শনিবার । ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ৫:৫৮ অপরাহ্ন
শেয়ার

তিন গোয়েন্দা ও একজন রকিব হাসান


Rakib Hasan Cover

রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০- ১৫ অক্টোবর ২০২৫)

শহরের এক কোণে ছোট্ট স্টেশনারির দোকান। পাতলা মলাটে তিন কিশোরের ছবি, নিচে লেখা— তিন গোয়েন্দা। স্কুলের বাচ্চারা ভিড় করছে বইটার সামনে। কেউ বলছে, এই খণ্ডটা পড়েছিস?” কেউ বলছে, “এইবার কিশোর কীভাবে রহস্যটা ভেদ করে দেখিস!
এইভাবেই শুরু হয়েছিল এক প্রজন্মের কল্পনার রাজত্ব— তিন গোয়েন্দার রাজত্ব।

বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে ‘তিন গোয়েন্দা’ এক অনন্য নাম। শুধু একটা বই নয়, এটা ছিল এক যুগের প্রতীক। আর এর পেছনে ছিলেন অমায়িক স্বভাবের একজন সুলেখক— রকিব হাসান। তিনি হয়তো জানতেন না, তাঁর কলম একদিন বদলে দেবে বাংলাদেশের কিশোর সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি।

তিন গোয়েন্দার জন্ম: রূপান্তরের গল্প
১৯৮৫ সাল। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে তখন নতুন ধারা আসছে। সেই সময় রকিব হাসান সেবা প্রকাশনীর জন্য লিখলেন এক নতুন সিরিজ— ‘তিন গোয়েন্দা’।
মূল গল্প এসেছিল আমেরিকার বিখ্যাত দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস নামের বই থেকে, কিন্তু রকিব হাসান সেটাকে স্রেফ অনুবাদ করেননি। তিনি সেটাকে বাংলাদেশি করে তুলেছিলেন।

তিনি বদলে দেন সবকিছু— নাম, জায়গা, সংস্কৃতি, কথাবার্তা। জুপিটার জোন্স হয়ে যায় কিশোর পাশা, বব অ্যান্ড্রুজ হয় রবিন মিলফোর্ড আর পিট ক্রেনশ রূপ নেয় মুসা আমান-এ। রকি বীচের নামটা অপরিবর্তিত থাকলেও পরিচালক আলফ্রেড হিচকক হয়ে যান ডেভিস ক্রিস্টোফার।

একটা বিদেশি গল্প এভাবে হয়ে ওঠে আমাদেরই গল্প— বাঙালি ও বাংলাদেশি পাঠকের জীবনের অংশ। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা কথাগুলো দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়:
হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা—
আমি কিশোর পাশা বলছি অ্যামিরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম তিন গোয়েন্দা।
আমি বাঙালি, থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান। ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো; অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা।
একই ক্লাসে পড়ি আমরা।
পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরান এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।
তিনটি রহস্যের সমাধান করতে চলেছি—
এসো না, চলে এসো আমাদের দলে।

Rakib Hasan Inner 1

তিন গোয়েন্দার ভলিউম ১/১ ।। ছবি: সংগৃহীত

কিশোর সাহিত্যকে কী দিল তিন গোয়েন্দা
বাংলা কিশোর সাহিত্য তখন নীতিকথা, উপদেশ আর অভিযাননির্ভর ছিল। ‘তিন গোয়েন্দা’ সেখানে নিয়ে এল রহস্য, যুক্তি আর মজার দলগত কাজের রোমাঞ্চ।
এই সিরিজ শেখায়—

কিশোররাও যুক্তি দিয়ে রহস্য ভেদ করতে পারে;
সাহস মানে হাঙ্গামা নয়, সত্যকে খুঁজে বের করা;
বন্ধুত্বই সবচেয়ে বড় শক্তি।

এখানে মারদাঙ্গা অ্যাকশন নেই, সহিংসতা নেই, কিন্তু আছে অজানাকে জানার আনন্দ। রকিব হাসান যেন এক প্রজন্মকে বলেছিলেন, ‘তোমার মাথা আর কৌতূহলই তোমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’

পাঠকের ক্রেজ: এক প্রজন্মের স্মৃতি
আশি- নব্বইয়ের দশকে ‘তিন গোয়েন্দা’ শুধু একটা বই ছিল না— এটা ছিল এক ধরনের উন্মাদনা। স্কুলে টিফিনের সময় বই হাতবদল হতো, বন্ধুরা মিলে গল্পের কাহিনী নিয়ে আলোচনা করত।
ঈদ এলেই দোকানে ভিড়— ‘নতুন তিন গোয়েন্দা বেরিয়েছে নাকি?’ তখন তো আর ইন্টারনেট বা ইউটিউব ছিল না। তিন গোয়েন্দাই ছিল কিশোরদের কাছে অ্যাডভেঞ্চার, দুঃসাহস আর বন্ধুত্বের এক অপার জগত। একটা ছোট্ট বই কিশোরদের কল্পনার দরজা খুলে দিত, আর তারা ভাবত— ‘আমরাও হয়তো একদিন রহস্যভেদ করব কিশোর পাশার মতো!’

রকিব হাসানের লেখার জাদু
রকিব হাসানের লেখায় ছিল এক চমৎকার সিনেম্যাটিক গতি। ছোট ছোট সংলাপ, মজার পরিস্থিতি, আর হালকা হাস্যরস— সব মিলিয়ে যেন সিনেমার মতো লাগে। তিনি জানতেন, শিশুরা বোকা নয়। তারা মজার সঙ্গে যুক্তি চায়, বুদ্ধির সঙ্গে রোমাঞ্চ চায়।

তাঁর ভাষা ছিল এমন সহজ যে পড়তে বসলে চোখের সামনে দৃশ্য ভেসে উঠত— রকি বিচের রাস্তা, জাঙ্কইয়ার্ডের সদরদপ্তর, কিশোরের ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা। তিন গোয়েন্দা ছিল সেই বিরল সিরিজ, যেখানে শিশুরা কেবল গল্প পড়ত না, ভাবতেও শিখত।

অনুবাদ নয়, রূপান্তর
কখনো কখনো এমন কথা উঠেছে যে, তিন গোয়েন্দা তো অনুবাদ। কিন্তু রকিব হাসান নিজেই বলেছিলেন— ‘আমি অনুবাদ করিনি, আমি গল্পগুলোকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের উপযোগী করে সাজিয়েছি।’

তিনি মূল গল্পের কাঠামো ঠিক রেখে পুরোটা নতুন করে বুনেছেন। ভাষা, রসবোধ, চরিত্র— সবকিছু বাংলাদেশি পাঠকের স্বভাব অনুযায়ী তৈরি করেছেন। এই কারণেই তিন গোয়েন্দাকে কখনো বিদেশি গল্প মনে হয়নি। এটা ছিল আমাদেরই গল্প— বাঙালি কিশোরদের গল্প।

Rakib Hasan Inner 2

তরুণ বয়সে রহস্যপত্রিকার প্রচ্ছদে রকিব হাসান ।। ছবি: সংগৃহীত

রকিব পরবর্তী যুগ
২০০৩ সালে সিরিজটির দায়িত্ব নেন শামসুদ্দীন নওয়াব। তবে মজার ব্যাপার হলো, এটি সেবা প্রকাশনীর গোস্ট রাইটারদের একটি কমন নাম। এই নামে বিভিন্ন লেখকই তিন গোয়েন্দা লিখেছেন। এরপর সেখানে যোগ হয়েছে নানা নতুন দিক— সায়েন্স ফিকশন, সময় ভ্রমণ, অতিপ্রাকৃত রহস্য। তবে পাঠকের মনে যে মমতা, যে উত্তেজনা, যে আবেগ তৈরি হয়েছিল তিন গোয়েন্দার প্রতি— তার ভিত্তি রকিব হাসানের সময়েই গড়ে ওঠে।

রকিব হাসান এমন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন, যেখানে কাহিনী আর পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছিল।

বাংলা শিশুসাহিত্যকে বদলে দেওয়া এক সিরিজ
তিন গোয়েন্দা শুধু একটি জনপ্রিয় সিরিজ নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের গতিপথই বদলে দিয়েছিল।
এর প্রভাব আমরা কয়েকভাবে দেখতে পাই—

সাহিত্যিক পরিবর্তন
এর আগে শিশু বা কিশোরদের জন্য গল্প মানেই ছিল নীতিকথা, ছড়া বা সহজ অভিযানের গল্প। তিন গোয়েন্দা প্রথম দেখাল, কিশোররাও জটিল রহস্য, গোয়েন্দা কৌশল আর মানসিক বিশ্লেষণ বুঝতে পারে। বাংলা ভাষায় কিশোরদের জন্য যুক্তিনির্ভর রহস্যগল্প লেখার পথ তৈরি হয় এখান থেকেই। গোয়েন্দার সহকারী নয়, বরং কিশোর বয়সীরাই এখানে বুদ্ধিদীপ্ত গোয়েন্দা৷

পাঠাভ্যাসে পরিবর্তন
তিন গোয়েন্দা এক নতুন ধরনের পাঠ সংস্কৃতি তৈরি করেছিল।
এখন যে বয়সে শিশুরা মোবাইলে বা টিভির কার্টুনে ডুবে থাকে, তারা তখন পাতলা পেপারব্যাক বই হাতে রহস্যকাহিনী পড়ত। বই পড়া একটা ‘কুল’ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। স্কুলে তিন গোয়েন্দা হাতে থাকা মানে ছিল আলাদা একটা স্টাইল, একটা পরিচয়। অনেকে পাঠ্যবইয়ের ভেতর লুকিয়ে পড়ত তিন গোয়েন্দা।

সামাজিক প্রভাব
তিন গোয়েন্দা এমন এক ভাষা তৈরি করেছিল, যা শহর-গ্রাম-সব জায়গার বাচ্চারা বুঝত। ঢাকায় কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ে— সবাই জানত কিশোর, রবিন আর মুসার নাম। এই সিরিজের মাধ্যমে গোটা দেশের কিশোরদের মধ্যে এক ধরণের সাংস্কৃতিক ঐক্য তৈরি হয়েছিল।

শিশু সাহিত্যকে আধুনিকীকরণ
তিন গোয়েন্দা আমাদের কিশোর সাহিত্যকে বিশ্বমানের ধাঁচে নিয়ে যায়— সহজ ভাষা, আকর্ষণীয় কাভার, নিয়মিত প্রকাশ, আর বন্ধুত্ব-রহস্য-হাসির মিশ্রণ সিরিজটিকে কিশোরদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় করে তোলে। এই ধারা পরবর্তীকালে কিছু লেখক ও প্রকাশনি অনুসরণ করে। তবে তারা কেউই এতটা সফল হতে পারেনি।

Rakib Hasan Inner 3

রকিব হাসান ।। ছবি: সংগৃহীত

একজন রকিব হাসান
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্ম নেয়া রকিব হাসান প্রয়াত হয়েছেন ২০২৫ সালের ১৫ অক্টোবর। জন্ম নাম আবদূর রকিব হলেও শাহাদত চৌধুরী তার লেখক নাম দেন ‘রকিব হাসান’। ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ অনুবাদ করে তার সাহিত্য জগতে পদার্পণ। অনুবাদ করেছেন ‘তিমির প্রেম’ এর মতো কালজয়ী বই। করেছেন আরো বহু কাজ। তবে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ‘তিন গোয়েন্দা’ দিয়ে।

আজও পুরনো বইয়ের দোকানে যখন ‘তিন গোয়েন্দা’র সাদা মলাট চোখে পড়ে, মনে হয় শৈশবটা ঠিক পাশেই বসে আছে।
রকিব হাসান শুধু একটা সিরিজ লেখেননি, তিনি এক প্রজন্মকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন— বিদেশি গল্পও আমাদের মাটির গন্ধ নিতে পারে, যদি ভালোবাসা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে সাজানো হয়।

তিন গোয়েন্দা আজও বেঁচে আছে—কিশোর পাশার ঠান্ডা মাথায়, মুসার হাসিতে, রবিনের যুক্তিতে। আর তাদের পেছনে রয়েছেন একজন মানুষ— রকিব হাসান। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, সাহিত্য তত্ত্ব দেখে না, ভালো ও হৃদয়গ্রাহী লেখাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।