিটলারের শৈশব ছিল অত্যন্ত ট্র্যাজিক—তিনি ১৮ বছর হওয়ার আগেই বাবা–মা ও পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চারজনকে হারান। গবেষকদের মতে, এই ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিগুলো তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে জিনগত উপাদানের মতোই প্রভাব ফেলেছে।

হিটলারের রক্ত সংগ্রহ থেকে ডিএনএ মিলিয়ে দেখার গল্প
গবেষণাটি শুরু হয় ২০১৮ সালে। বহু খোঁজাখুঁজির পর যুদ্ধোত্তর সংগ্রহশালা Gettysburg Museum of History–তে পাওয়া যায় হিটলারের রক্তলাগা কাপড়ের টুকরো—বার্লিন পতনের পর মার্কিন কর্নেল রসওয়েল রোজেনগ্রেন এটি সংগ্রহ করেছিলেন। প্রথম ধাপে নমুনাটি মানব পুরুষের এবং ১৯৪৫ সালের বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।

এরপর বেলজিয়ান সাংবাদিক জাঁ-পল মুল্ডারস ও ইতিহাসবিদ মার্ক ভারমিরেন সংগ্রহ করা হিটলারের আত্মীয়ের লালার নমুনার সঙ্গে ‘একদম হুবহু মিল’ পাওয়ার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি হিটলারের আসল ডিএনএ।

স্কিজোফ্রেনিয়া ঝুঁকির স্কোরও শীর্ষে
দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হয়, হিটলারের স্কিজোফ্রেনিয়ার জিনগত প্রবণতাও অনেক বেশি পাওয়া যায়। তবে একইসঙ্গে বলা হয়, এটি ঝুঁকির একটি ক্ষুদ্র অংশই নির্দেশ করে; হিটলারের আচরণে রোগটির প্রচলিত উপসর্গ ছিল না।
তথ্যচিত্র কিছু দাবিতে বাড়াবাড়িও করেছে—বিশেষত তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় অ্যালয়জিয়া ফাইটকে স্কিজোফ্রেনিয়া থেকে গ্যাসচেম্বারে পাঠানোর প্রসঙ্গ তুলে বলা হয় তাঁর মানসিক অবস্থার সঙ্গে এর যোগ থাকতে পারে। গবেষকরা সতর্ক করে বলেন, এত দূর সম্পর্ক থেকে জিনগত যোগ তৈরি করা বৈজ্ঞানিকভাবে দুর্বল।

“হিটলার নিজেই যদি জিনবিদ্যা জানতেন, হয়তো নিজেকেই হত্যা করতে বলতেন”
প্রফেসর কিং বলেন, এই গবেষণা যেন কোনোভাবেই স্নায়ুবিক বা জিনগত সমস্যায় ভোগা মানুষকে কলঙ্কিত না করে—কারণ পৃথিবীতে কোটি লোক এসব অবস্থার মধ্যেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন এবং সহিংসতা বা গণহত্যার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বিড়ম্বনাটি হলো—হিটলার নিজে যদি জিনবিদ্যা জানতেন, তাঁর নিজস্ব ডিএনএ–এর ভিত্তিতে হয়তো তাকেই নাৎসি নীতিতে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে হত্যা করা হতো।

দ্য টেলিগ্রাফ অবলম্বনে